পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক কলেজে ধর্ষণ: রাজনীতির দায় কতটা?
২৯ জুন ২০২৫দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজের এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে এখানকার এক সাবেক ছাত্র ও নির্যাতিতার দুই সহপাঠীর বিরুদ্ধে। ১০ মাস আগে আরজি কর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের নিরাপত্তা নিয়ে তখন প্রশ্ন উঠেছিল। সরকার পোষিত আইন কলেজের ঘটনায় সেই প্রশ্ন আবার উঠছে। একইসঙ্গে উদ্বেগের বিষয়, কোনো দুষ্কৃতী নয়, সহপাঠীররাই অভিযুক্ত এমন কুকর্মে। তাও আবার কলেজের মধ্যেই।
ধৃতদের পুলিশি জেরা
নির্যাতিত ছাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার হওয়া ওই কলেজের সাবেক ছাত্র ও অস্থায়ী কর্মী মনোজিৎ মিশ্রকে কসবা থানার পুলিশ টানা জেরা করছে। নির্যাতিতার দুই সহপাঠী প্রমিত মুখোপাধ্যায় ও জাহিব আহমেদকে একইসঙ্গে জেরা করা হচ্ছে।
এই ঘটনায় এ নিয়ে মোট চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কলেজের নিরাপত্তারক্ষী পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়কে আটক করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ছাত্রী তার অভিযোগে জানিয়েছেন, কলেজের গার্ডরুমে তাকে ধর্ষণ করা হয়। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, সেই সময়ে গার্ড বা নিরাপত্তারক্ষী কোথায় ছিলেন! সন্ধে সাতটা থেকে রাত দশটা অবধি যে ঘটনা ঘটল, সেটা কী করে রক্ষীর নজরে এড়িয়ে গেল?
ঘটনার দিনে সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত আর কেউ কলেজে ছিলেন কি না, সেটা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। ছাত্রীর অভিযোগ, গার্ডরুমের ভিতরে তার ছবি মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করা হয়েছিল। সেই ছবি ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল মনোজিৎ। প্রশ্ন উঠেছে, এই ভিডিও কি সে নিজেই করেছিল নাকি প্রমিত বা জাহিবের মধ্যে কেউ? পুলিশ সূত্রের খবর, দেড় মিনিটের একটি ভিডিও ক্লিপ এক অভিযুক্তের মোবাইলে পাওয়া গিয়েছে। তবে ডয়চে ভেলে এই তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।
গ্রেপ্তার হওয়াদের বাইরে আর কেউ এ ঘটনায় জড়িত ছিল কিনা, সেটা তিন অভিযুক্তের জিজ্ঞাসাবাদে জানার আশা করছে পুলিশ। বিকেল চারটের পরে সন্ধে পর্যন্ত আরো কয়েকজন পড়ুয়া কলেজের ইউনিয়ন রুমে ছিলেন। তারা এই ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানতেন কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে পুলিশের বড় হাতিয়ার হতে পারে সিসিটিভি ফুটেজ। প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টার ফুটেজ পুলিশের হাতে এসেছে। এটা দেখে পুলিশ অভিযুক্ত ও অভিযোগকারিণীর গতিবিধি বুঝতে পারবে।
এই ঘটনাকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। শনিবার বিজেপি গড়িয়াহাট মোড় অবরুদ্ধ করে দিলে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে। রোববার সকালে লালবাজার থেকে ছাড়া পান। আগামীকাল সোমবার বিজেপি থানা ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছে।
রোববার দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজে যান জাতীয় নারী কমিশনের প্রতিনিধিরা। এই দলের সদস্য অর্চনা মজুমদার সংবাদ মাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, "পুলিশ সঠিকভাবে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাধা সৃষ্টি করেছে। ঘটনাস্থলে ভিডিওগ্রাফি করতে বাধা দেয়। যদিও কমিশনের ক্ষমতা অনুযায়ী ভিডিও করা যেতে পারে।"
রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য পাল্টা সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, "পশ্চিমবঙ্গে বারবার জাতীয় নারী কমিশন আসে। কিন্তু বিজেপি শাসিত রাজ্যে যায় না। মণিপুরের ঘটনা বছর পার করে গেলেও যায় না। কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করুক।"
মনোজিতের দাপট
শুক্রবার গণধর্ষণের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরেই মনোজিতের প্রভাব-প্রতিপত্তির নানা কাহিনি শোনা যাচ্ছে। এই কলেজের সাবেক পড়ুয়া হলেও তার দাপট কমেনি। আদালতে সে প্র্যাকটিস করে, কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। এজন্য এই প্রতিষ্ঠানে তার যাতায়াত ছিল।
