অসংখ্য পুরুষের সামনে এই ঘটনা ঘটলেও কাউকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি৷
বাংলাদেশের কুমিল্লার মুরাদনগরের গত ২৬ জুনের ঘটনা এটি৷ ফেসবুকে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে পুলিশ সক্রিয় হয়, মামলা হয়৷ অভিযুক্ত ফজর আলীকে তখন গ্রেপ্তার করা হয়৷ তিনি কোন দলের রাজনীতি করেন তা নিয়ে শুরু হয় আরেক প্রচারণা৷ এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ ওই নারীকে হেয় করে প্রচার চালান৷ শুধু ফেসবুক বা ইউটিউব নয়, অনেক গণমাধ্যমেও চোখে পড়েছে অসংবেদনশীল কথাবার্তা৷
এখানেই শেষ হয়, ওই নারীকে নির্যাতনে পর গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন ভিড় করতে থাকেন তার বাড়িতে৷ লোকজনের নানা কটুকথাআর প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে ওই নারী তাঁর দুই সন্তান ও মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন৷
পুলিশ বলছে, এই ঘটনার জন্য অনেকে পরকীয়া বা ওই নারীকে দায়ী করলেও প্রকৃত অর্থে ওই নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ ওই নারীর ভাই অল্পকিছু টাকা ধার নিলেও সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় অভিযুক্ত ফজর আলী ভুক্তভোগী নারীর ঘরের দরজা ভেঙে তাকে ধর্ষণ করেন৷ সেই ঘটনা জানতে পেরে একদল যুবক ঘরে ঢুকে ওই নারীকে মারধর করে৷ পরে বিবস্ত্র করে তাঁর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়৷ এই ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে৷ দুই মামলায় ফজর আলীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ তবে ওই নারীর সামাজিক হয়রানি কমেনি৷ বরং ঘটনার পর প্রতিদিনই ওই বাড়িতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন ভিড় করলে ভুক্তভোগীর পারিবারিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে৷ এসব কারণেই ভুক্তভোগী বাড়ি থেকে সরে গেছেন৷
মুরাদনগরের এই ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে যখন তোলপাড় সেই সময়েই জানা গেল ভোলা জেলার তজুমদ্দিনে চাঁদা না পেয়ে স্বামীকে বেঁধে মারধর ও স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেছে কয়েকজন পুরুষ৷ এখনও অসংখ্য লোকের সামনে এই ঘটনা ঘটেছে৷ কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে আসেননি৷
বাংলাদেশে হরহামেশাই নারী নিপীড়নের এসব ঘটনা ঘটছে৷ এই তো কয়েক মাস আগেই মাগুরার এক গ্রামে আট বছরের শিশু আছিয়ার ধর্ষণ ও বেদনাদায়ক মৃত্যুর নাড়িয়ে গেলে পুরো দেশকে৷
কেবল যে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতেই নারী নিপীড়ন ঘটছে তাই নয়, বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হেনস্থার ঘটনাটিও মার্চের৷ ওই ঘটনায় অভিযুক্তকে পুরুষকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছে একদল লোক৷ লালমাটিয়ায় টং দোকানে চা সিগারেট খেতে আসায় ‘মব'করে দুই নারীকে প্রথমে অপদস্থ ও পরে গায়ে হাত তোলা হয়েছে৷ প্রতিবাদ করায় তাদের জামাকাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়৷ এখানেও সবার সামনেই ঘটনা ঘটেছে৷ সবাই দোষ দিয়েছেন নারীদের৷
বাংলাদেশে নারী নিপীড়নের এই ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ এদেশে রোজ অনলাইনে অফলাইনে নারী ও শিশু নিপীড়নের বর্বর সব ঘটনা ঘটছে৷ যে-কোনো দিনের গণমাধ্যম খুললেই দেখা যাবে, বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ‘ধর্ষণের শিকার' শিশু, চিপস কিনে দিয়ে প্রতিবন্ধী তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ, খাবার ও বেলুনের লোভ দেখিয়ে দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, সাইকেলে ঘোরানোর কথা বলে শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণ, ভিডিও ধারণও করলো ধর্ষক, সৈকতে বন্ধুকে বেঁধে রেখে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মায়ের মামলা, গর্ভবতী নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগসহ নারী নিপীড়নের নানা খবর৷
আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে এই পাঁচ মাসে ৩৮৩ জন নারীকে ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে এসেছে যার মধ্যে ৯৭ জনকেই গণধর্ষণ করা হয়েছে৷ এর মধ্যে ছয় বছরের নিচের শিশু আছে ৪৪ জন, সাত থেকে ১২ বছরের ৭৫ জন, ১৩ থেকে ১৮ বছরের শিশু ৭৭ জন৷ এর বাইরেও ১৫০ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টার খবর এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে৷
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সারাদেশে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কন্যাশিশু৷ আর বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের মে মাসে নারী ও শিশু নিপীড়নের ঘটনায় দুই হাজার ৮৭টি, এপ্রিলে দুই হাজার ৮৯টি, মার্চে ২০৫৪টি, ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৪৩০টি, এবং জানুয়ারিতে এক হাজার ৪৪০টি মামলা হয়েছে৷
তবে যত মামলা হয় বা যত খবর গণমাধ্যমে আসে বাস্তব সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি৷ দুঃখজনক হলো এ দেশের রাস্তায়-বাসে-পথে ঘাটে, অফিসে, বাড়িতে নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলো ঘটলেও পুরুষদের সেভাবে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না৷ বরং অনলাইনে অফলাইনে পুরুষদের হাতেই নারীরা বেশি নিযাতিত হন৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি যৌথভাবে একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে৷ তাতে বলা হয়েছে, দেশের ৭০ ভাগ নারী তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হন৷ পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় স্বামীর মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হন নারীরা৷ তবে জীবনসঙ্গী বা স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতার মাত্রা বেশি হলেও ৬৪ শতাংশ নারী তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কাউকে কখনো বলেননি৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) আরেক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বের যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের হার বেশি সেই তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ৷ বেসরকারি এক সংস্থার জরিপ বলছে, দেশে ৯৪ শতাংশ নারী গণপরিবহনে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির শিকার৷ এতোসব পরিসংখ্যান বাদ দিয়ে যদি বলি, ফার্মগেট থেকে শাহবাগে প্রকাশ্যে দিনের বেলা কোন ধরনের অস্বস্তি বোধ ছাড়া কয়জন নারী হেঁটে যেতে পারেন?
বাংলাদেশের এক তরুণীর একটা সাক্ষাৎকার ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে৷ ওই তরুণীর প্রতি প্রশ্ন ছিল, ‘‘২৪ ঘণ্টার জন্য যদি পৃথিবী থেকে সমস্ত পুরুষ উধাও হয়ে যায়, আপনি কী করবেন?'' উত্তরে তরুণী বলেছিলেন, ‘‘রাতে একা হাঁটতাম৷ রাত তিনটা বাজে হেঁটে দেখব কেমন লাগে৷''
এ দেশে একজন নারীর রাতে একা হাঁটতে চাওয়ার ইচ্ছা যে কত ‘বড় ইচ্ছা', তা নারীমাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন৷ তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ এই ঘটনাগুলো অনুধাবন করতে পারেন বলে মনে হয় না৷
বাংলাদেশ বহু বছর ধরেই এই নারী নিপীড়ন চলছে৷ তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন, হয়রানি, হিংসা–বিদ্বেষসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে চলেছে বলে অভিযোগ তুলছে বিভিন্ন সংগঠন৷ এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে কটূক্তির পরেও সরকারের কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়েনি৷
