আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ওনার রিটায়ারমেন্টের পর। আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতেন, কিন্তু হাসিনার শাসনামলের কট্টর সমালোচক ছিলেন। জীবনে কোনোদিন আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের কমিটিতে যুক্ত হননি, কোনো মিছিল-মিটিংয়ে যাননি। কিন্তু নৌকা ছাড়া অন্য কোনো মার্কাতে ভোটও দেননি। শেষ দিকে এসে হাসিনার অপশাসন দেখে তিনি খুবই মন খারাপ করে থাকতেন।
ভদ্রলোকের মূল আপত্তি ছিল দুর্নীতি নিয়ে। বলতেন, ‘‘এরা কিন্তু কাজ-কর্ম খারাপ করছে না। কেবল যদি দুর্নীতির রাশটা একটু টেনে ধরতে পারতো...!''
মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, বিভিন্ন ফ্লাইওভার, হাইওয়েতে বাজারগুলোতে ওভারপাস করে দেওয়া—এসবে তিনি খুবই খুশি ছিলেন। বলতেন, ‘‘সাধারণ মানুষ এসবের সুফল পাচ্ছে। খুবই ভালো কাজ। কিন্তু দুর্নীতিটা যদি একটু কম হতো!''
এস আলমের ব্যাংক ডাকাতি, শেয়ার বাজারে সালমান রহমানের কারসাজি, হলমার্ক দুর্নীতি, বেসিক ব্যাংকে লুটপাট, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, পুলিশের সাবেক আইজি বেনজির আহমেদের বিপুল সম্পদ অর্জন, কর কর্মকর্তা মতিউরের দুর্নীতি—এসব খবর যখন প্রকাশিত হতে থাকে, তিনি হতাশ হয়ে যান। বলেন, ‘‘সরকারের সহযোগিতা না থাকলে, এত বড় বড় দুর্নীতি করা আসলে প্রায় অসম্ভব। সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, তারাও আসলে নানাভাবে জড়িয়ে যায় এসবে। বলে—তুমি লুটপাট করো, আমাকে কিছু শেয়ার দিও, তাহলেই হবে।''
হাসিনা সরকারের একেবারে শুরুর দিকের একটা বড় দুর্নীতির কথা স্মরণ করি। সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক কেলেঙ্কারির কথা মনে আছে? সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে যায় প্রায় অপরিচিত হলমার্ক গ্রুপ! তাহলে ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়া কি এতই সোজা? কাকে ঋণ দিচ্ছে, কিসের বিপরীতে দিচ্ছে, ব্যাংক কি সেসব খোঁজ-খবর করে দেখে না? নিয়ম তো অনেক কিছুই আছে। সেসব নিয়ম পালিত হয়েছে বলেও কাগজ-কলমে দেখানো হয়ছে, যদিও বাস্তবে তার সঙ্গে গরমিলই বেশি। এই পুরোই হাওয়ার ওপর সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা কয়েকজন বাটপারের হাতে তুলে দেওয়া হলো, এর পিছনে তাহলে কে কে আছে? প্রশ্নটা আসলে হওয়া উচিত—কে কে নেই? পুরো ব্যাংকের কর্তাপর্যায়ের সকলেই এতে জড়িত ছিল। ব্যাংকের বোর্ডও জড়িত ছিল। আর সবার উপরে সেই সময় উচ্চারিত হতো প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার নাম। সবাই মিলে-মিশে তারা লুঠ করেছে এই অর্থ!
বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর এ নিয়ে মামলা হয়েছে, তদন্ত হয়েছে। কয়েকজন জেলে গেছে, কেউ কেউ এখনো জেলে আছে, অনেকে আবার মরেও গেছে। কিন্তু টাকা কি সরকারের কোষাগারে ফিরেছে? না, ফেরেনি। আর বিচারও শেষ হয়নি এখনো।
এরপর দিন গেছে, বছর গেছে। দুর্নীতি, চুরি আরো পরিশীলিত হয়েছে, টাকার অঙ্ক বড় থেকে আরো বড় হয়েছে। বেসিক ব্যাংকে লুটপাট হয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ছিলেন সেই দুর্নীতির মূল হোতা। এ নিয়েও মামলা হয়েছে, কিন্তু বাচ্চুর কিছু হয়নি। বাচ্চুর পিছনে ছিলেন হাসিনার আত্মীয়-স্বজন। তাই কিছু হয়নি। বাচ্চু এখন পলাতক। হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে হয়তো এখন তাকে পালিয়েও থাকতে হতো না। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে যায় রিজার্ভ থেকে। এর জন্য কে দায়ী সেটাই এখনো উদঘাটিত হয়নি। কারো কোনো সাজাও হয়নি। সেই সময়ে যিনি গভর্ণর ছিলেন, তারও কিছু হয়নি। মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় তাকে দেখা যায় জাতিকে জ্ঞান বিতরণ করতে।
দুর্নীতির মাধ্যমে সবচেয়ে বড় ডাকাতিটা করেছে সম্ভবত এস আলম গ্রুপ। এরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের ৮-৯টি ব্যাংকের শেয়ার ও পরিচালনাকে নিয়ন্ত্রণ করতো। ফলে সহজেই তারা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়েছে, যার কিছুই তারা আর পরিশোধ করেনি। এরপর নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাচারকৃত সেই অর্থ তারা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাইয়ে বিনিয়োগ করেছে। হাসিনা সরকারের ভূমি মন্ত্রীর বিশাল সম্পদ রয়েছে বৃটেনে—এমন খবরও কিন্তু আওয়ামী লীগের শেষ আমলে।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এতসব খবর একের পর এক প্রকাশিত হলেও তাদের কারোর বিরুদ্ধেই কোনো ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি উল্টো তার পিয়ন কিভাবে চারশ' কোটি টাকার মালিক হয়েছে সেই গল্প বলে পুরো বিষয়টিকেই হালকা করে দিয়েছিলেন! এই অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলেও এক উপদেষ্টার এপিএসের তিন শতাধিক কোটি টাকা অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। বিচার কতটুকু কী হবে কে জানে? তবে মানুষজন যে এসব নিয়ে তেমন একটা আশাবাদী নয়, সেটা বোঝা যায়।
পিয়নের চারশ কোটি টাকা কিংবা এপিএসের তিনশ এগারো কোটি টাকার আলোচনা যখন হয়, তখন বোঝা যায় চৌর্যকর্মে জড়িয়ে গেছে আরো বড় বড় রথি-মহারথিরাও। রাজনীতিক, প্রশাসন, সরকার, এমনকি বিচারবিভাগ পর্যন্ত, সব একাকার হয়ে গেছে। প্রতিটি বড় বড় দুর্নীতিতে জানা গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততার কথা। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা যখন টাকার বিনিময়ে অপরাধে জড়িয়ে যায়, তখন আর পুলিশের উপর মানুষের আস্থা কীভাবে থাকে? আবার যখন জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সম্পদ লুটে নেয়, তখন মানুষের ভোটের উপর থেকেই আস্থা উঠে যায়। বড় বড় দুর্নীতিতে যখন মন্ত্রী,এমপিদের সম্পৃক্ততার কথা জানা যায়, তখন সাধারণ মানুষ মনে করে, রাজনীতির ধর্মটাই বুঝি এমন।
হাসিনার আমলে জনগণের একটা কমন দুঃখ ছিল ভোট দিতে না পারার। শেখ হাসিনা এমন একটা পদ্ধতি তৈরি করে নিয়েছিলেন, জনগণকে আর ভোট দিতে যেতে হতো না। কেউ যদি গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধু হয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার চেষ্টা করতেন, তাকে বরং বিপদে পড়তে হতো। সেই দুঃসহ পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। হাসিনা তার সাঙ্গ-পাঙ্গসহ বিদায় হয়েছেন। সামনে একটা নির্বাচন হাতছানি দিচ্ছে। হাসিনার দল সে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে—এমনটি মনেও হচ্ছে না। তারপরও যে কোনো মানুষকে জিজ্ঞাসা করুন, তারা যে নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি উচ্ছসিত সেটা মনে হয় না। আমি অনেককেই বলতে শুনেছি, ভোট দিয়ে আর কী হবে? যারা আসবে, তারা কি খুব ভালো কিছু? দেখেছি তো তাদেরকে। লুটপাট কি কিছু কম করেছে তারা? সবই তো একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
