পঠনপাঠন চালু রাখতে স্বস্তি চাকরিহারাদের একাংশের
১৭ এপ্রিল ২০২৫এসএসসি দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে গিয়েছিল। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে পঠনপাঠন চালানোর ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হয়। বৃহস্পতিবার শীর্ষ আদালতের নির্দেশে সেই সঙ্কট কিছুটা কাটতে চলেছে।
সুপ্রিম শুনানি
২০১৬ সালে এসএসসি-র গোটা প্যানেল সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দেয়।
এই রায়ে যাদের চাকরি গিয়েছিল, তার মধ্যে ১৭ হাজারের বেশি শিক্ষক। বাকিরা শিক্ষা কর্মী হিসেবে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি বিভাগে কাজ করতেন। এই ১৭ হাজার শিক্ষকের মধ্যে একটা অংশকে দাগি বা অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে আদালত। কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে কারা সত্যিই যোগ্য, সেটা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তাই সকলের চাকরি চলে গিয়েছিল।
এর ফলে স্কুলে স্কুলে পঠন-পাঠন চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনিতেই শিক্ষকের সংখ্যা ছাত্রের অনুপাতে অনেক কম। চাকরি বাতিলের ফলে সেটা আরো বেড়ে যায়। তাই ৭ এপ্রিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সুপ্রিম কোর্টে মডিফিকেশন আবেদন দাখিল করে। সেই মামলার শুনানি হলো বৃহস্পতিবার।
এদিনের শুনানিতে রাজ্য সরকার, এসএসসি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এক সুরে বলে, আদালতের ৩ এপ্রিলের রায়ের সঙ্গে তারা সহমত। কিন্তু পঠনপাঠনের কথা মাথায় রেখে ও নতুন নিয়োগের জন্য যথেষ্ট সময় প্রার্থনা করে সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এসএসসি মামলার রায়ে আদালত বলেছিল, তিন মাসের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এই সময়সীমার মধ্যে তা সম্ভব নয় বলে আদালতে জানায় পর্ষদ।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। তার নির্দেশ, যে শিক্ষকরা অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হননি, তারা আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে যেতে পারবেন। রাজ্য সরকারকে ৩১ মে-র মধ্যে নিয়োগের নতুন বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হবে। এই বিজ্ঞাপনের কথা হলফনামার আকারে আদালতকে জানাতে হবে।
তবে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডির শিক্ষাকর্মীরা এই স্বস্তি পাচ্ছেন না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অনুযায়ী তারা চাকরিতে সাময়িকভাবে যোগ দিতে পারবেন না। আদালতের বক্তব্য, শিক্ষাকর্মীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল দুর্নীতি হয়েছে। শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের এদিনের নির্দেশের ফলে নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে চলতি শিক্ষাবর্ষে পঠনপাঠন চালিয়ে যাওয়ার সংকট কিছুটা মিটবে। কিন্তু যে শিক্ষকরা কাজ চালিয়ে যাবেন, তাদের চাকরি বাতিলই থাকছে। যারা অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হননি, তারা নতুনভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পাবেন। সেই নতুন প্যানেলের ভিত্তিতে ২০২৬-এর পয়লা জানুয়ারি থেকে স্কুলে যোগ দেবেন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা।
যোগ্য অযোগ্যের ভেদ
সুপ্রিম কোর্ট দাগি বা অযোগ্য হিসেবে ২৬ হাজারের মধ্যে একটি অংশকে চিহ্নিত করেছে। এই সংখ্যা ৬ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু এই ৬ হাজার শিক্ষক কারা, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। এই সংক্রান্ত তালিকা কমিশনের দেয়ার কথা। ফাঁকা ওএমআর শিট জমা দিয়ে এই শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা চাকরি পেয়েছিলেন বলে সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে। এই সংক্রান্ত তথ্য সম্বলিত হার্ডডিস্ক রাজ্যের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। সেই তালিকা সামনে এলে তবেই বোঝা যাবে, কারা টেন্টেড বা দাগি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
এই তালিকা এখনো প্রকাশিত না হওয়ায় অস্পষ্টতা রয়ে গিয়েছে। কোন শিক্ষক স্কুলে যাবেন, আর কোন শিক্ষক যাবেন না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।। বল এখন স্কুল সার্ভিস কমিশনের কোর্টে। তাদের চিহ্নিত করে দিতে হবে দাগি কারা। নইলে স্কুলে গিয়ে যারা পড়াবেন, তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে বলে মনে করছে আইনজীবীদের একাংশ।
বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে মামলাকারী আইনজীবী ফিরদৌস শামীম বলেন, "তালিকা প্রকাশের কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু রায় বেরনোর পর দুই সপ্তাহ কেটে গেলেও সেই তালিকা সামনে আসেনি। ওএমআর শিট আপলোড করতে এত ইতস্তত করছে কেন রাজ্য সরকার? আসলে এই তালিকা সামনে এলেই চিহ্নিত হয়ে যাবে কারা দাগি বা টেন্ডেড। অনেক টাকার হাত বদল হয়েছে এই নিয়োগগুলির ক্ষেত্রে। সেটাকে আড়ালে রাখার চেষ্টা হচ্ছে।"
মালদহ জেলার গাজল থানার সালাইডাঙা বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক পঙ্কজ রায় অন্যান্যদের সঙ্গে ধর্মতলায় অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "এই নির্দেশে একদম খুশি নই। আমাদের আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার পূর্ণ পরিকল্পনা চলছে। সুপ্রিম কোর্ট যদি যোগ্য ও অযোগ্যদের তালিকাটা এসএসসির কাছ থেকে চাপ দিয়ে নিত, তাহলে মেনে নেওয়া যেত। বারবার পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে কেন? ২২ লক্ষ ওএমআর শিট প্রকাশ করা গেল না কেন? সেখান থেকে রাজ্য বাছাই করতে পারতো।"
বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা আদালতের নির্দেশকে স্বাগত জানাচ্ছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতি ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। সাময়িক স্বস্তি তো বটেই, শিক্ষকদের অভাবে স্কুল চালাতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। সে পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হলাম। পাশাপাশি অবিলম্বে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। যারা ধর্মতলায় বসে আছেন, তাদের অযোগ্যদের জায়গায় নিশ্চিত নিয়োগ দিতে হবে।"
পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনের প্রধান শিক্ষক হরিদাস ঘটক ডিডাব্লিউকে বলেন, "এসএসসির কাছে যোগ্য ও অযোগ্য শিক্ষকদের তালিকা আছে। ওরা আসলে একটু জল মাপছিল। অযোগ্যদের একটা তালিকা ওরা নিশ্চিতভাবে স্কুলের কাছে পাঠাবে। সম্ভবত কোনো চিঠিও দেবে, যাতে এদের বাদ দিয়ে বাকিদের বেতনের সুপারিশ পাঠানো যায়। সরকার যদি আগেই যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা তালিকা দিয়ে দিত, তাহলে আর এই সমস্যা থাকত না। আপাতত আমাদের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আশা করব, যোগ্যরা আবার নিজেদের প্রমাণ করে স্কুলে ফিরে আসবেন পাকাপাকিভাবে।"