এই কটূক্তি ও অব্যাহত নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে মে মাসেই ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা' কর্মসূচি পালিত হয়৷ তবে পরিস্থিতি খুব বেশি ইতিবাচক হয়নি৷ এর আগে এ বছরের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নারী সংহতির এক মতবিনিময় সভায় বলা হয়, ‘‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীরাই সামনের সারিতে ছিলেন৷ এখন সেই নারীদের বেঁচে থাকাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ প্রতিবাদ করলে মবের শিকার হতে হচ্ছে৷ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে নারীদের হয়রানি করা হচ্ছে৷ নারীর প্রতি এই বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারও নীরব৷ বাস্তবতা কিন্তু আসলেই তাই৷ এই রাষ্ট্র, এখানকার আইন আদালত সবকিছুই নারী নিপীড়নের পক্ষে৷''
আফসোস মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল! কিন্তু বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক যে নারী তাদের আতঙ্ক আরো বেড়েছে, তাদের অবস্থা যেন আরো খারাপ হয়েছে৷ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি এক জরিপে বলেছে, দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন নিজেকে অনিরাপদ মনে করেন৷ তবে এ শঙ্কা পুরুষের তুলনায় নারীদের বেশি৷ আর এখন নিপীড়নকারীদেরও বীর বানানো হচ্ছে অনেক সময়৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটা মনে করেন৷ এক ছাত্রীক পোশাক নিয়ে হেনস্থার পর যখন ফেসবুকে প্রতিবাদ করে স্ট্যাটাস দেন, দেখা গেল ওই ছাত্রীকে অনলাইনে হেয় করা হচ্ছে আর ওই হেনস্থাকারীকে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে বরণ করে নেওয়া হচ্ছে৷ এর আগে ৪০ থেকে ৫০ জনের মতো একটি মব সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত থানা ঘেরাও করে রাখেন ওই লোকের বিরুদ্ধে৷ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছেন এমন লোককে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়ার এমন প্রবণতা সমাজে আগে ছিলো কী? এখানে নারীকে হয়রানি করার মতো অপরাধকে যেন উৎসাহিত করা হচ্ছে৷ এগুলো যেন পুরুষের মোরাল পুলিশিং!
মুন্সিগঞ্জের ঘটনাটিও এর প্রমাণ৷ এ বছরের মে মাসে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, দুই তরুণীকে লঞ্চের একেবারে সামনের অংশে উঠিয়ে বেল্ট দিয়ে পেটাচ্ছেন এক তরুণ৷ এ সময় স্থানীয় লোকজন সেই দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করে উল্লাস করছিলেন ও বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন৷
ওই ঘটনায় অভিযুক্ত তরুণ দাবি করেন তিনি ওই দুই নারীকে বড় ভাইয়ের মতো শাসন করেছেন৷ কাজেই তিনি যখন বেল্ট খুলে পেটাচ্ছিলেন বাকিরা মনে করেছেন পোশাকের কারণে এভাবে শাসন করা উচিত৷ ফলে তারা উল্লাস করছিলেন৷
মুরাদনগর, ভোলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, লালমাটিয়া, মুন্সিগঞ্জ কিংবা নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অধিকাংশ সময় অল্প কয়েকজন পুরুষ নিপীড়ন করে কিন্তু বাকি পুরুষরা প্রতিবাদ না করে দর্শকের ভূমিকায় থাকছে৷ এদের কেউ কেউ আবার নিপীড়নে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে অংশ নিচ্ছেন বা সমর্থন দিচ্ছেন! অথচ যদি উল্টো হতো কয়েকজন পুরুষ প্রতিবাদ করছেন তাহলেই কিন্তু নির্যাতনকারী পালিয়ে যেত৷ অথচ সেই প্রতিবাদটা হয় না! মোবাইল ফোনে এসব ঘটনার ছবি তোলার ব্যাপারে যতো উৎসাহ থাকে মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে তা দেখা যায় না৷
ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পুরুষরা এখানে নৈতিকতা পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ৷ আসলে পুরুষতান্তিক এই সমাজে এই রাষ্ট্রে পুরুষরা সবসময় নারীর চেয়ে নিজেকে প্রভাবশালী ভাবেন৷ এমনকি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নারীর চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থানে থেকেও একজন পুরুষ নিজেকে শক্তিশালী ভাবেন৷ ফলে তারা নারীকে সবসময় শাসন করতে চান৷
আসলে এই দেশের সমাজ কাঠামোতে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং কর্তৃত্বের ধারণা এতটাই শক্তিশালী যে নারীর প্রতি সহিংসতাকে এখানে ‘স্বাভাবিক' মনে করা হয়৷ ফলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি বিদ্বেষ আর ঘৃণা বাড়তেই থাকে৷ শুধু পুরুষ নয় নারীরাও এর দ্বারা প্রভাবিত হন৷ কাজেই শুধু আইন দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বরং আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সুশাসনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা ও মূল্যবোধ জরুরি৷ পরিবার, স্কুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীর অধিকার, মর্যাদা এবং সুরক্ষা বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা জরুরি৷ বিশেষ করে ছোটবেলা থেকে পারিবারিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা কঠিন৷
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের যে সমাজকাঠামো তাতে একটা ছেলে শিশু পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে৷ একজন পুরুষ বাবা হিসেবে যদি নিজের সন্তানদের সামনে স্ত্রী এবং পরিবারের নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন, একজন মা যদি ছেলে সন্তানকে নারীদের সম্মান করতে শেখান তাহলে নারীদের প্রতি সহিংসতা কমবে৷ আসলে ছোটবেলা থেকেই ছেলে শিশুদের বোঝাতে হবে নারী নিপীড়ন করলে একজন পুরুষ কখনো বীর হয় না বরং নারীকে সম্মান ও নিরাপত্তা দিতে পারলেই বীর পুরুষ হওয়া যায় না৷
একইভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সবক্ষেত্রেই ইতিবাচক চর্চা জরুরি৷ গণমাধ্যমেকে এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে৷ দুঃখজনক হলো গণমাধ্যমের এসব খবরেও নারীকে নানাভাবে হেয় করা হেচ্ছে৷ অধিকাংশ গণমাধ্যমে নারী ও শিশুদের জন্য কোন নীতিমালা নেই৷ ধর্ষন ও নিপীড়নের শিকার নারীর ছবি ও ভিডিও আর রগরগে বর্ণনা৷ নাটক-সিনেমাতেও নারীকে নানাভাবে হেয় করা হচ্ছে৷ এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি৷
আরেকটি বিষয়৷ বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নানা আইন থাকলেও বাস্তবে এসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না৷ আইনের এই প্রয়োগ ও সুশাসন জরুরি৷ তবে সবার আগে মনে রাখতে হবে, নারীর মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব সবার বিশেষ করে পুরুষের সংহতি এবং সমর্থন ছাড়া নারী নিপীড়ন বন্ধ করা কঠিন৷ পাশাপাশি বোধসম্পন্ন প্রতিটা পুরুষের প্রতিটা মানুষের নিপীড়নের ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ করা উচিত৷ কারণ অল্প কয়েকজন পুরুষও যদি নিজ অবস্থানে থেকে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেন তাহলে বাকি পুরুষদেরও তা প্রভাবিত করবে এবং এভাবেই ধীরে ধীরে সমাজে নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব বাড়াবে৷
শেষ করি ইতিবাচক কথা বলে৷ এতোক্ষণে পুরো দেশবাসী জেনে গেছে, ২ জুলাই ২-১ গোলে মিয়ানমারকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়ান ফুটবল কাপে জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল৷ অথচ এই নারী ফুটবালদের কতো ধরনের বাঁধা বিপত্তি পেরুতে হচ্ছে৷ কিন্তু তারপরেও ঋতুপর্ণারা এগিয়ে যাচ্ছে৷ আসলে পুরোপুরি সমর্থন পেলে বাংলাদেশের নারীরা আরো এগিয়ে যাবে৷ কাঙ্খিত বাংলাদেশ গড়তে হলে এর বিকল্প নেই!