শুধু আইন প্রয়োগ বা অপরাধীদের শাস্তির মধ্যে এই সমস্যার সমাধান নেই, কারণ এই সহিংসতা মূলত সমাজের গভীরে প্রোথিত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, এবং রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্য দিয়েই পুনরুৎপাদিত হয়৷ সুতরাং, এ সংকট নিরসনে আমাদের সামাজিকীকরণ, ধর্ম-সংস্কৃতি, আইনি কাঠামো, মিডিয়া, অর্থনীতি, এবং শিক্ষা প্রতিটি স্তরে বৈপ্লবিক পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন৷
১. পরিবারের লিঙ্গ-শিক্ষা ও ক্ষমতা পুনরুৎপাদন
জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন, পরিবার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে ছেলেরা শিখে যায় তাদের শ্রেষ্ঠত্ব জন্মগত এবং নারীদের প্রতি দমন প্রাকৃতিক৷ বুর্দিয়ুর ‘হ্যাবিটাস' তত্ত্বও বলে, পরিবার ক্ষমতার পুনরুৎপাদনের প্রধান ক্ষেত্র৷ আমাদের সমাজে পরিবারই প্রথম স্থান, যেখানে কন্যাসন্তানকে বোঝানো হয়, তাদের সীমা আছে, তাদের শরীর ‘লজ্জা' আর ‘সম্ভ্রম'-এর আওতায় থাকবে৷ অন্যদিকে, ছেলেদের শেখানো হয় তারা কর্তৃত্বের অধিকারী৷ এভাবে সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়েই ছেলে শিশুর মধ্যে নারীর প্রতি দমন ও অবমূল্যায়নের মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে৷
শহর বা গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাব এবং পরিবারের ওপর নির্ভরশীলতা তাদের দুর্বল করে তোলে৷ বিয়ের পরও নারীর শ্রমকে অদৃশ্য করা হয়৷ স্বামীহীন অবস্থায় নারীর সামাজিক পরিচয় সংকটই প্রমাণ করে পরিবার নারীর ওপর নির্ভরশীলতার চক্র ভাঙতে ব্যর্থ৷
২. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব: পবিত্রতার আড়ালে নিপীড়নের কাঠামো
বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং রক্ষণশীল সাংস্কৃতিক ধারা নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের অন্যতম মৌলিক উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ধর্মীয় অনুশাসনকে প্রায়ই নারীর স্বাধীন চলাফেরা, পোশাক, শিক্ষা এবং কর্মজীবনের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এমনভাবে, যেন এই সকল ক্ষেত্রেই নারীর স্বাধীনতা সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ৷ কিন্তু এই অবস্থান বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এটি মূলত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার একটি কৌশলগত রূপ, যা নারীর স্বাভাবিক অধিকারকে সীমাবদ্ধ রাখতে ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে৷
সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াজ মাহফিল, সামাজিক মিডিয়া এবং টিভি বিতর্কগুলোতে ধর্মীয় নেতাদের অবমাননাকর ও অসম্মানজনক বক্তব্য এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ নারী খেলোয়াড়দের পোশাক নিয়ে মন্তব্য থেকে শুরু করে মেয়েদের রাতে বের হওয়া নিয়ে আপত্তি তোলা পর্যন্ত, সবই নারীর প্রতি সামাজিক শাসন এবং ‘মোরাল পুলিশিং'-এর একটি কাঠামোগত বহিঃপ্রকাশ৷ এই ধারাবাহিক কথনগুলো সামাজিক মনস্তত্ত্বে এমন একটি ধারণা প্রোথিত করে যে, নারীর স্বাধীনতা মানেই বিপদ ডেকে আনা৷
ফেমিনিস্ট তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি স্পষ্ট যে, নারীর চলাফেরা বা পোশাকের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা মানে তাদের উপর সামাজিক শাসন কায়েম রাখা এবং অপরাধীদের দায়কে ন্যায্যতার আড়ালে লুকিয়ে রাখা৷ ‘ভিকটিম ব্লেমিং' বা ভুক্তভোগীকেই দায়ী করার এই সংস্কৃতি, নারীর প্রতি সহিংসতাকে ব্যক্তিগত অভ্যাস বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার চেয়ে সমাজ-গঠনমূলক ব্যর্থতার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ এ ধরনের মনোভাব অপরাধীর দায়বোধকে লঘু করে এবং তাকে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়মুক্তির সুযোগ দেয়৷
