পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ও ২৬ হাজার চাকরি বাতিলের প্রতিক্রিয়া
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২৬ হাজার চাকরি বাতিল হওয়ার পর রাজ্য সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন চাকরিহারা শিক্ষক, রাজনীতির ময়দানের বিরোধী থেকে শুরু করে অনেকেই। দেখুন ছবিঘরে ....
কী বলেছে সুপ্রিম কোর্ট?
পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগ মামলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ভয়ংকর দুর্নীতি ও জালিয়াতি হয়েছে। জালিয়াতি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টায় পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া কলুষিত হয়েছে। বৃহত্তর পরিসরে দুর্নীতি হয়েছে। যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করা যাচ্ছে না। তাই পুরো প্যানেল বাতিল হবে। অযোগ্য বলে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিতদের বেতন ফেরত দিতে হবে। তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
এই চাকরি নিয়ে
শিক্ষকদের এই চাকরি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। চাকরির পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া করেছে সরকারি সংস্থা স্কুল সার্ভিস কমিশন বা এসএসসি। সরকারি স্কুলের জন্য এই নিয়োগ হয়। সেখানে দুর্নীতি হলে সেই দায় স্বভাবতই রাজ্য সরকারের উপরই এসে পড়ে বলে দাবি করছেন চাকরিহারা শিক্ষক থেকে বিরোধী সকলেই। বিরোধীরা দাবি তুলেছেন, এর দায় মুখ্যমন্ত্রীকে নিতে হবে।
কান্নায় ভেঙে পড়লেন তারা
সুপ্রিম কোর্টের রায় আসার আগে শহিদ মিনারের পাশে জড়ো হন শিক্ষকরা। উদ্বিগ্ন শিক্ষকরা সুপ্রিম কোর্টের রায় জানার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের যাবতীয় ক্ষোভ গিয়ে পড়ে রাজ্য সরকারের উপর। তাদের প্রশ্ন, কিছু মানুষ দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছে বলে তাদের সকলের চাকরি গেল। এটা তারা মেনে নিতে পারছেন না।
'দুর্নীতি না করে শাস্তি পেলাম'
শাহনি নাজনিন ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''কোনো অন্য়ায় না করে, দুর্নীতি না করে শাস্তি পেলাম। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। দোষ প্রমাণ করুক। মাথা পেতে নেবো। এ কেমন বিচার না অন্য কিছু জানি না। কী করবো জানি না। মনে হচ্ছে, শেষ হয়ে গেছি। মানতে পারছি না। ছোট থেকে সততার সঙ্গে বড় হয়েছি। তার এই পরিণাম। চাকরি অর্জন করেছি, কাউকে ঘুষ দিইনি। তারপর এরকম হলো?''
'চাকরির পরীক্ষা দুর্নীতিমুক্ত করার দায় কার?'
ডিডাব্লিউকে রজত হালদার বলেছেন, ''আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যোগ্যদের জন্য চরমতম বিপর্যয়। আগামীতে যারা মেধার জোরে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেবেন, তারা ভাবুন। পরীক্ষা পদ্ধতির গলদ থাকলে ছয় বছর পর চাকরি যাবে। প্রশ্ন হলো, পরীক্ষা পদ্ধতি দুর্নীতিমুক্ত করার দায়িত্ব কার, পরীক্ষার্থীদের, সরকারের নাকি বিচারব্যবস্থার?''
'নিয়োগকারী সংস্থার শাস্তি হওয়া উচিত ছিল'
ডিডাব্লিউর কাছে রিজিয়া খাতুনের প্রতিক্রিয়া, ''আমি ভাবতে পারছি না, এরকম হওয়া সম্ভব! কী করে বিনা দোষে কেউ এরকম শাস্তি পেতে পারে। কী করবো, তা এখনই বলতে পারছি না। আমাদের আশা ছিল, আমাদের জয় হবে। কোনো দুর্নীতি হলে নিয়োগকারী সংস্থার শাস্তি হওয়া উচিত, আমাদের সেই শাস্তি পেতে হবে?''
