নির্বাচন, নাকি সংস্কার বিতর্কে ধোঁয়াশা সৃষ্টি ও কালক্ষেপণ?
৩১ মার্চ ২০২৫সদ্য গঠিত দল এনসিপিও শুরু করতে পারে আন্দোলন৷ তবে তারা আগে চায় সংস্কার ও জাতীয় পরিষদ নির্বাচন৷
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এখন মাঝামাঝি অবস্থানে। তারা বলছে, নির্বাচন এবং সংস্কার সমান গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের অন্তিম লগ্নে নিষিদ্ধ হওয়া এবং এখনো নিবন্ধন না হওয়া দলটি মনে করে, আগামী বছরের জুনের মধ্যেই নির্বাচন ও সংস্কার সম্ভব।
তবে ২৫ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, "নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারো বলছি, এ বছর(২০২৪) ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।”
তিনি আরো বলেন, "'আমরা চাই, আগামী নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। এজন্য নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপনায় নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে শুরু করবে বলে আশা করছি।”
২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ‘অস্পষ্ট'। তিনি আরো বলেন, "ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাস। এখনো কোনো রোডম্যাপ দেয়া হয়নি। আমরা বার বার স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং দ্রুত নির্বাচনের কথা বলে আসছি। তা না হলে যেসব সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, সেগুলো কাটবে না।”
তবে একই দিনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, "সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন দিলে মেনে নেয়া হবে না।”
বিএনপির পক্ষ থেকে বার বার চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সংসদ নির্বাচনের দাবি করা হচ্ছে। তারা সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে বলে গণপরিষদ নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
রাজনীতিতে এখন এখন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর এনসিপি। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র-তরুণদের এই দলটি ‘কিংস পার্টি' হিসাবেও পরিচিতি পাচ্ছে। সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন এখন এই দলটির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার ডয়চে ভেলেকে জানান, "সংস্কার এবং বিচার নিয়ে আমরা আমাদের কর্মসূচি ঠিক করেছি৷ আমরা এখন যে গণসংযোগ করছি, সেখানেও এটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন নিয়েও কাজ করছি।”
"এজন্য আমরা লংমার্চসহ আরো যেসব রাজনৈতিক কর্মসূচি আছে, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করছি। আমরা আমাদের দাবি নিয়ে মাঠে থাকবো। ঈদের পর সেটা আপনারা দেখতে পাবেন। এর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দলের নিবন্ধনসহ অন্য বিষয়গুলোও শেষ করবো।”
তার কথা, "সবাই আন্তরিক হলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে সংস্কার এবং নির্বাচন সম্ভব।”
‘নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করছে সরকার'
বিএনপি মনে করে, নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করা হচ্ছে। আর অন্তর্বর্তী সরকারের কারণেই সেই অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করে তারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ এর আগে স্পষ্ট করেই ডয়চে ভেলেকে বলেছেন,"গণপরিষদ নির্বাচনের কোনো দরকার নেই, যুক্তিও নেই। সেকেন্ড রিপাবালিকের ধারণাও অমূলক। এখন কী কোনো রিবাপলিক নেই? আর নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের বাইরে কোনো সংস্কার এখন দরকার নেই। সংবিধান সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার।”
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, "অতি দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। দেশে যে একটা অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাঁয়তারা দেখতে পাচ্ছি, সেটা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার হলে আর থাকবে না।তাই আমরা সরকারকে বলেছি, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অতি দ্রুত নির্বাচন দিতে।”
