পশ্চিমবঙ্গে ফিরছে ডেঙ্গু ও অস্বীকারের রাজনীতি
১ আগস্ট ২০২৩প্রতি বছর বর্ষার মৌসমে দোসর ডেঙ্গু। জুলাই থেকে পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। জমা জল ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সম্পর্কে প্রচার শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু ডেঙ্গুর দাপট এবারও অব্যাহত।
ডেঙ্গু ঘিরে তরজা
রোগের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়েছে। সোমবার বিধানসভায় ডেঙ্গু নিয়ে শাসক ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে বাদানুবাদ হয়।
ডেঙ্গু নিয়ে বিধানসভায় বিরোধীরা মুলতবি প্রস্তাব আনে। মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেছিল তারা। অধ্যক্ষ সেই দাবি না মানায় বিক্ষোভ দেখান বিজেপি বিধায়করা। বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে বিক্ষোভ দেখানো হয়। প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে বিলি করা হয় মশারি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় বলেছেন, ‘‘২৬ জুলাই পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ৪ হাজার ৪০১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মৃত্যু হয়েছে আট জনের।" মৃতের সংখ্যা শুনে প্রতিবাদ জানান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তার বক্তব্য, "ডেঙ্গুতে কয়েকশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অথচ রাজ্য সরকার তথ্য গোপন করার চেষ্টা করছে।"
শুভেন্দুর অভিযোগ, "হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা পর্যাপ্ত সংখ্যায় হচ্ছে না। পরীক্ষা হলে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি হবে। হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট পর্যন্ত নেই।" মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, গত সপ্তাহে ২৩ হাজার ৮৩২টি পরীক্ষা হয়েছে। পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনে দেরি হওয়াকেও কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন তিনি।
আজ ডেঙ্গু নিয়ে টুইট করেছেন শুভেন্দু। তৃণমূল বিধায়ক ও বিধানসভায় শাসকপক্ষের উপ মুখ্য সচেতক তাপস রায়ের দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সঠিক তথ্যই দিচ্ছেন। বিরোধী দলনেতার কাছে অন্য তথ্য থাকলে তার ব্যাখ্যা উনিই দিতে পারবেন।’’
অস্বীকারের 'রাজনীতি'
এর আগে কোভিড অতিমারির সময় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা গোপন করার অভিযোগ উঠেছিল।সরকারি তথ্যে সংশোধনী এনে মৃতের সংখ্যা কমানোও হয়েছিল তখন৷
চিকিৎসকদের অসুখের ভিন্ন কারণ লিখতে বাধ্য করা হচ্ছে, এমন দাবিতেও তুমুল বিতর্ক হয় তখন।
প্রশ্ন উঠছে, অসুখ নিয়ে এই চাপানউতোর ও অস্বীকারের 'রাজনীতি' কি বছরের পর বছর চলতে থাকবে?
অতীতে এক চিকিৎসক এ নিয়ে বিস্ফোরক দাবি করেছিলেন। ডা. অরুণাচল দত্ত চৌধুরীকে তার জেরে সাসপেন্ড হতে হয়েছিল। ২০১৭ সালে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, ‘‘এ রাজ্যে ডেঙ্গু হওয়া বারণ... ভীত কেন্নোর মতো সন্ত্রস্ত এই আমি অভাগার ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লিখছি— ফিভার উইথ থ্রম্বোসাইটোপিনিয়া!’’
ডেঙ্গু হলেও রোগের নামের স্থানে অনেক ক্ষেত্রে 'অজানা জ্বর’ও লেখা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুবর্ণ গোস্বামী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রোগ ধামাচাপা দিয়ে লাভ নেই। কোথায় কত মৃত্যু, কত আক্রান্ত, এ সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান না পেলে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা সচেতনতা গড়ে তোলা যায় না।’’
ডা. দত্ত চৌধুরী সম্পর্কে তিনি বলেন, "ওর মতো কর্মনিষ্ঠ চিকিৎসককে যেভাবে হেনস্থা করা হয়েছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। এতে চিকিৎসক সমাজে হতাশা তৈরি হয়, কাজের উৎসাহ হারিয়ে যায়।’’
মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টার-এর সম্পাদক ডা. অংশুমান মিত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অনেক কিছু লিখতে বাধ্য করা হচ্ছে ডাক্তারদের। কেউ দ্বন্দ্বে যেতে চাইছেন না। ব্যক্তিগতভাবে কারো পক্ষে সংঘাতে যাওয়া সম্ভব নয়।’’
বাংলাদেশের নজর
বিশ্বের ১৩০টি দেশে মানুষের ডেঙ্গু হচ্ছে। ভারতের লাদাখ ও নাগাল্যান্ড বাদে সব রাজ্যে আক্রান্তের খোঁজ মিলেছে। ওপার বাংলা থেকে কেউ এদেশে এলে ডেঙ্গু পরীক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী অতীতের সুরে বলেছেন, "বাংলাদেশ থেকে এখানে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। এভাবে রোগ ছড়িয়ে পড়লে কী করা যায়? কাউকে তো ঢুকতে বারণ করতে পারি না।"
কলকাতা পুরসভাও বাংলাদেশিদের রক্ত পরীক্ষার আবেদন জানিয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তরের কাছে। এ প্রসঙ্গে কলকাতার সাবেক মেয়র, বাম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা শহরের ডেঙ্গু মানচিত্র তৈরি করে মশার জন্ম রোধের ব্যবস্থা করেছিলাম। তৃণমূল বোর্ডের তেমন পরিকল্পনা নেই। তাই বাংলাদেশকে টেনে মূর্খের মতো কথা বলছেন।"
প্রকৃত তথ্যের গুরুত্ব
রোগ সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য সামনে এলে মানুষকে রক্ষা করা সহজ হবে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। ডা. গোস্বামীর বক্তব্য, "রোগের প্রাদুর্ভাবের সঠিক ছবি তুলে ধরলে একাংশের মানুষজন ভয় পাবে। তারা সচেতন হবে। তাই এমন ব্যবস্থা থাকা দরকার যার মাধ্যমে শাসক, বিরোধী থেকে সব নাগরিক রোগ সংক্রান্ত একই সংখ্যা জানতে পারবেন।"
ডা. মিত্রের মতে, "ধামাচাপা দেয়ার ফলে প্রতি বছর সমস্যা বাড়ছে। এখানে যা দেখছেন, কোভিডের ক্ষেত্রে দিল্লির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠেছিল। সারা বছর নজরদারি নেই, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী নেই, ডেঙ্গু কীভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকবে?"