বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া ১৪ জন ভারতীয় কীভাবে ফিরলেন দেশে
৬ জুন ২০২৫২৬ মে রাতে আসামের গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়া ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে ১৪ জন ভারতীয় নাগরিককে গোপনে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল আদালতের রায়ে ‘সন্দেহজনক বিদেশি’ বলে চিহ্নিত, যদিও তাদের অনেকের মামলা এখনও গুয়াহাটি হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। বিতর্ক শুরু হতেই রাতের অন্ধকারে ফেরত আনা হয়েছে ওই ১৪ জনকে। তবে গোটা প্রক্রিয়াই হয়েছে গোপনে।
এই তালিকায় আছেন বরপেটার সোনা বানু। যিনি বহু বছর আগে একতরফা ট্রাইব্যুনাল রায়ে ‘বিদেশি’ বলে ঘোষিত হন। জেল খাটার পর গুয়াহাটি হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্ত হন তিনি। তার ভাই আশরাফ আলী জানান, ২৩ মে থানায় ডেকে তার বোনকে আটকে রাখা হয় এবং ২৬ মে মাটিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে তাকে মানকাচারে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়।
সীমান্তের ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’-এ এক রাত এক দিন কাটান তারা। পরে বিজিবি (বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী) তাদের আটক করে নিয়ে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে, দু’দিন পর আবার গোপনে ভারতের মাটিতে ফেরানো হয় তাদের।
রাতে, রাস্তার পাশে নামিয়ে দেওয়া হয় সোনাকে। তিনি ভাইকে ফোনে জানান, পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়ে বলেছে, “বাড়ি চলে যাও।” আশরাফ তখন রাতেই ১০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বোনকে বাড়ি নিয়ে আসেন।
আশরাফ আলী ডিডাব্লিউকে জানান, ২৩ মে স্থানীয় এক পুলিশ আধিকারিক তার বোনকে ফোন করে নথি যাচাইয়ের নামে থানায় ডেকে পাঠান। সেখানে তার নথিপত্র প্রাথমিক পরীক্ষার পর তাকে আটক করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গোয়ালপাড়ার মাটিয়ায়। তবে তারা ভাবতে পারেননি সেখান থেকে সোনাকে বাংলাদেশ ঠেলে দেওয়া হবে।
আশরাফ বলেন, "২৬ মার্চ রাতে মাটিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে আমার বোনকে একটি গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মানকাছার জেলায় এবং সেখানে ভারত-বাংলা সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হয় তাকে। তার সঙ্গে ছিলেন আরো কিছু মানুষ। দুই দেশের সীমান্তের মধ্যে 'নো ম্যানস্ ল্যান্ড' বলে যে খালি জায়গা রয়েছে, সেখানে এক রাত একদিন খোলা আকাশের নিচে কাটিয়েছেন তারা। এরপর বাংলাদেশের সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী বিজিবি তাদের আটক করে এবং নিয়ে যায় একটি ক্যাম্পে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে দুদিন পর আবার গোপনেই তাদের ভারতে নিয়ে আসা হয়।"
কীভাবে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল?
আশরাফ জানান, সোনা বানু এবং অন্যান্যদের গোয়ালপাড়া থেকে মানকাছার নিয়ে যাওয়ার সময়ও পুলিশের একটি বিরাট দল তাদের কাছাকাছি ছিল। বাংলাদেশ থেকেও এভাবেই একটি গাড়িতে বসিয়ে তাদের প্রথমে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার কাছাকাছি নিয়ে আসা হয় এবং ভারতে ঢোকার পর আরেকটি গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মাটিয়ায়। তাদের কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এসব কিছুই বলা হয়নি। ঠিক যেন পশুকে গাড়িতে উঠিয়ে অন্যত্র নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।"
সোনা বানুকে রাতের অন্ধকারে ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল
আশরাফ জানান, রবিবার (১ জুন) রাত সাড়ে এগারোটায় তার কাছে একটি ফোন আসে এবং ওপারে ছিলেন সোনা বানু। তিনি আশরাফকে জানান, পুলিশ তাকে কোথাও একটা রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে এবং বলেছে বাড়ি চলে যেতে। আশরাফ বলেন, "তাকে গোয়ালপাড়ার কোনও এক রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যেখান থেকে আমাদের ঘর ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে। তখন রাত সাড়ে এগারোটা, আমরা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে তার উদ্দেশ্যে রওনা দিই এবং ভোর তিনটে নাগাদ ওই জায়গায় পৌঁছে তার সঙ্গে দেখা হয়। তার এই অসহায় অবস্থা দেখে এলাকার কিছু লোক রাতটুকু থাকার মতো আশ্রয় দিয়েছিলেন। আমরা তাকে সেখান থেকে বাড়ি নিয়ে আসি এবং পরবর্তীতে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সোনাও স্বাভাবিক হওয়ার পর গোটা বিষয়টি আমাদের জানিয়েছে।"
