পশ্চিমবঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এত ড্রপআউট কেন?
৫ মার্চ ২০২৫৩ মার্চ শুরু হয়েছে এ বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। এ বছর মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা পাঁচ লক্ষের কিছু বেশি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল আট লক্ষের কাছাকাছি। এক বছরের তফাতে অনেকটাই কমেছে পরীক্ষার্থী।
কমছে পরীক্ষার্থী
চলতি বছরে শুধু নয়, গত কয়েক বছরে পরীক্ষার্থী কমে যাওয়ার ধারাবাহিক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একাদশ শ্রেণিতে যারা রেজিস্ট্রেশন করাচ্ছে, তাদের অনেকেই পরীক্ষায় বসছে না।
২০২৩ সালে একাদশে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ৫,৫৩,৭৯০ জন পড়ুয়া। কিন্তু এ বছর উচ্চমাধ্যমিকে বসছে ৫,০৮,৪০২ জন। অর্থাৎ যারা একাদশে ভর্তি হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৪৫,৩৮৮ জন পড়া শেষ করল না।
২০২৪ সালের ছবিটা ছিল খুবই উদ্বেগের। ২০২২ সালে একাদশে নাম নথিভুক্ত করেছিল ৯,১৩,৫৩৫ জন। ২০২৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এসেছিল ৭,৮৯,৯৪১ জন ছাত্রছাত্রী। পড়া শেষ করেনি ১,২৩,৫৯৪ জন পড়ুয়া।
এই সংখ্যা কোভিড অতিমারীর সময় একেবারে শীর্ষে উঠেছিল। ২০২১ সালে একাদশে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১০,৫০, ৭৬২ জন ছাত্রছাত্রী। ২০২৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার জন্য ৮,১৮,৮১২ জন নাম নথিভুক্ত করে। অর্থাৎ এদের মধ্যে ১,৯৭,৬৩৯ জন পড়ুয়া দ্বাদশের পড়াশোনা শেষ করেনি।
গত দুই বছরের তুলনায় এবার অবশ্য ড্রপআউট হয়ে যাওয়া পড়ুয়ার সংখ্যা কমেছে। যদিও ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দ্বিগুণের বেশি পরীক্ষার্থী নাম নথিভুক্ত করেছিল একাদশ শ্রেণিতে। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়তে আসা পড়ুয়াদের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।
প্রকৃত সংখ্যা
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার জন্য যাদের অ্যাডমিট কার্ড দেয়া হয়, তাদের সকলেই আবার পরীক্ষায় বসে না। সেই হিসেবে প্রকৃত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা আরো কম। যদিও সেটা পরীক্ষা চলাকালীন নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু বিভিন্ন জেলা থেকে খবর মিলছে, যারা অ্যাডমিট কার্ড পেয়েছে, তাদের সকলে পরীক্ষায় বসছে না।
নদিয়া জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক সূত্র জানাচ্ছে, প্রথম দিনে ওই জেলায় ৬২৬ জন পরীক্ষার্থী বাংলা পরীক্ষায় গরহাজির ছিল। আবার উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলায় এই পরীক্ষা দিতে আসেনি ৭১৭ জন। এই হিসেবে দ্বাদশে যাদের পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল, তারাও পরীক্ষায় বসেনি। অর্থাৎ ড্রপআউট-এর সংখ্যা আরো বেড়েছে।
কেন এই অবস্থা?
অ্যাডভান্স সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেস-এর রাজ্য সাধারণ সম্পাদক চন্দন মাইতি ডিডাব্লিউকে বলেন, "মাধ্যমিকেও এই প্রবণতা দেখা গিয়েছে। কোনো কোনো জেলায় তা খুবই বেশি। ক্লাস নাইনে কোচবিহারে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ৪৫ হাজার পড়ুয়া, ক্লাস টেনে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে মাত্র ৯ হাজার। আলিপুরদুয়ারে ১৩ হাজারের মতো রেজিস্ট্রেশন করেছিল, পরীক্ষা দিয়েছে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার।"
পড়ুয়াদের ড্রপ আউট বাড়তে থাকায় সব স্তরে উদ্বেগ। অথচ রাজ্য সরকার একের পর এক শিক্ষামুখি প্রকল্প চালু করেছে, যার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে এই ছাত্রছাত্রীরা। ট্যাব বাবদ ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয় একাদশের পড়ুয়াদের। ছাত্রী হলে কন্যাশ্রী বাবদ ২৫ হাজার টাকা মেলে মাথাপিছু। এছাড়া স্কুলস্তরে সবুজ সাথীর সাইকেল মেলে। ঐক্যশ্রী, শিক্ষাশ্রী প্রকল্পও চলছে। এতগুলি প্রকল্পের উপভোক্তার সংখ্যা বিপুল। রাজ্য সরকার এই প্রকল্পগুলির জন্য প্রচুর টাকা খরচও করছে। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা পড়া ছেড়ে দিচ্ছে কেন?
