ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় যা হতে পারে
ধর্ষণসহ নারীর প্রতি বিভিন্ন সহিংসতা ঠেকাতে সরকার ও ব্যক্তি পর্যায়ে কী করা যেতে পারে এবং কী করা উচিত, সে বিষয়ে বিভিন্ন পেশার নারীদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷
নাহিদা আকতার, বিজনেস ম্যানেজার
একটি সমাজের শুরু হয় পরিবার থেকে৷ পারিবারিক শিক্ষা অনেক মেয়ের জীবন বাঁচাতে পারে৷ ছেলেমেয়ে সবাইকে এক ছাদে এনে যদি মানবতা, সম্মান আর সমতার পাঠ শেখানো যেত, তাহলে হয়তো ধর্ষণের হাত থেকে অনেক মেয়ের জীবন বাঁচত৷
তনুশ্রী, সংগীত শিল্পী
বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর সমাজের নিরবতা ধর্ষণের মতো অপরাধকে উৎসাহিত করছে৷ ধর্ষণ প্রতিহত করতে প্রয়োজন অপরাধীর কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন সমাজে সচেতনতা বাড়ে, অপরাধীরা আতঙ্কে কাঁপেন আর ভিকটিমরা পান আশার আলো৷
ড. নাভিন মুরশিদ, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
ধর্ষণ ‘যৌন ইচ্ছা’ নয়, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার নৃশংস হাতিয়ার। এর শিকার কেবল নারীই নয়, শিশু ও পুরুষরাও হন। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ একদিকে নারীদের ছোট করে দেখে, অন্যদিকে পুরুষদের ‘জোর-জবরদস্তি’ করাকে পুরুষত্ব এবং অধিকার হিসেবে ভাবতে শেখায়—যার কারণে নারীপুরুষ নির্বিশেষে অধিকার খাটাতে ধর্ষণ ব্যাবহার করা হয়। মানুষের মধ্যে অন্যের ‘না’-কে সম্মান জানানোর মানসিকতা তৈরি হয় না।
ডাঃ তানজির রশিদ সরণ, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ
ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্মিলিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার৷ সবার আগে দরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করা৷ ধর্ষণ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং সবার জন্য কঠোর বিচার নিশ্চিত করা৷ ধর্ষণের মতো এমন একটা গর্হিত অপকর্মের জন্য মৃত্যুদণ্ডই সঠিক কিনা এটা ভাববার বিষয়৷
কাজী নওশাবা আহমেদ, অভিনেত্রী, পরিচালক এবং সমাজকর্মী
শৈশব থেকেই নিপীড়ন শুরু হয় এবং অনেক সময় সেটি নিজের ঘরেই৷ আত্মীয়ের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পর পরিবার শেখায় চুপ থাকতে৷ সমাজ লজ্জার বোঝা অপরাধীর নয়, ভুক্তভোগীর কাঁধে তুলে দেয়৷ এই সংস্কৃতি এখনো ভাঙেনি৷ রাষ্ট্র এখনও ধর্ষণের মতো অপরাধে এমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেনি যা দেখে অপরাধী ভয় পাবে৷ এছাড়া বিনোদনের নামে এমন সব কনটেন্ট প্রচার হচ্ছে যা নারীকে অবমাননার মনোভাব উসকে দেয়৷
ডা. সিফাত নাহার, মেডিকেল অফিসার
সময়ে মেডিকেল পরীক্ষা না হওয়া তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া পরিচালনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়৷ অনেক পুরুষই একজন নারীর সাফল্য বা তার স্বাধীন চলাফেরা মেনে নিতে পারে না৷ তখন তারা ধর্ষণকে হাতিয়ারের মতো ব্যবহার করে৷ আধুনিক প্রযুক্তির কারণে আমরা বিভিন্ন ধরনের বিকৃত বিনোদনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি, যার ফলে ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা বাড়ছে৷ এই ধরনের অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে রাষ্ট্রীয়ভাবে বেশি বেশি প্রচার করতে হবে৷
ইসাবা শুহরাত, সংগঠক, শেকল ভাঙার পদযাত্রা
ধর্ষণ প্রতিরোধে দরকার কাঠামোগত পরিবর্তন৷ এর মধ্যে থাকতে পারে বিচার-ব্যবস্থার সংস্কার৷ এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলকে সর্বোচ্চ কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক করা, ধর্মীয় উসকানি বা নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে৷ আর ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড জনপ্রিয় দাবি হলেও এটি ভুক্তভোগীর জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে৷
মোছাম্মৎ নাছিমা আকতার, প্রোগ্রাম কর্ডিনেটর
ধর্ষণ প্রতিরোধে শিশু ও তরুণদের জন্য যৌন শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন, আলোকিত রাস্তাঘাট, গণপরিবহনে নিরাপত্তা এবং সিসিটিভির ব্যবহার বৃদ্ধি করা উচিত৷ বেশি বেশি করে অপরাধীর তথ্য প্রকাশ করা এবং শাস্তি এমন হওয়া উচিত যা ভবিষ্যতের অপরাধীদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা হয়ে দাঁড়ায়৷
ইশরাত হাসান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
জিরো টলারেন্স নীতিই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধানের পথ৷ ২০২০ সালে সরকারিভাবে আইনি সংশোধনের মাধ্যমে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের সংযোজন করা হয়েছিল৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কঠোর আইন থাকলেও বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতির অভাব, পুলিশের গাফিলতি ও তদন্তে অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ভিকটিম-ব্লেইমিং-এর কারণে ধর্ষণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না৷