এই যে পথে আনতে না পারা—এটা একটা বাস্তবতা৷ এর বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হচ্ছে—সরকার কি আদৌ তাদেরকে লাইনে আনতে চেয়েছে? সে জন্য তারা কি এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিয়েছে?
একটা গণঅভ্যুত্থানের পর এই সরকার দায়িত্বে এসেছে৷ আগের সরকার পালিয়েছে৷ হাসিনা সরকার কিন্তু দু-একদিন নয়, প্রবল দাপটে ক্ষমতায় ছিল টানা পনেরো বছর৷ এই পুরো সময়টা জুড়ে তাদেরকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেছে যারা, তাদের মধ্যে প্রথমেই উচ্চারিত হবে পুলিশ বিভাগের নাম৷ আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হেন কাজ নেই, যা তারা করেনি৷ বিনিময়ে সরকারও তাদেরকে দিয়েছে যথেচ্ছ দুর্নীতি করার অবাধ স্বাধীনতা৷ ফলে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল, পুলিশ শব্দটাই যেন সাধারণ মানুষের কাছে ভীতিকর হিসাবে বিবেচিত হচ্ছিল৷
গত বছরের জুলাই মাসে যখন আন্দোলনটা শুরু হয়, ছাত্র-জনতার মুখোমুখি অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়েছিল এই পুলিশ বাহিনীই৷ নির্দয়ের মতো গুলি চালিয়েছে নিরস্ত্র মানুষকে লক্ষ্য করে৷ তারাই যেন ছিল সরকারের পক্ষাবলম্বনকারী প্রধান শক্তি৷ ফলে এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের কাছেও প্রধান ও প্রথম প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছিল দেশের পুলিশ বাহিনী৷ এমন পরিস্থিতিতে স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর স্বভাবতই পুলিশ বাহিনী স্বস্তিতে ছিল না৷ তাদের প্রভাবশালী ও শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাই পালিয়েছে, অনেকে গ্রেফতার হয়েছে৷ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে৷ অনেকের মধ্যে এতটাই ভয় ঢুকে গিয়েছিল যে, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছুদিন তারা অফিসে পর্যন্ত যায়নি৷ সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদেরকে ডেকে আনতে হয়েছে৷
আন্দোলন চলাকালে পুলিশের ওপর আক্রমণের সকল ঘটনাই যে খুব যৌক্তিক ছিল সেটা কিন্তু বলা যাবে না৷ জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের অনেক জায়গায় হয়ত আন্দোলন নিয়ে মাঠ অতটা উত্তপ্ত ছিলই না, তারপরও সেখানে আক্রান্ত হয়েছে থানা, লুটপাট হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র৷ সে অস্ত্রের কিছু উদ্ধার হয়েছে, কিছু হয়নি৷ আবার মুখোমুখি সংঘর্ষে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি পুলিশও মারা গেছে৷ কিন্তু নিহত সেই পুলিশকে যখন ফ্লাইওভারে উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সেটাকে সমালোচনা না করে বরং বাহবা দেওয়া হয়েছে, তখন স্বভাবতই সেটা পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে৷ এরপর আবার আন্দোলনে নিহত পুলিশদের বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যখন ইনডেমনিটির কথা এসেছে, অবধারিতভাবেই সেটা পুলিশ বাহিনীর মনোবলকে ভেঙে দিয়েছে৷ ভাঙা সেই মনোবল চাঙ্গা করার কোনো উদ্যোগ কি এ যাবত দেখা গেছে? ইউনূস সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনকে শুরুর কয়েক দিন এ ব্যাপারে বেশ উদ্যোগী বলে মনে হয়েছিল৷ কিন্তু দ্রুতই তাকে সরিয়ে দেওয়ায়, পুরো বিষয়টিই যেন থমকে গেছে৷
এরমধ্যে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুদফায় বেশ কয়েকটি খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে৷ প্রথম দফায় যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়, তার মধ্যে পুলিশও একটি৷ তারা পুলিশ বিভাগকে যেন নতুনভাবে সাজাতে চায়৷ এরই মধ্যে চারটি কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে৷ এই চারটির মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনও রয়েছে৷ এই রিপোর্টের যতটুকু এরই মধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা দেশে আগামী দিনের পুলিশ নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ বোধকরি থাকবে না৷ সত্যি কথা বলতে কি, প্রকাশিত এই রিপোর্টে আমি পুলিশ বাহিনীর মৌলিক কোনো পরিবর্তনের প্রস্তাব দেখিনি৷