চন্দন বলেন, "একটা বড় অংশের পড়ুয়া বেকারত্বের কারণে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে যাচ্ছে। শিশুশ্রম ও নাবালিকা বিয়ে বাড়ছে। স্কুলগুলিতে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ নেই দীর্ঘদিন। তাই স্কুলে স্কুলে ছাত্র কমছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ুয়া নেই। কন্যাশ্রী-সহ অনেক সরকারি প্রকল্প দিয়েও এই ড্রপআউট ঠেকানো যাচ্ছে না। কেন এই ড্রপআউট হচ্ছে সেটা নিয়ে কমিশন গঠন করে সুলুক সন্ধান করা জরুরি।"
শিক্ষা সংসদের বক্তব্য
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ এটাকে বিপুল ড্রপআউট বলে স্বীকার করছে না। সংসদের সভাপতি চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য বলেন, "মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বহু পড়ুয়াই অন্য কোর্সে চলে যায়। একাদশ শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করে নেয় অনেকে ৷ কিন্তু, পরে আবার অনেকেই ডিপ্লোমা করার দিকে চলে যায়। অনেকে বিভিন্ন চাকরিতে যোগ দেয়৷ তাই উচ্চমাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। তবে মাত্র ১০ শতাংশ মতো ড্রপআউট৷ এটাকে ড্রপআউট বলা ঠিক নয়। অনেকে আবার এক বছর ড্রপ করে পরের বছর ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেয়৷ সেই সংখ্যাটা অবশ্য খুবই সামান্য।"
পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা দেশেই কর্মসংস্থানের হাল ভালো নয়। এর ফলে অনেকে প্রথাগত শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ হারাচ্ছে, উচ্চশিক্ষায় যেতে চাইছে না বলে অনেকের মত।
চাকরির সুযোগ কম বলে?
সেভ এডুকেশন কমিটি-র সম্পাদক, অধ্যাপক তরুণ নস্কর ডিডাব্লিউকে বলেন, "পড়াশোনার একটা উদ্দেশ্য চাকরি পাওয়া বা কাজ পাওয়া। এদিকটা একদমই অন্ধকার। উচ্চমাধ্যমিকের পর কলেজে এখন চার বছরের ডিগ্রি কোর্স, আগে যেটা তিন বছর ছিল। ফলে সেদিকে এক বছর বাড়তি পড়তে হবে। তারপরেও কাজের নিশ্চয়তা নেই। তাই উচ্চমাধ্যমিকে ট্যাবের টাকা পাওয়ার পরেই ছেলেমেয়েরা ড্রপআউট হয়ে যাচ্ছে। কোথাও পরিযায়ী শ্রমিক বা ডেইলি লেবার হয়ে যাচ্ছে। কখনো বৃত্তিমুখী শিক্ষার দিকে তারা চলে যাচ্ছে। ট্যাবের টাকা না থাকলে এই ড্রপ আউট মাধ্যমিকেই হয়ে যেত।"
গ্রাম ও শহর নির্বিশেষে অনেক স্কুল পড়ুয়ার সংকটে ভুগছে। কোথাও পড়ুয়া থাকলে শিক্ষকের সংখ্যা কম, কোথাও আবার শিক্ষক থাকলে ছাত্রছাত্রী নেই। বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও ক্রমশ কমছে।
অভিযোগ, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের নতুন ও আধুনিক বিষয় পড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হলেও এই বিষয়গুলি পড়ানোর জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ করা হচ্ছে না। রেজিস্ট্রেশন ফি, পরীক্ষার ফি এবং জরিমানা বাবদ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ কয়েকগুণ টাকা বাড়িয়ে নিয়েছে। এর ফলে সংকট বাড়ছে।
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটা যথেষ্ট উদ্বেগের যে পশ্চিমবাংলায় লেখাপড়ায় ছেলেমেয়ের আগ্রহী হচ্ছে না। এই সরকারের আমলে অনেকগুলো স্কুল বন্ধ হয়ে আছে, সংখ্যাটা প্রায় ৮ হাজারের মতো। অনেক স্কুলে বিজ্ঞানের ক্লাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে এমনিতেই ছাত্র সংখ্যা কমেছে, পরীক্ষার্থীও কমেছে।"
তিনি বলেন, "হয়তো ছাত্রদের মনে এরকম একটা চিন্তা আসছে যে, কী হবে লেখাপড়া শিখে। চাকরি হবে না, চাকরি পেতে গেলে টাকা দিতে হবে। প্রাথমিকভাবে এটাই মনে হচ্ছে। এই হতাশার ছবি দেখে একজন শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে আমার খুবই খারাপ লাগছে।"
জনজীবনে আর্থিক সংকট গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের নাবালক সদস্যের উপরও তার প্রভাব পড়ছে। সরকারি অনুদান সেই সংকট কি পুরোপুরি কাটাতে পারছে না, যাতে ছেলেমেয়েরা নিশ্চিন্তে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে?
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের বিভাগীয় প্রধান সুহৃতা সাহা ডিডাব্লিউকে বলেন, "প্রকল্প দিয়ে এই ছবি পাল্টানো যাবে না। শিক্ষার পরিকাঠামোর মূলে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি বিদ্যালয়ের তুলনায় প্রাইভেট স্কুলে ছাত্র ভর্তির ঝোঁক রয়েছে সার্বিকভাবে। তাছাড়া শিক্ষা ব্যবসা নয় যে, এক্ষুনি রিটার্ন পাওয়া যাবে। কোনো দিনই তা হয় না। কিছু ক্ষেত্রে রিটার্নের কথা না ভেবেই রাষ্ট্রের বিনিয়োগ করা উচিত। আমাদের দেশে সেটা হচ্ছে না।"