এছাড়াও, সাংস্কৃতিক বয়ান এবং ধর্মীয় বক্তৃতায় যে ধরনের লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক বাণী ছড়িয়ে পড়ে, তা সমাজে এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক নারী-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে৷ উদাহরণস্বরূপ, যখন মসজিদ, ওয়াজ মাহফিল বা টিভি টকশোতে নারীর পোশাককে ধর্ষণের কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, তখন এটি কেবল একটি কথন থাকে না; বরং এটি একটি ‘norm-setting discourse' হয়ে দাঁড়ায়, যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে অপরাধের দায় এড়িয়ে যেতে অনুমোদন দেয়৷
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেসব ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বয়ান নারীর স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে, তা মূলত ধর্মের মূল দর্শন নয়; বরং পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা৷ ইসলামের বেলায়ও আমরা দেখি, কোরআনে নারীর মর্যাদা, শিক্ষা ও সম্মানকে সুস্পষ্টভাবে রক্ষা করার কথা বলা আছে৷ কিন্তু এই ব্যাখ্যাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা হয় সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে৷
সুতরাং, বাংলাদেশে নারীর স্বাধীনতার প্রশ্নে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবকে কেবল ‘ধার্মিক অনুশাসন' হিসেবে না দেখে, বরং রাজনৈতিক শাসন-প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিশ্লেষণ করতে হবে৷ যতক্ষণ না আমরা এই কাঠামোগত বিশ্লেষণ করতে পারবো, ততক্ষণ নারীর প্রতি সহিংসতা কেবল ব্যক্তি পর্যায়ের ঘটনা হিসেবে থেকে যাবে এবং সমাধানের পথও আড়ালেই থাকবে৷
৩. আইন: প্রতীকী অস্ত্র না বাস্তব রক্ষাকবচ?
যে আইন সমাজে ন্যায়, সুরক্ষা এবং সমতার প্রতীক হওয়া উচিত, তা বাংলাদেশে প্রায়ই শুধুমাত্র এক প্রাতিষ্ঠানিক কাগজ-কলমের অস্ত্র হয়েই থেকে যায়৷ ক্রিটিক্যাল লিগ্যাল স্টাডিজ তত্ত্ব অনুযায়ী, আইন মূলত ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের একটি কাঠামোগত উপকরণ, যা নির্যাতিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার চেয়ে ক্ষমতার পুনরুৎপাদনেই বেশি মনোযোগী থাকে৷ বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০০) তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ — কঠোর ভাষা এবং ভয়াবহ শাস্তির বিধান সত্ত্বেও এর প্রয়োগে এক ভয়াবহ অসামঞ্জস্য ও দায়হীনতার চিত্র পাওয়া যায়৷
বিচার ব্যবস্থার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার গভীর উপস্থিতি বোঝা যায় নরসিংদী রেলস্টেশনে তরুণীকে হয়রানির ঘটনায় আদালতের একটি মন্তব্য থেকে৷ আদালত যেখানে নারীর নিরাপত্তার সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রতিষ্ঠান, সেখানে বিচারকের পোশাক নিয়ে করা আপত্তিকর মন্তব্য এক প্রাতিষ্ঠানিক অপমান এবং ‘institutional gaslighting'-এর নিদর্শন৷ এটি কেবল ব্যক্তিগত মানসিকতা নয়; বরং সেই কাঠামোগত বাস্তবতা, যেখানে নারীর উপর হওয়া সহিংসতা রূপান্তরিত হয় নারীরই দায়ে এবং সামাজিক সম্মানের অঙ্গীভূত ইস্যুতে৷
আইন তখনই শক্তিশালী হয়, যখন তার প্রয়োগে স্বচ্ছতা, দ্রুততা এবং ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় থাকে৷ কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি এবং বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা নারীর প্রতি সহিংসতাকে দমনের বদলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘নরমালাইজ' করে তুলছে৷ এর ফলে অপরাধীর মনে তৈরি হয় দায়মুক্তির সংস্কৃতি এবং ভুক্তভোগীর মনে জন্ম নেয় সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবিশ্বাস৷
ফেমিনিস্ট লিগ্যাল থিওরি এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করে: আইন যদি কেবল পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রণীত ও প্রয়োগ হয়, তবে তা কখনোই নারীর প্রকৃত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না৷ ফলে, আইনের কাঠামোগত বিশ্লেষণে শুধুমাত্র ধারা বা সংজ্ঞা নয়, বিচার-প্রয়োগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করাও অত্যন্ত জরুরি৷