আসলে পুলিশের মধ্যে কী পরিবর্তন মানুষ আশা করেছিল? সংস্কার কমিশন গঠনের পর তারা সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝতে একটা জরিপ করেছিল৷ প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সে জরিপে তাদের মতামত দিয়েছে৷ এই মতামতদানকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৯ দশমিক ৫ বলেছেন তারা এমন পুলিশ বাহিনী চায়, যারা হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ, আইনের প্রতি অনুগত এবং দুর্নীতিমুক্ত৷ ৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে অপরাধী পুলিশের জবাবদিহিত ও শাস্তি যেন নিশ্চিত হয়৷ ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন—পুলিশ যেন ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করে৷ জরিপে আরও অনেক প্রশ্ন ছিল, আমি এই তিনটি প্রধান বিষয়ই কেবল উল্লেখ করলাম৷ এ থেকেই আসলে বোঝা যায় মানুষ আসলে কেমন পুলিশ বাহিনী দেখতে চায়৷ মানুষের এই প্রত্যাশাগুলো আসলে তাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার আলোকেই যে প্রকাশিত হয়েছে, সেটা বোঝা যায়৷ মানুষ এতদিন দেখেছে, রাজনীতি প্রভাবিত পুলিশ এতদিন কীভাবে দেশজুড়ে বিরোধী রাজনৈতিকদের হয়রানি করেছে৷ দেখেছে সাধারণ মানুষ কীভাবে পুলিশের কাছ থেকে অন্যায়ের প্রতিকার প্রাপ্তির পরিবর্তে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে৷ অনেক সময় দেখা গেছে, মিথ্যা মামলায় ঢুকিয়ে বা ঢোকানোর ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা হয়েছে৷ এরকম অন্যায় প্রতিকার চাইতে গেলেও সাধারণ মানুষকে পড়তে হয়েছে বাড়তি ভোগান্তির মধ্যে৷ পুলিশের নিয়োগেও ছিল রাজনীতির প্রবল প্রভাব৷ বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতাও বিবেচিত হয়েছে পুলিশে চাকরি পাওয়ার অযোগ্যতা হিসাবে৷ সাধারণ মানুষ এসবেরই অবসান চেয়েছে৷
পুলিশ সংস্কারের যে সকল প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে কি মানুষের ওই প্রত্যাশাগুলো পূরণ হবে? অথবা পূরণের কোনো সম্ভাবনা থাকবে? সংস্কার প্রস্তাবগুলো পড়ে আসলে সুস্পষ্ট কোন জবাব পাওয়া যাচ্ছে না৷ আমরা যদি রাজনৈতিক প্রভাবের কথা বলি, সংস্কার প্রস্তাবে সেটা নিরসনের সুস্পষ্ট কোন দিক নির্দেশনা আছে বলে আমার মনে হয়নি৷ সংস্কার প্রস্তাবে অবশ্য ‘প্রভাবমুক্ত' পুলিশ কমিশন গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে৷ তবে সেই পুলিশ কমিশন কার প্রভাবমুক্ত হবে—সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলা হয়নি৷ খসড়া প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ‘স্বাধীন' পুলিশ কমিশনে জাতীয় সংসদের সরকারি দল ও বিরোধী দলের দুজন করে সদস্য থাকবেন৷ এমন প্রস্তাব কি পুলিশকে রাজনীতির বাইরে নিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে? নাকি এর মাধ্যমে আরও বেশি রাজনীতির মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে? সংসদ সদস্য—তা নিয়ে যে দলেরই হোন না কেন, তিনি তো রাজনৈতিক ব্যক্তিই৷ একাধিক দলের সংসদ সদস্যরা যদি পুলিশ কমিশনে থাকেন, তাতে কি পুলিশের মধ্যে রাজনীতি আরও বেড়ে যাবে না? নিয়োগ বদলি পদোন্নতিতে তখন রাজনৈতিক ভাগাভাগির মতো দৃশ্যও দেখতে হতে পারে৷ আর একটি সুপারিশে পুলিশের দুর্নীতি প্রতিকারে একটি ‘সর্বদলীয় কমিটি'র ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করার কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু সর্বদলীয় দলে কারা কী প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হবেন, সে সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই৷