দেশের চলমান রাজনীতির জন্য, রাজনীতিবিদদের জন্য, এর চেয়ে মর্মান্তিক বাস্তবতা আর কিছু হতে পারে না। মানুষ মনে করে, রাজনীতিবিদ মানেই বাটপার। তারা নিজের ভালোর জন্য যতটা চিন্তা করে, তার শতভাগের একভাগও করে না জনগণের জন্য। ক্ষমতায় যায়ই তারা নিজের আখের গোছানের জন্য। একবার মন্ত্রী বা এমপি হতে পারলে আর কিছু লাগে না, পায়ের ওপর পা তুলে চলতে পারবে এক-দুই প্রজন্ম। এমন উদাহরণ এই সমাজে অহরহই দেখা যায়।
কেন দুর্নীতি এমন সর্বব্যাপী হয়ে উঠতে পেরেছে? আসলে দুর্নীতি এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে সমাজে বিবেচিত হয় না। দুর্নীতির কারণে বড় ধরনের সাজা হয়েছে—এমন উদাহরণ বিরল। বরং সবাই জানে, ওই লোকটি দুর্নীতিবাজ, তারপরও সমাজে সে সম্মানিত। নির্বাচনে দাঁড়ালে সবাই আবার তাকেই ভোট দেয়। তার এমন অপকর্মের জন্য কেউ কেউ যে তাকে ঘৃণা করে না, তাও নয়। কিন্তু যারা অপছন্দ করে, তারা সেটা প্রকাশ করতে ভয় পায়। এই ভয়টা তৈরি করেছে সমাজ নিজে। দুর্নীতিবাজের যদি বিচার হতো, তাহলে হয়তো বিবেকবান মানুষকে এতটা ভয় ও বেদনা নিয়ে থাকতে হতো না। মাঝে মধ্যে আমরা বিগত সরকারের দুএকটা দুর্নীতির বিচার দেখি। কিন্তু সেগুলো যতটা না দুর্নীতির কারণে, তারচেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক কারণে। ওই একই দুর্নীতি হয়তো তার নিজের দলের কেউ করেছে, কিন্তু তার কিছু হচ্ছে না। বিচার হচ্ছে প্রতিপক্ষ দলের ব্যক্তিটির। এসব বিষয় যে
সাধারণ মানুষ বোঝে না, তা নয়। তার ঠিকই বোঝে, সমাজে সুবিচারের ব্যবস্থা নেই বলে প্রতিবাদ করতে পারে না।
বাংলাদেশে দুর্নীতির আর একটা বড় উপসর্গ হচ্ছে দ্বৈত নাগরিকত্ব। এদেশের ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট সিংহভাগ ব্যক্তিই বাংলাদেশের পাশাপাশি অন্য কোনো উন্নত দেশের নাগরিক। ওই দেশগুলোতে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অনেকেই সেখানে বসবাসও করেন। তাদের একটা পরিকল্পনাই থাকে- শেষ বয়সে যেয়ে ওই সেকেন্ড হোমে থিতু হওয়ার। আর সে কারণেই বাংলাদেশটাকে তারা বিবেচনা করে লুটপাটের ক্ষেত্র হিসাবে। লক্ষ্য থাকে, এখানে লুটপাট করে বিদেশে সম্পদ পুঞ্জিভূত করার।
এই প্রবণতার একটা টাটকা উদাহরণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এমপিদের সদলবলে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া। বিদেশে যারা গেছে, তারা কেউই কিন্তু অভাবে নেই। রাজার হালে আছেন। যে অর্থ সম্পদ দেশ থেকে পাচার করে নিয়ে গেছে, তা কেবল বসে বসে খেলেও তাদের দুই পুরুষ চলে যাবে।
এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বর্তমানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যেও। এই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো পদেই এরকম দ্বৈত নাগরিক, কিংবা অন্য কোন দেশে বসবাসের অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তি রয়েছে। এই সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর, স্বাভাবিক নিয়মেই ধারণা করা যায়, এদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ হবে। তখন কিন্তু প্রয়োজনীয় অনেককেই আর জবাবদিহিতার জন্য এদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
শুরুতে যে ভদ্রলোকের কথা বলেছিলাম, তিনি এ বছরের প্রথম দিকে মারা গেছেন। মৃত্যুর দু' সপ্তাহ আগে তাঁর সঙ্গে একবার ঘন্টা খানেকের জন্য বসেছিলাম। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গকে ছাপিয়ে গিয়েছিল দেশের নানা ঘটনা নিয়ে আলোচনা। হাসিনা সরকারের পতনে উনি অতটা দুঃখিত ছিলেন না। বলতেন—‘‘এটা ওদের প্রাপ্য ছিল। এটা ওরা অর্জন করেছে।'' হাসিনাকে সরিয়ে নতুন যারা এসেছে, তাদেরকে নিয়েও তিনি তেমন একটা আশাবাদী ছিলেন না। বলেছিলেন, ‘‘এরা তেমন কিছু করতে পারবে না। প্রথম কিছুদিন চুপচাপ থাকবে, বিষয়গুলো বুঝে নিতে চাইবে। তারপর তাদের আশপাশে যারা আছে, তারাই নানাভাবে এদেরকে প্রভাবিত করেবে দুর্নীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে। এভাবেই শুরু হবে। তারপর চলতে থাকবে।'' এটাই এ দেশের নিয়ম, এখানকার সংস্কৃতি। আসলে দেশে দুর্নীতি এখন একটা সামাজিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। মাটির অনেক গভীরে ঢুকে গেছে দুর্নীতির বীজ। নুতন যারা এসেছে, তারা তো এই মাটিরই সন্তান। তাহলে এদের কাছ থেকেই বা ভিন্ন ফল আশা করা কেন?
ভদ্রলোক মরে গেছেন। মরে বেঁচে গেছেন। আমরা বেঁচে আছি। আর প্রতিদিন আমাদের প্রত্যাশাগুলোর মৃত্যু হচ্ছে।
আচ্ছা, সমস্যাটা কি তাহলে মাটির?