৪. পারিবারিক সমর্থনের অভাব
যে পরিবার ভুক্তভোগীর জন্য প্রথম সুরক্ষা বলয় হওয়া উচিত, সেই পরিবারই অনেক সময় সামাজিক মর্যাদা, সম্মান রক্ষার দোহাই দিয়ে অপরাধীর পক্ষ নেয়, যা নারীর উপর সহিংসতার ক্ষেত্রে একটি নীরব সহযোগিতামূলক কাঠামো তৈরি করে৷ এখানে শুধুমাত্র পারিবারিক ব্যর্থতা নয়, একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় কাজ করে, যেখানে সম্মান ধারণাটি নারীর যৌন পরিচ্ছদের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়৷ ফলে, ভুক্তভোগী নারীকে অপরাধের শিকার হওয়ার পরও সমাজ ও পরিবার উভয়ের কাছে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷
এই মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা ভুক্তভোগীর জন্য আরও বিভীষিকাময়, কারণ সে বুঝতে পারে যে বিচারব্যবস্থা দূরের বিষয়, নিজের পরিবারও তাকে গ্রহণ করছে না৷ এতে তার মানসিক স্থিতি ভেঙে যায় এবং আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া পর্যন্ত চলে যেতে পারে৷ পরিবার যদি চুপ থাকে বা বিপরীতে ধর্ষকের সঙ্গে আপোসে যায়, তা শুধুমাত্র একক অপরাধ নয়, এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক সহিংসতা, যা সমাজকে ক্রমান্বয়ে পচিয়ে দেয়৷
সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খেইমের ‘সামাজিক সংহতি' তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন সমাজের বিভিন্ন স্তর, পরিবার, সম্প্রদায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- নৈতিকতা লঙ্ঘনকারী আচরণকে মেনে নেয় বা উপেক্ষা করে, তখন সামাজিক বুনন দুর্বল হয়ে যায় এবং নৈতিক ক্ষয় শুরু হয়৷ সেই ক্ষয়ের ভেতরেই অপরাধ সমাজের রক্তধারায় ঢুকে পড়ে এবং তা আর ব্যক্তিগত অপরাধ থাকে না — হয়ে ওঠে একটি সামাজিক ব্যাধি৷
আরও গভীরভাবে বললে, পারিবারিক সমর্থনের অভাব আসলে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন৷ কারণ পরিবার নারীর মর্যাদাকে নিজের সামাজিক মানদণ্ডের সাথে যুক্ত করে দেখে, এবং নারী যখন ধর্ষণের শিকার হয়, পরিবার এটিকে নিজের 'সম্মানের ক্ষতি' বলে ধরে নেয়৷ তাই পরিবার নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে নয়, নিজেদের সামাজিক অবস্থান রক্ষা করতে গিয়ে অপরাধীকেই আড়াল করতে চায়৷ এই মানসিকতা ভেঙে না ফেলা পর্যন্ত কোনো সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়৷
তদুপরি, পারিবারিক সমর্থনের অভাব অপরাধীকে একটি শক্ত বার্তা দেয় যে তার জন্য কোনো সামাজিক প্রতিরোধ আসবে না৷ ফলে, এটি অপরাধের পুনরাবৃত্তি এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অপরাধপ্রবণ মানসিকতার বীজ বপন করে৷ সুতরাং, ধর্ষণ প্রতিরোধে পরিবার হলো প্রথম যুদ্ধক্ষেত্র; পরিবারকে তার ভেতরের পিতৃতান্ত্রিক আগাছা উপড়ে ফেলতে হবে এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়ানোর রাজনৈতিক ও নৈতিক শক্তি অর্জন করতে হবে৷
৫. যৌন হয়রানি সম্পর্কে শিক্ষার অভাব
বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে যৌন হয়রানি নিয়ে শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত থেকে গেছে৷ এটি কেবল একটি নির্দিষ্ট জ্ঞানের ঘাটতি নয়, বরং একটি কাঠামোগত উপেক্ষা, যা অপরাধীদের সহায়ক এবং ভুক্তভোগীদের নিঃস্ব করে তোলে৷ শিশুদের ছোটবেলা থেকেই নিরাপদ ও অনিরাপদ স্পর্শ, ব্যক্তিগত সীমারেখা এবং সম্মতির ধারণা দেওয়া না হলে তারা জানতেই পারে না কখন, কোথায় এবং কিভাবে নিজের নিরাপত্তা রক্ষা করতে হবে৷ শুধু তাই নয়, এই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা নির্যাতন চালাতে আরও সাহস পায়৷
বাংলাদেশের পরিবারে এবং স্কুলের পাঠ্যক্রমে যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্তির প্রতি যে অনীহা রয়েছে, তা মূলত সামাজিক ট্যাবু এবং লজ্জার সংস্কৃতি থেকে আসে৷ কিন্তু এই লজ্জা আসলে এক ধরনের সামাজিক ষড়যন্ত্র, যার মাধ্যমে নারীর উপর সহিংসতা এবং শিকার হওয়ার ঘটনাকে গোপন রাখার সংস্কৃতি তৈরি করা হয়৷ ফলে ভুক্তভোগীরা কণ্ঠরোধী থাকে এবং অপরাধীরা নিঃশঙ্ক হয়৷