স্কুল ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে?
কোনো স্কুলে চারজন, কোনো স্কুলে আটজন, কোনো স্কুলে ছয়জন শিক্ষকের চাকরি গেলো। বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকারা জানিয়েছেন, তাদের স্কুল চালানো মুশকিল হবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রশ্ন উঠছে, যোগ্য শিক্ষকরা যে অসম্ভব মানসিক চাপের মধ্যে পড়বেন, সকলে তাদের দিকে সন্দেহের চোখে দেখবেন, সেই ক্ষতি কে পূরণ করবে?
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ''বিচারব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ সম্মান আছে। তা সত্ত্বেও রায় মানতে পারছি না। একজনের অপরাধে কতজনের শাস্তি হবে? স্কুল সার্ভিস কমিশন স্বশাসিত সংস্থা। আমরা কখনো হস্তক্ষেপ করি না। আর কতদিন বাংলাকে টার্গেট করবেন? কোর্টের রায় মেনে এসএসসি ততিন মাসের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করবে। আরো এক লাখ শিক্ষকের নিয়োগ দেবো। এটা বিজেপি, সিপিএম করিয়েছে।''
মমতার প্রস্তাব
মমতা বন্দ্যোাপাধ্যায় বলেছেন, ''যারা চাকরি হারিয়েছেন, তারা একটা সংগঠন তৈরি করেছেন। তারা নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম বুক করেছেন। আমরা সাত তারিখ তাদের সম্মেলনে সেখানে যাবো। মুখ্যসচিব ও অন্য জ্ঞানী-গুণীরা যাবেন। আপনারা সকলে আবেদন করুন। আমরা চেষ্টা করবো। ধৈর্য ধরুন। এবার গরম বেশি বলে ৩০ এপ্রিল থেকে স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে যাবে।''
মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি কংগ্রেসের
প্রদেশ কংগ্রেস প্রধান শুভঙ্কর সরকার দাবি করেছেন, এই দুর্নীতির দায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে হবে। কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেছেন, শিক্ষায় দুর্নীতি হয়েছে তাই নয়, সেটা ধামাচাপা দিতে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে জনগণের টাকা করচ করা হয়েছে। কেন এইভাবে জনগণের টাকা নয়ছয় করবে সরকার?
বিজেপি বলছে, তৃণমূল দায়ী
রাজ্য বিজেপি সবাপতি সুকান্ত মজদুমদার বলেছেন, ''মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্কুল সার্ভিস কমিশন, রাজ্য সরকার কেন যোগ্য ও অযোগ্যদের পৃথকীকরণ করে দিল না? রাজ্য সরকার পৃথকীকরণ করে দিলে এতজনের চাকরি চলে যেত না। শুধুমাত্র অযোগ্যদের চাকরি চলে যেত।” বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ''এই ঘটনার জন্য দায়ী তৃণমূল। যোগ্যরা এদের পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য চাকরি হারালো। গোটা স্কুল শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়লো।''
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী যা বললেন
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ''সরকার এতদিন পরেও বলতে পারলো না, কতজন অযোগ্য। সরকার দাঁড়ালো অযোগ্যদের পাশে। সরকারের অপদার্থতার জন্য এটা হয়েছে। সরকার অযোগ্যদের বাদ দিলো না বলে, সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের মুখ পুড়লো।'' সিপিএম নেতা ও আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, ''দুর্নীতি করেছে সরকার। তাদের এই দায় নিতে হবে।'' মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন, মামলা করার আগে ভাবলেন না, কে যোগ্য কে অযোগ্য।
শুক্রবার আবার শুনানি হতে পারে
শুক্রবার নিয়োগ দুর্নীাতি নিয়ে আবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানি আছে। রাজ্য সরকার বাড়তি পদ তৈরি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্ট তা নিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় এর উপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। সেই বিষয়ে শুক্রবার শুনানি হতে পারে।