বিগত সরকারের আমলে নানা ধরনের গুম খুনের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর নাম জড়িয়ে গিয়েছিল৷ রাতে বিরাতে মানুষের বাসায় গিয়ে মানুষকে ধরে আনা হতো নানা ঠুনকো অজুহাতে৷ তারপর থেকেই শুরু হতো নানা ধরনের হুমকি-ধামকি, অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টা৷ দাবি অনুযায়ী অর্থ না পেলে ক্রস ফায়ারের নামে চলতো বিচারবহির্ভূত হত্যা৷ কখনো কখনো গুম করে ফেলা হতো৷ এ বিষয়টা দেখলাম সংস্কার সুপারিশে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে৷ বলা হয়েছে আদালতের আদেশ ছাড়া এফআইআর বহির্ভূত আসামিকে গ্রেপ্তার করা যাবে না৷ এই প্রস্তাবটিকে অবশ্যই আমার কাছে ইতিবাচক বলে মনে হয়েছে৷ এরকম আর একটি বিষয়কে বেশ ভালো বলে মনে হয়েছে৷ মাঝে মাঝে দেখা যায়, কোন একটা অভিযোগে কাউকে গ্রেপ্তার করেই পুলিশ বা র্যাব তাকে মিডিয়ার সামনে হাজির করে৷ এটা আসলে অনৈতিক৷ এতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়ে যায়৷ পরবর্তীকালে আদালতে ওই ব্যক্তি নিরপরাধী প্রমাণিত হলেও শুরুর ওই মিডিয়া ট্রায়াল তার সামাজিক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়৷ সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে এ বিষয়টি উঠে এসেছে৷ একটি সুপারিশে বলা হয়েছে, বিচারিক প্রক্রিয়ায় চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমের সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না৷
যে কেউ বলবেন, সুন্দর সুন্দর প্রস্তাব দেওয়া হয়ত খুব একটা কঠিন নয়, বরং কঠিনতম বিষয় হচ্ছে সমাজের প্রতিকূল ব্যবস্থার মধ্যে সেই সুন্দর প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা৷ রাজনীতি যদি ঠিক করা না যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন না হয়, তাহলে পুলিশকে রাজনীতি থেকে বাইরে রাখা অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার৷ যতটা নৈতিক দৃঢ়তা থাকলে পুলিশের একজন নিম্নতম সদস্যও মন্ত্রী-এমপিদের অন্যায় অনুরোধকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে, সেটা কি আমাদের এই সামাজিক বাস্তবতায় সম্ভব? তেমন একজন দৃঢ়চেতা পুলিশকে কি তার প্রশাসন যথাযথ প্রটেকশন দিতে পারবে? না পারলে ভালো ভালো সংস্কার প্রস্তাব হয়ত কেবল খাতা-কলমেই থেকে যাবে৷ অথবা পোশাক পরিবর্তনের মতো কিছু এলোমেলো কাজের মধ্যেই সাফল্য খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করতে হবে৷
প্রাসঙ্গিকভাবে পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি যখন এসেই গেল, সেটা নিয়ে কিছু কথা বলি। এই সব সংস্কার প্রস্তাব যখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে পেশ করা হচ্ছিল, তার পাশাপাশি সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটা উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিলো পুলিশের চরিত্র পরিবর্তনের জন্য। তারা পুলিশ, র্যাব আর আনসারের পোশাক পরিবর্তনের একটা ব্যয়বহুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। পোশাক বলতে কেবল কাপড়ের রং পরিবর্তনের বিষয়টিই আমরা দেখতে পেলাম। পুলিশের পোশাক সরকার সরবরাহ করে থাকে। ফলে প্রায় দুই লাখ পুলিশ, বিপুলসংখ্যক আনসার ও র্যাবের জন্য এবার নতুন করে পোশাক পরিবর্তন করতে হবে। এই খাতে ব্যয় কত হবে? তিন উপদেষ্টা বসে যে বিফ্রিংয়ে নতুন পোশাকের কথা জানালেন, সেখানে কিন্তু ব্যয়ের কথা কিছু বলা হলো না। আচ্ছা, পোশাক পাল্টে গেলে কি চরিত্রও পাল্টে যায়? মানুষের স্বভাব বদলানো যদি এতই সহজ হয়, তাহলে সকল দাগি চোর ডাকাতকে পাঞ্জাবি-পাজামা, আলখাল্লা আর টুপি পরিয়ে দিলেই হয়।
গোঁজামিল আর কাকে বলে!