নেতৃত্বের জন্য জার্মানির ম্যার্ৎসের দিকে ঝুঁকছে ইউরোপ
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫জার্মানি এবং সামগ্রিকভাবে ইউরোপের নেতৃত্ব দেয়ার প্রত্যাশা কি তিনি পূরণ করতে পারবেন?
ফেডারেল নির্বাচনে প্রত্যাশিত জয়ের পর সিডিইউ-সিএসইউ-এর নেতা ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস জার্মান চ্যান্সেলর হতে চলেছেন। ৬৯ বছর বয়সি ম্যার্ৎস সবসময়ই রক্ষণশীলদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর ছিলেন। কিন্তু কখনও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি তিনি। ডনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পর ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্কে যে চাপ তৈরি হয়েছে, সে সংকট কাটিয়ে উঠতে তিনি নেতৃত্ব দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ম্যার্ৎস বলেছেন, "সর্বাগ্রে আমার কাজ হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইউরোপকে শক্তিশালী করা যাতে ধাপে ধাপে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সত্যিই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি।"
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক নানা পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে - ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা। বিশেষজ্ঞরা নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উপর ইউরোপের নির্ভরতা শেষ হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন। "ডনাল্ড ট্রাম্প আর ন্যাটোর পারস্পরিক প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতিকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন করবেন না", এমন সম্ভাবনা মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ম্যার্ৎস।
অন্যান্য দেশ কী বলছে?
ম্যার্ৎসের জয়ের প্রাথমিক ফল জানার পরই ইউরোপের নানা দেশের নেতারা তাকে অভিনন্দন জানাতে দেরি করেননি।
পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো এর মহাসচিব মার্ক রুটে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে বলেন, "আমাদের যৌথ নিরাপত্তার স্বার্থে এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আপনার সঙ্গে কাজ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনার নেতৃত্বই হবে জরুরি।"
ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক কায়া কালাস সরকার গঠনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, "জার্মান জনগণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এখন তাদের সরকার গঠন করতে হবে। আমি আশা করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি হবে, কারণ আমাদের ইউরোপীয় স্তরে জার্মান অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।"
ম্যার্ৎসের নেতৃত্বে তার দল সিডিইউ/সিএসইউ এখন জোট আলোচনায় প্রবেশ করবে। এই আলোচনা চলবে মূলত সামাজিক গণতন্ত্রী দল- এসপিডি এবং সম্ভবত পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টির সঙ্গে।
এসপিডির ভোটের পরিমাণ কমা এবং পূর্ববর্তী জোটের অভিজ্ঞতার কারণে এই আলোচনা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুই মাসের মধ্যে সরকার গঠনের লক্ষ্য ম্যার্ৎসের। এসপিডি নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে জোট সরকারে তাদের অংশগ্রহণ এখনও নিশ্চিত নয়। বিদায়ী চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস জানিয়ে দিয়েছেন, পরবর্তী জোট সরকারে তার কোনো ভূমিকা থাকবে না।
ফরাসি-জার্মান সম্পর্কে গতি আসবে?