সাবেক পড়ুয়া মনোজিৎ ছাত্রনেতা হিসেবেই পরিচিত। ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি নিজেকে তৃণমূলের পদাধিকারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তার এই ফেসবুক প্রোফাইল সত্যি না ভুয়ো, সেটা যাচাই করেনি ডিডাব্লিউ। এই ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের শাসানি দেয়া ও মারধরের অভিযোগ উঠেছিল। আরজি কর নিয়ে যখন কলকাতা উত্তাল, সেই সময়ে রাত দখলের আন্দোলনে এই আইন কলেজের ছাত্রছাত্রীরা যোগ দিয়েছিলেন। অভিযোগ, যারা এই রাত দখলের আন্দোলনে যোগ দেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল মনোজিতের নেতৃত্বে। সেই পড়ুয়াদের শাসানো হয়েছিল।
আরজি করে চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ করে খুন করেছিল হাসপাতালে নিরাপত্তায় থাকা এক সিভিক ভলান্টিয়ার। সিবিআই চার্জশিটের ভিত্তিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত। এরপরে মেডিকেল কলেজকে ঘিরে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। মনোজিত গ্রেপ্তার হওয়ার পরে তার সম্পর্কেও নানা কথা সামনে আসছে।
পড়ুয়াদের কেউই এ নিয়ে মুখ খুলছেন না। প্রথম বর্ষের এক পড়ুয়া বলেন, মনোজিতের ভয়ে অনেকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারতেন না। শুধু ছাত্র-ছাত্রীরা নন, কলেজের এই অস্থায়ী কর্মীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারতেন না শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। কলেজের অধ্যক্ষ নয়না চট্টোপাধ্যায় সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, "কলেজের কোনো অপরাধমূলক কাজ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ঘটনা কলেজের কাজকর্ম শেষ হওয়ার পরে ঘটেছে। আমরা এ ব্যাপারে রিপোর্ট দেবো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে।"
নির্যাতিতা পড়ুয়া আইন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। প্রমিত ও জাহিব তার সহপাঠী। নিজের কলেজের মধ্যে সহপাঠীদের সঙ্গে যথেষ্ট নিরাপত্তা বোধ করা উচিত কোনো ছাত্রীর। কিন্তু সেই সহপাঠীরাই জঘন্য একটি অপরাধে জড়িয়ে পড়ল, এটাই সবাইকে স্তম্ভিত করে দিচ্ছে।
আর জি করের চিকিৎসক পড়ুয়ার সঙ্গে ধর্ষকের পরিচিতি বা যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু সাবেক ছাত্র মনোজিৎ বা দুই সহপাঠী নির্যাতিতা তরুণী পরিচিত ছিল। তাদের দ্বারাই এভাবে আক্রান্ত হওয়া কতটা সামাজিক অবক্ষয়কে চিহ্নিত করছে?
সমাজকর্মী ও কলকাতার সিটি কলেজের অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা যতই নারী ও পুরুষের সমতার কথা বলি না কেন, তার আড়ালেই একটা টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বিরাজ করছে। নিজেদের পৌরুষ প্রমাণের জন্য ইউনিয়নের দাদা হয় এবং মেয়েদের নির্যাতন ও ধর্ষণ করে। এটা তৃণমূলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। একই বিষয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর ক্ষেত্রে দেখেছিলাম। তাকেও নির্যাতন করা হয়েছিল একই মানসিকতা থেকে। একজন পুরুষের অন্য জায়গায় যত অনিশ্চয়তা বাড়ে, তত তার পৌরুষ প্রমাণের ঝোঁক বাড়ে।"
তিনি মনে করেন, "ইউনিয়নের নির্বাচন না হওয়ার ফলে নতুন মুখ উঠে আসছে না। দীর্ঘ মেয়াদে এই মনোজিতের মতো মানুষেরা নেতা থেকে যাচ্ছে। এই ধরনের ঘটনাকে উৎসাহিত করছে ইউনিয়ন নির্বাচন না হওয়া।"
রাজনীতির দায়
অভিযোগ ওঠার পরে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ মনোজিতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করেছে। ছাত্র সংগঠনের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছেন, মূল অভিযুক্ত তাদের সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়।
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেন, "পুলিশ অভিযোগ পাওয়া মাত্র তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। কোনো অপরাধীকে ছাড়া হবে না।" শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এই ঘটনায় মর্মাহত বলে রিপোর্ট তলব করেছেন।
তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "সহপাঠীরাই কীভাবে এই কাণ্ড ঘটাল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে। এটা নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের অপরাধ। এসব অভিযোগ ওঠা দলের পক্ষে ভালো নয়।"
তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, "ওই ছাত্রী কেন একা গার্ড রুমে গেলেন। সঙ্গে দুই-একজন বন্ধুকে নিয়ে যেতে পারতেন।"
সাংসদ ও বিধায়কের বক্তব্যের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস একমত নয়, এ কথা জানিয়ে দলের পক্ষ থেকে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে। শোকজ করা হয়েছে মদন মিত্রকে।
প্রশ্ন উঠছে, একটি কলেজে কোনো সাবেক ছাত্র, যে নিজেকে শাসক দলের পদাধিকারী হিসেবে দাবি করে, তার এত দাপট কীভাবে চলতে পারে? কীভাবে এরা কার্যত একটি ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে?
আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম মুখ ও জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট-এর নেতা অনিকেত মাহাতো বলেন, "এই ঘটনার পিছনে যারা আছে, তাদের প্রত্যেককে শাস্তি দিতে হবে। কাউকে আড়াল করা চলবে না। সেটা না হলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা যাবে না।"
অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস সংগঠনের নেতা, সিনিয়র চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "দুর্নীতি ঘটনা ঘটার পরে বেরিয়ে আসছে তা নয়। দুর্নীতি ছিলই, যারা দুর্নীতির ভুক্তভোগী তারা এসব জানেন। আরজি করের ক্ষেত্রে আমরা যারা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তারা জানতাম যে কী অনাচার সেখানে চলছে। তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যারা যুক্ত আছেন, তারাও জানেন যে, কোন দুর্নীতি, কোন অত্যাচার মানুষের উপরে চলছে। আইন কলেজেও আমার ধারণা সেরকমই ঘটনা ঘটেছে। এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি একটা অপরাধচক্রকে তৈরি করে ও প্রশ্রয় দেয়। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি মানে যেখানে রাজনৈতিক দল এবং প্রশাসন তাদের প্রত্যক্ষভাবে মদত দেয়। এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, "এর সঙ্গে দুর্নীতির বিষয় যুক্ত আছে, নইলে কেন আইন পাশ করা একজন তরুণ যিনি আদালতে প্র্যাকটিস করেন, তিনি নিজের যোগ্যতার তুলনায় অনেক নীচুমানের কাজ কলেজে করেন? কেন গভর্নিং বডি তাকে ৪৫ দিন করে প্রতিবার এই অস্থায়ী কর্মীর পদে নিয়োগ দেন? প্রধান অভিযুক্ত এতই দাপুটে যে কলেজের দেয়ালে লেখা রয়েছে, মনোজিৎ দাদা ইন আওয়ার হার্ট। ফলে তার পরাক্রম এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কলেজের তৃণমূল সমর্থক পড়ুয়ারা আক্রান্ত হচ্ছে। এজন্য প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা দায়ী। যদি কঠোর হাতে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা হত, তাহলে অবক্ষয় এখানে ঢোকার সুযোগ পেত না।"
তিনি বলেন, "মনোজিতের মতো অপরাধীরা জানে যে, তারা কোনো অন্যায় করলে তাদের কিছু হবে না। তাই নিরাপত্তারক্ষীকে গার্ডরুম থেকে তুড়ি মেরে তারা বার করে দিতে পারে। ঘন্টার পর ঘন্টা একটা অপরাধ ঘটিয়ে যেতে পারে কলেজের ভিতরে। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তারক্ষীর কিছু করার থাকে না। এটা সমাজের অবক্ষয় নয়, এটা নেতার দাপট, নেতার দুর্নীতি এবং নেতার অবক্ষয়।"
শাশ্বতী বলেন, "২০১২ সালে আসানসোলে নজরুল সেন্টেনারি পলিটেকনিক কলেজে ইউনিয়ন রুমে একইভাবে প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল। তাদের শাস্তি হয়েছে? এনসিআরবি-র তথ্য দেখাচ্ছে, আমাদের রাজ্য ধর্ষণের শাস্তি দেয়ার হারে সবচেয়ে নীচে। এগুলো কি পুরো ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না?"