ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যার ঘটনা আবার শিরোনামে৷ সম্প্রতি ত্রিপুরার সীমান্তে এমনই এক হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ বিএসএফ-এর গুলিতে মৃত্যু হয়েছে এক বাংলাদেশি নাগরিকের৷
বিএসএফ জানিয়েছে, দাঁ, কাটারি নিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল বাংলাদেশি চোরাচালানকারীদের একটি দল৷ আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই বিএসএফ-এর জওয়ান গুলি চালায়৷ আহত হয়েছেন বিএসএফ-এর এক জওয়ানও৷ সীমান্তরক্ষীর গুলিতে প্রাণ গেছে বাংলাদেশির৷
এ কোনো নতুন ঘটনা নয়৷ আসাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত৷ সীমান্ত হত্যার সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে এই তিন রাজ্যে৷ মেঘালয় এবং মিজোরামের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্ডার থাকলেও সেখানে সীমান্তে গুলি চলার ঘটনা কম৷
সীমান্ত নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের বক্তব্য, পাকিস্তান সীমান্তে ভারত সবচেয়ে বেশি সীমান্তরক্ষী মোতায়েন রাখে৷ কিন্তু সেই সীমান্তেও হত্যার এত নজির নেই৷ এই ঘটনা কেবলমাত্র বাংলাদেশ সীমান্তেই ঘটে৷ কারণ, বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ ‘ট্রিগার হ্যাপি'৷
গত বছর আগস্ট মাসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পট পরিবর্তন হয়েছে৷ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন শেখ হাসিনা৷ যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে সীমান্তে৷ বহু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করেছেন৷ বহু মানুষ ঢুকেওছেন৷ ফলে গত কয়েকমাসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ-এর কাজও অনেক গুণ বেড়েছে৷ বেড়েছে গুলি চলার ঘটনাও৷
আগরতলা রেলপুলিশ থানার অফিসার তাপস দাসের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুপ্রবেশ এবং মানবপাচার সংক্রান্ত ২৯টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে৷ ওই সময়কালে ৩০ জন মানবপাচারকারী, ৯৮ জন বাংলাদেশি, ১০ জন রোহিঙ্গাকে শুধুমাত্র ত্রিপুরা সীমান্তেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ পাচারকারীদের মধ্যে ছয় জন পশ্চিমবঙ্গের এবং দুই জন গুজরাটের বাসিন্দা৷ এছাড়া ২০২৫ সালে এখনও পর্যন্ত ১৮ জন মানবপাচারকারী এবং ১৭ জন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী আটক হয়েছেন৷ ত্রিপুরার কৈলাসহর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে মোট ২৫ জন মানবপাচারকারী এবং বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী৷ ধৃতদের অনেকেই চিকিৎসা করাতে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন৷ কেউ বা আসছিলেন কাজের খোঁজে৷ পুলিশের কাছে এমনই জানিয়েছেন তারা৷
অর্থাৎ, ধৃতরা দাগি অপরাধী নন৷ কেন তাদের বেআইনি পথ বেছে নিতে হলো, এই বিষয়টি বোঝা দরকার৷ একইসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, সীমান্তে বিএসএএফ-এর গুলিতে যারা নিহত হচ্ছে, তারাও এই ধরনের মানুষ নয় তো?
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, আগস্টের পর বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দেওয়া কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে ভারত৷ তবে আগেও ভারতের ভিসা পেতে বাংলাদেশিদের প্রচুর কাঠ-খড় পোড়াতে হতো৷ ভিসা দিতে বহু সময় নেয় ভারত৷ বহু সময় ভিসার আবেদন নাকচ হয়ে যায়৷ ফলে বেআইনি পথে ভারতে প্রবেশের প্রবণতা বরাবরই বেশি৷ নেপাল, ভুটান বা মিয়ানমার সীমান্তে এই সমস্যা নেই৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশেই আছে৷ পাকিস্তানের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা৷
ব্যবসার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা৷ দুই দেশের মধ্যে বৈধ বাণিজ্য পথ আছে৷ কিন্তু এই ব্যবসার সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের অনেকেরই বক্তব্য, লাল ফিতের ফাঁসে অনেক সময়েই আটকে থাকে কাজ৷ সামান্য সমস্যা মিটতে সময় লাগে অনেক৷ ফলে অবৈধ পথে ব্যবসার প্রবণতা ক্রমশ বেড়ছে৷ এক সময় দুই দেশের মধ্যে খোলা সীমান্ত ছিল অনেক বেশি, ফলে অবৈধ ব্যবসার চক্র তৈরি হয়েছে৷ সীমান্তের গ্রামের মানুষ বুঝে বা না বুঝে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন৷