তাদের আইনজীবী জানিয়েছেন, বহু বছর আগে সোনা বানুকে একতরফা রায়ে বিদেশি ঘোষণা করেছিল বরপেটা জেলার এক ট্রাইবুনাল আদালত। পরবর্তীতে তিনি জেল খেটেছেন এবং হাইকোর্টের দেওয়া জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় এক থানায় গিয়ে হাজিরা দেন। তাকে হঠাৎ করে তুলে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টি আদালতে জানানো হয়েছিল এবং আদালত সরকারের কাছে এবিষয়ে জবাব চেয়েছে।
সোনা বানু বলেন, "আমাদের দেখে বাংলাদেশের ওই এলাকার বহু মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। জায়গাটির নাম আমি জানি না। তবে স্থানীয়রা আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। আমাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার সময় বিএসএফ এবং বিজিবির আধিকারিকদের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময় হয়। একসময় গুলি চলার আওয়াজ পাই এবং কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পাই বিএসএফ আমাদের রেখেই চলে গেছে। আমরা খোলা মাঠে গোটা দিন এবং রাত কাটিয়েছি। স্থানীয়রা কিছুটা খাবার দিয়েছিলেন। এমনকি তাদের ফোনের সাহায্যে বিষয়টি আমার ঘরেও জানিয়েছিলাম। তবে কেউ তাদের বাড়িতে আমাদের আশ্রয় দেওয়ার সাহস করতে পারেননি। আমরা তাদের সরকারের কাছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।"
সোনা বানুর মতোই মরিগাঁও জেলার প্রাক্তন শিক্ষক মোঃ খাইরুল ইসলাম এবং কৃষিজীবী নুরুল ইসলামকে বাংলাদেশের ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। তাদের পরিবার জানিয়েছেন, একইভাবে চুপচাপ তাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ডিডাব্লিউ এই ১৪ জনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। অনেকেই কথা বলেছেন, আবার কিছু মানুষকে যোগাযোগ করা যায়নি। অনেকেই এখন কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। তাদের মামলা এখনো শেষ হয়নি।
বিএসএফ এবং আসাম সরকারের দাবি
বিষয়টি নিয়ে ভারতের সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী বিএসএফ-এর আধিকারিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল ডিডাব্লিউ, তবে তারা এনিয়ে কথা বলবেন না বলে জানিয়েছেন। ২৭ মে বিএসএফ বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে একদল মানুষ রাতের অন্ধকারে আসামে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাদের আটকে দেওয়া হয়েছে। সোনা বানু জানিয়েছেন, তাদের নিয়ে যখন বিএসএফ বাংলাদেশে ঢোকে, সেই দেশের সুরক্ষা বাহিনী বাধা দেয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয় এবং বিএসএফ শূন্যে গুলি চালায়। তবে পরবর্তীতে প্রমাণ হয় ওই ১৪ জনকে আসলে ভারত থেকেই বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। তারা সেখানে প্রায় ২৪ ঘন্টা খোলা আকাশের নিচে থেকেছেন। এরপর দু'রাত অজানা কোনো ক্যাম্পে। কিন্তু বিএসএফ এনিয়ে কিছুই বলতে চায়নি। কথা বলেননি সরকারি কর্মকর্তারা।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নির্দেশে গত ২৩ মে পুলিশের একটি অভিযান শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, অন্তত তিরিশ হাজার অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিভিন্ন সময়ে চিহ্নিত করেছিল রাজ্যের ট্রাইবুনাল আদালতগুলি। তারা এরপর গা ঢাকা দিয়েছেন এবং গোপনে আসামেই থাকছেন। তাদের খুঁজে বের করতে একটি অভিযান শুরু করা হয়েছে। তিনি বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট গত বছর আমাদের নির্দেশ দিয়েছিল ঘোষিত বিদেশিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে। আদালতের নির্দেশ মেনেই আমরা কাজটি করছি এবং এই অভিযান চলবে।"
বুধবার বিকেলে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে হিমন্ত বলেন, "গত এক মাসে আমরা বহু বাংলাদেশিকে চিহ্নিত করেছি এবং তাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই রাজ্যের সংস্কৃতি এবং সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার জন্যই আমরা অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে আরেকটু কঠোর হয়েছি। আমরা বহুবছর ট্রাইবুনাল এবং আইন ইত্যাদি মেনে চলেছি, তবে এবার আর নরম সুর নয়। এবার থেকে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের ঠেলে দেওয়া হবে, এটাই আমাদের নীতি।"