আলবার্ট বান্দুরার ‘সোশ্যাল লার্নিং থিওরি' অনুযায়ী, শিশুরা তাদের চারপাশের পরিবেশ দেখে এবং পর্যবেক্ষণ করে শিখে৷ যদি পরিবার, স্কুল এবং সমাজ যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে স্পষ্ট বার্তা না দেয়, বরং নিরবতা অবলম্বন করে, তবে শিশুরা এটিকে অবচেতনভাবে ‘স্বাভাবিক' হিসেবে মেনে নিতে পারে৷ সুতরাং, যৌন শিক্ষা শুধুই প্রতিরোধমূলক নয়, এটি সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো গঠনেরও অপরিহার্য উপাদান৷ এটি মানে শিশুদের শেখানো যে তাদের শরীর তাদের নিজস্ব এবং যে কোনো অবাঞ্ছিত স্পর্শ বা মন্তব্যের বিরুদ্ধেও তাদের প্রতিবাদের অধিকার রয়েছে৷ এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং সামাজিক অসমতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধী শক্তি তৈরি হয়৷
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যৌন শিক্ষার অভাব মূলত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার একটি প্রতিফলন, যেখানে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার নামে তার কণ্ঠ ও অধিকারকে দমন করা হয়৷ তাই, যৌন শিক্ষা আসলে একটি রাজনৈতিক কাজ, এটি একদিকে শিশুদের রক্ষা করে, অন্যদিকে সমাজের গোপন পিতৃতন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়৷
৬. সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও সামাজিক মাধ্যমের কাঠামোগত দায়
সামাজিক মাধ্যমে নারীর প্রতি কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, চরিত্রহনন এবং বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণ এখন আর কেবল ব্যক্তিগত অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ নয়; এটি ক্রমশ এক সামাজিকভাবে অনুমোদিত সহিংস চর্চায় রূপ নিয়েছে৷ ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়ের বোর্ডিয়ুর ‘সিম্বোলিক ভায়োলেন্স' ধারণা দিয়ে এটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের দৈনন্দিন ভাষা, রসিকতা, মিম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর প্রতি যেভাবে অবমাননাকর উপস্থাপন করা হয়, তা আসলে কাঠামোগত সহিংসতারই অংশ, যা অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নারীকে অবদমিত রাখে এবং সমাজে এ ধরনের সহিংসতা বৈধ করে তোলে৷ উদাহরণস্বরূপ, লালমাটিয়ার চায়ের দোকানে দুই তরুণীর ধূমপানকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছিল, তা নিছক নৈতিক পুলিশিং নয়; বরং নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও এজেন্সিকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করার একটি পরিকল্পিত সামাজিক কাঠামোরই বহিঃপ্রকাশ৷
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সামাজিক মাধ্যমে নারীর প্রতি ইতিবাচক উপস্থাপন ও সচেতনতা তৈরির উপর জোর দিতে হবে৷ নারীকে শুধু অবমাননার শিকার হিসেবে নয়, বরং আত্মবিশ্বাসী, সক্ষম, এবং সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করা জরুরি৷ পাশাপাশি, সামাজিক মাধ্যমে নিয়মিতভাবে এই ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক আলাপ এবং গণসচেতনতা বৃদ্ধি করাও সময়ের দাবি৷
বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও নিপীড়ন প্রতিরোধের জন্য আইন, সামাজিকীকরণ, ধর্ম, পরিবার, শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম–এই প্রতিটি স্তরে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ভেঙে ফেলার প্রয়োজন৷ এটি কেবল ‘প্রশ্ন' নয়, এটি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব এবং সামাজিক প্রগতির শর্ত৷ নারীকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতি, ধর্ম, এবং রাষ্ট্রের নির্মাণ প্রক্রিয়াটি যদি রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ না করা হয়, তবে এ সমস্যা কখনোই নির্মূল হবে না৷ জেন্ডার ইকুয়ালিটি কাগজে নয়, কাঠামোতে ঘটাতে হবে৷ প্রতীকী নারীবাদ দিয়ে আসল পরিবর্তন আসবে না; প্রয়োজন গভীর কাঠামোগত পরিবর্তন এবং আইনের বাস্তবিক প্রয়োগ৷