গত কয়েক বছরে সীমান্তের অধিকাংশ জায়গাতেই কাঁটাতার বসানো হয়েছে৷ ফলে অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ধরা পড়ছেন অনেক বেশি৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বিএসএফ-এর অত্যাচারের শিকার হন সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষেরা৷ যার অধিকাংশই ভারতীয়৷ সরকার চাইলে অনেক মানবিকভাবে তাদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে পারতো৷ কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ঠিক তার উল্টো৷ মানবাধিকার সংস্থা মাসুমের রিপোর্ট বলছে, সীমান্ত হত্যা এবং নির্যাতনে যারা আক্রান্ত তাদের ৮০ শতাংশ ভারতীয়৷ মাত্র ২০ শতাংশ বাংলাদেশি৷ অর্থাৎ, নিজের দেশের মানুষের উপরেই চড়াও হচ্ছে সীমান্তরক্ষীরা৷ এটি একটি প্রবণতা বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে ওই রিপোর্টে৷
ফেরা যাক ত্রিপুরার কথায়৷ সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলির একটি বড় অংশের মানুষ সরাসরি বা ঘুর পথে চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত৷ কারণ, সীমান্ত অঞ্চলে এটি একটি জীবিকা৷ আট থেকে আশি - সব বয়সের মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত৷ চলতি বছরে সোনামুড়ার বক্সনগরে এক ১৩ বছরের নাবালক এই কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল৷ সেই সময় বিএসএফ-এর রাবার বুলেটে আহত হয় সে৷ স্থানীয় মানুষের অভিযোগ ছিল, কোনও প্ররোচনা ছাড়াই বিএসএফের ৪৯ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের দুই জওয়ান বাজারে হামলা চালিয়েছিল৷ স্থানীয় মানুষ প্রতিবাদ করায় বিএসএফ রাবার বুলেট চালায় বলে অভিযোগ৷ যদিও বিএসএফের দাবি, বক্সনগরে চোরাচালান হচ্ছিল৷ তারা সেই চোরাচালান হাতেনাতে ধরে ফেলার পর এলাকার কিছু মানুষের সঙ্গে বিএসএফ-এর বিরোধ বাধে, তারপরেই রাবার বুলেট চালায় তারা৷ মানবাধিকার কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, চোরাচালানকারীদের সঙ্গে বিএসএফ-এর আর্থিক লেনদেন হয়৷ রফা না হলে বিএসএফ চড়াও হয়৷ ওই দিনও এমনই ঘটনা ঘটেছিল বলে তাদের দাবি৷
সীমান্তে এমন বহু নজির আছে৷ এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই কৈলাসহরে একটি ঘটনা ঘটে, যেখানে বিড়ি পাচারকারীদের ধরতে গিয়ে দুই বিএসএফ জওয়ান বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন৷ সেই সময় বিজিবির সহায়তায় কোনওরকমে প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরেছিলেন দুই জওয়ান৷
এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন সন্ধে সাতটার কিছু পরে গুলি চলে বক্সনগরের পুটিয়া গ্রামে৷ অন্ধকারে জঙ্গলে ঘেরা পুটিয়া সীমান্তের ৬ ও ৭ নম্বর গেটের মাঝামাঝি এলাকায় বিএসএফের গুলিতে প্রাণ যায় এক বাংলাদেশি যুবকের৷ বিএসএফ-এর অভিযোগ, চাল, চিনি, গাঁজা ভারত থেকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন ওই যুবক৷ ভারতীয় পিলারের ১৫০ মিটারের মধ্যে প্রায় ১২-১৪ জন বাংলাদেশি ঢুকে পড়েছিলেন বলে অভিযোগ৷ বিএসএফ-এর অভিযোগ, তাদের ফিরে যেতে বলা সত্ত্বেও তারা ভারতের দিকে ঢুকতে থাকে৷ সীমান্তরক্ষীদের উপর তারা হামলা চালায় বলেও অভিযোগ৷ কিন্তু সীমান্ত লাগোয়া ভারতীয় গ্রামবাসীদের বক্তব্য ভিন্ন৷ তাদের বক্তব্য, বিএসএফ বিনা প্ররোচনায় গুলি চালিয়েছিল৷ মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী পুরুষোত্তম রায় বর্মন ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ‘‘বিএসএফের গুলি চালানো উচিত হয়নি৷ এটা অনাকাঙ্ক্ষিত৷ জেলাশাসকের নেতৃত্বে তদন্ত হওয়া উচিত৷''
বারবার বিএসএফের বিরুদ্ধে অত্যাচার, মারধর, গুলি চালানোর অভিযোগ উঠছে৷ কিছুদিন আগে দিল্লিতে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের বৈঠকেও এই বিষয়টি উঠে এসেছিল৷ কিন্তু তারপরেও ছবি বদলায়নি৷ ছবি বদলায় না কারণ, সমস্যাটি মানসিকতার৷ ট্রিগারে আঙুল রেখে সীমান্ত পাহারা চললে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে৷