"সরকারকে আমরা নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে বলছি। রোডম্যাপ ছাড়া তাদের অবস্থান স্পষ্ট হবে না। নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়। সরকার নানা কথায় নানা ধোঁয়াশা তৈরি করছে। আগে বলেছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন। আর এখন বলছে ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন। সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন করছে। এটা আরো সংকট তৈরি করবে,” বলেন তিনি।
তার কথা, "সরকার অতি দ্রুত যদি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করে, তাহলে আমাদের ঈদের পরেই রাস্তায় নামতে হতে পারে।”
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স নির্বাচন প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আসলে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেয়া উচিত সরকারের। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য নাই, সেগুলো অযথা টেনে আনলে জটিলতা তৈরি হবে। তখন নির্বাচনের জন্য গণতান্ত্রিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে মাঠে নামতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধেও আন্দোলন হতে পারে।”
জাতীয় পার্টি ‘স্বৈরাচারের দোসর' আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করতে বাধা দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি তাদের ইফতার পার্টিও পণ্ড করা হয়েছে হামলা চালিয়ে। এর আগে তাদের পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেয়া হয়। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সংস্কারের কাজ খুবই মন্থর গতিতে হচ্ছে। তীব্র গতিতে হলে সবাই আশ্বস্ত হতে পারতো। আর সংস্কারের যে কাজ হচ্ছে, তা-ও গণতান্ত্রিক ইনক্লুসিভ উপায়ে হচ্ছে না। ফলে অনেক রাজনৈতিক দলই সংস্কারকে ওউন করবে না। বিএনপিও অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত না, তারা নাকচ করে দিয়েছে।”
শামীম হায়দার পাটোয়ারী মনে করেন, "এখন সংস্কার ও নির্বাচন দুটি নিয়েই এগোতে হবে। মানুষ কী চায় তা সরকারকে বুঝতে হবে। না হলে বর্তমান সরকারকেও কোনো একদিন আন্দোলনের মুখে পটপরিবর্তন করতে হবে। তা সবার জন্যই বিব্রতকর হবে৷”
তবে জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ মনে করেন আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করা উচিত, "এখন তো আলোচনার টেবিলে সব ঠিক হবে। সেখানেই ঐকমত্য হবে। আন্দোলন কেন? এটা ভালো হবে না, উচিতও হবে না। কারণ, এই সরকার কোনো রাজনৈতিক সরকার নয়। এটা কোনো দলীয় দরকারও নয়। তারা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন করে চলে যাবে।”
তার কথা, "অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এটাকে আমরা সঠিক সময় মনে করি। এই সময়ের মধ্যে সংস্কার এবং নির্বাচন সবই করা সম্ভব। আমরা প্রধান উপদেষ্টার কথায় আস্থাশীল।”
"আমরা এইসব বিষয় নিয়ে কোনো আন্দোলনের পরিকল্পনা করছি না। তবে জনগণের বিষয় নিয়ে তো আন্দোলন হতেই পারে,” বলেন তিনি।
সরকার কী চায়?
তবে সরকারের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ। তিনি মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নির্বাচন দিতে চায় না। তার কথা, "আসলে সরকার যে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছে তার কোনো প্রস্তুতি সরকারের মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি না। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উনি করবেন, সেই নির্বাচনে কি আওয়ামী লীগ থাকবে? সেটা স্পষ্ট করা হচ্ছে না। না থাকলে কিভাবে থাকবে না তা-ও বলা হচ্ছে না। নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিয়ে সরকার একটা চালাকি করছে।”
"এখন বিএনপি ও এনসিপির অবস্থানে পার্থক্য আছে। দুই দল এটা নিয়ে কর্মসূচি দিলে সংঘাত হবে। বিএনপি অনেক বড় দল। তারা তো অনেক মানুষ মবিলাইজ করতে পারবে। অন্যদিকে এনসিপিকে আবার রষ্ট্রপক্ষ সহায়তা করবে। এই অবস্থায় দুই দলের মধ্যে মারামারি হতে পারে,” বলেন তিনি।
তার মতে, "আসলে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার করা দরকার, সেটা করে জাতীয় নির্বাচন দেয়া উচিত। গণপরিষদ নির্বাচন নয়। এর বাইরে গেলে রাজনীতি সংঘাতময় হতে পারে। গণপরিষদ নির্বাচন দিয়ে কি ৭২-এর সংবিধান ফেলে দেবেন? সেটা সম্ভব নয়।”
হারুন উর রশীদ স্বপন(ঢাকা)