জার্মান চ্যান্সেলরের পরিবর্তন হওয়ায় ফরাসি কর্মকর্তারাও আশাবাদী। ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের কামিল গ্র্যান্ড বলেছেন, "শলৎসের অধীনে ফ্রাংকো-জার্মান ইঞ্জিন মূলত অকার্যকর ছিল, সম্ভবত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি ছিল সর্বকালের সর্বনিম্ন।"
অতি-ডানপন্থি অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচলান্ড- এএফডিএর কথা উল্লেখ করে গ্র্যান্ড বলেছেন, "সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি, অর্থাৎ সংখ্যালঘু সরকারের বিপদ জার্মানি এড়িয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে এবং এএফডি এর উত্থান নিয়ন্ত্রণে রয়েছে," ।
এএফডি ২০ দশমিক আট শতাংশ ভোট পাওয়া সত্ত্বেও জোট সরকার গঠনের আলোচনা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শলৎসের নেতৃত্বে জার্মানির তিন দলের জোট সরকারকে অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ইসিএফআর এর রাফায়েল লস ডিডাব্লিউকে বলেছেন, "ম্যার্ৎস সম্ভবত শলৎসের চেয়ে আরও সুসংহত জোটের সমর্থনে জার্মানির চ্যান্সেলার হতে পারবেন।"
লস আরও বলেন, "এর ফলে জোটের অচলাবস্থার ঝুঁকি কমবে। অন্যদিকে, জলবায়ু এবং অভিবাসনের মতো বিষয়গুলোতে ইউরোপীয় কমিশনের সঙ্গে ম্যার্ৎসের বিরোধের সম্ভাবনা রয়েছে।" তিনি অবশ্য মনে করেন, সামগ্রিকভাবে ম্যার্ৎসের নির্বাচনী সাফল্যকে ইউরোপে রাজনৈতিক ডানপন্থিদের শক্তিশালীকরণের প্রতীক হিসাবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
প্রতিরক্ষায় বিশেষ মনোযোগ
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ট্রাম্পের মন্তব্য এবং নানা পদক্ষেপের আলোকে ইউরোপে প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে বিতর্ক নতুন করে জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশন ধারণা করছে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আগামী দশকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য ৫০০ বিলিয়ন ইউরো (প্রায় ৬৩ লাখ কোটি টাকা) ব্যয় করতে হতে পারে।
সামরিকীকরণে বিনিয়োগের জন্য ইইউ এর যৌথ ঋণ গ্রহণে ম্যার্ৎস কতটা আগ্রহী হবেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়। শলৎস এই সম্ভাবনাকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, অন্যদিকে ম্যার্ৎস এর পক্ষে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে ম্যার্ৎসের ব্যক্তিগত ইচ্ছা যা-ই হোক না কেন, জার্মানির সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত ‘ঋণ করার সীমা' বাড়াতে হলে জার্মান পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেতে হবে। সরকারের আর্থিক নিয়মনীতিতে এভাবেই দেশটি ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে ম্যার্ৎস চাইলেও কেবল তার দলের সমর্থনে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না, বিরোধী বা জোটের অন্য শরিকদেরও সমর্থন তার প্রয়োজন হবে।
ওয়াশিংটনের প্রতি একটু বেশি কড়া বার্তা?
লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেস্তুতিস বুদ্রিস মনে করেন, 'ওয়াশিংটন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা' চেয়ে ম্যার্ৎসের দেয়া বক্তব্য একটু বেশি দ্রুত হয়ে গেছে।
সোমবার ব্রাসেলসে ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, "আপাতত ইউরোপে মার্কিন উপস্থিতির, মার্কিন সক্ষমতার কোনও বিকল্প নেই, আমাদের এর অভাব রয়েছে। এমনকি যদি আমরা এই বছর আমাদের প্রতিরক্ষা প্রয়োজনের জন্য এখন থেকেই পাঁচ শতাংশ ব্যয় করা শুরু করি, তবুও আমরা পাঁচ বা ১০ বছরেও সেই সক্ষমতা তৈরি করতে পারব না।"
তার আশঙ্কা, "যদি ন্যাটো ভেঙে পড়ে, যদি সমস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তাহলে সবাই বিপদে পড়বে এবং সবাই অস্তিত্বের হুমকির সম্মুখীন হবে।" জার্মানিও এই বিপদ থেকে রেহাই পাবে না বলে মনে করেন তিনি।
ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র সরবরাহে জার্মানির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বুদ্রিস। যুদ্ধ আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করে এতদিন এমন আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে শলৎসের বিদায়ী সরকার।
আগামী সপ্তাহগুলোতে জোটের আলোচনা শুরু হওয়ার পর কী ঘটছে, ইউরোপে জার্মানির সহযোগীরাও ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখবে সেদিকে।
এলা জয়নার/এডিকে