দুর্ঘটনায় পড়া চীনা যুদ্ধ বিমান নিয়ে বিতর্ক
২২ জুলাই ২০২৫এই মডেলের বিমানগুলো কারা ব্যবহার করছে, এদের লাইফ টাইম কত, এ ধরনের বিমান ব্যবহার উপযোগী কী না এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে ডয়চে ভেলে৷
সোমবারের ওই দুর্ঘটরায় এখন পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটসহ ১০টি হাসপাতালে ১৬৫ জন এখনো ভর্তি আছেন। তাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছিন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান।
আইএসপিআর আরো জানিয়েছে, ওই বিমানটি ছিলো পুরোপুরি একটি যুদ্ধ বিমান। এবং ঘটনার সময় প্রশিক্ষণের কাজে ছিলো। বিমানটির মডেল এফটি-৭ বিজিআই। সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এটি বিধ্বস্ত হয় বলে জানিয়েছে আইএসপিআর৷ বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরও নিহত হয়েছেন।
এফ-৭ বিজিআই মডেলের বিমান
সামরিক সরঞ্জাম-সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট গ্লোবাল সিকিউরিটি ডট কমের তথ্য বলছে এফটি-৭ বিজিআই মডেলের বিমানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন। এটি স্বল্প খরচে নির্মিত, এক ইঞ্জিনচালিত ও দুই আসনবিশিষ্ট একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। মূল সংস্করণ এফ-৭ এর জন্য পাইলটদের প্রস্তুত করতে এফটি-৭ বিজিআইয়ের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
চীন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এফ-৭ যুদ্ধবিমান তৈরি করে। ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে এফ-৭-এর কাঠামোগত পরীক্ষা সফলভাবে শেষ হয়। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে এর সফল পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন করেন চীনা বৈমানিকেরা। ১৯৬৭ সালের জুনে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) এটিকে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়।
বাংলাদেশ এসব যুদ্ধবিমান কবে কিনেছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি বিমান বাহিনী।
তবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন," বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে চীনের এই যুদ্ধ বিমান ১৯৮০ সালের দিকে যুক্ত হয়। ৪০ বছরেররও বেশি সময় ধরে চলছে। আর এফটি-৭ বিজিআই আগের মডেলের চেয়ে উন্নত। এগুলো ১৯৯০ সালের দিকে যুক্ত হয়। এগুলোর একটা লাইফ টাইম থাকে। কিন্তু ২০১৩ সালের পর চীন এই যুদ্ধ বিমান আর তৈরি করছে না। ওভারহল করে এর লাইফ বাড়ানো হয়। এই যুদ্ধ বিমান পকিস্তান আর শ্রীলঙ্কাও ব্যবহার করত, এখন আর করে না। চীন নিজেও এখন এর উন্নত ভার্সন ব্যবহার করে। এফটি-৭ আমাদের এখানে আর সম্ভবত উত্তর কোরিয়া এখনো ব্যবহার করছে।”
তিনি বলেন," আমাদের একটি পরিকল্পনা আগেই ছিলো এই যুদ্ধ বিমানগুলো রিপ্লেস করে আরো আধুনিক যুদ্ধ বিমান আনার। কিন্তু সেটা আর হয়নি। আমরা কয়েকটি মিগ-২৯ কিনেছি। তারপর আর যোগ হয়নি। এফটি-৭ আমাদের সবচেয়ে বেশি আছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন," আসলে লাইফ টাইম শেষ হয়ে গেলে সেই যুদ্ধ বিমান আর চলে না। ফ্লাই করে না। যেটা হয়েছে ইঞ্জিন থেকে শুরু করে অনেক কিছু পরিবর্তন করা হয়। এইভাবে লাইফ টাইম বাড়ানো হয়। আর এফটি-৭ দিয়েই অনেক বেশি ট্রেনিং হয়েছে। এটাই বেশি ব্যবহার হয়। যেটা বেশি ব্যবহার হয় সেটার দুর্ঘটনার হারও বেশি থাকে। এখন এটা কেন দুর্ঘটনায় পড়ল তা তো তদন্ত করেই বলা যাবে।'' '' আসলে এই যুদ্ধ বিমানের দাম কম। এটা কম খরচে তৈরি করা হয়েছে। এখন যদি জার্মান ইউরো ফাইটার কিনতে হয়। তার একটির দাম ৫০-৬০ বিলিয়ন ডলার। ফ্রান্স রাফায়েলের একটির দাম ৭০-৮০ বিলিয়ন ডলার। সেটা তো আমাদের দেশের পক্ষে অ্যাফোর্ড করা সম্ভব নয়। কী করবেন? আমাদের জন্য তো কঠিন হয়ে যাচ্ছে,” বলেন বিমান বাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তার।
চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মিতে নানা ধরনের চাহিদার ভিত্তিতে এফ-৭-এর বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংস্করণ তৈরি করে চেংদু এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন। এর কয়েকটি হলো এফ-৭ ই, এফ-৭ পি, এফ-৭ এম, এফ-৭ বিজিআই।
অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর মো. খালিদ হোসেন এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধ বিমান পরিচালনা করেছেন। তিন জানান," এই ধরনের যুদ্ধ বিমানের লাইফ টাইম ২৫ থেকে ৩০ বছর। কিন্তু বিষয়টি এমন নয় যে ৩০ বছর পর আর ব্যবহার করা যাবে না। এটা ওভারহলিং হয়। আর চীনা বিমান মানে এই নয় যে বডি থেকে সবকিছু চীনের তৈরি। আরো উন্নত দেশের যন্ত্রপাতিও লাগানো হয়। তবে এই যুদ্ধ বিমানের কমফর্ট একটু কম। আমাদের বিমান বাহিনীতে এই সিরিজের তিন ধরনের বিমান আছে। এরমধ্যে এফটি-৭ বিজিআই লেটেস্ট। এর দাম কম সত্য। কিন্তু দাম কম মানেই যে মান খারাপ তা কিন্তু নয়।”
তিনি জানান," প্রতিটি যুদ্ধ বিমান উড্ডয়নের আগেই সব ধরনের চেকিং হয়। ইঞ্জিন থেকে শুরু করে সব কিছু। আর প্রিওডিক চেকিং তো আছেই।”
আরও যেসব দুর্ঘটনা
বাংলাদেশে চীনে তৈরি এই সিরিজের যুদ্ধ বিমান আগেও দুর্ঘটনায় পড়েছে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের পাহাড়িপাড়া গ্রামে পাইলটসহ বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। এতে নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তখন সম্ভাব্য কারিগরি ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়।
২০১৫ সালের জুনে এফ-৭ এমবি ৪১৬ মডেলের একটি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিধ্বস্ত হয়। নিখোঁজ হন পাইলট তাহমিদ রুম্মান। এটি বিমান বাহিনীর জহুরুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেছিল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কয়েক মিনিট পর যুদ্ধবিমানটি পতেঙ্গা সৈকতের প্রায় ৬ নটিক্যাল মাইল দূরে সাগরে বিধ্বস্ত হয়।
২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রশিক্ষণের সময় টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ বিজি। এতে নিহত হন পাইলট আরিফ আহমেদ। এয়ারক্রাফটটি ঢাকা থেকে উড্ডয়নের ২৫ মিনিটি পর মধুপুরের রসুলপুর এলাকায় বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে যায়।
২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারে প্রশিক্ষণের সময় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দুটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রাশিয়ায় নির্মিত ইয়াক-১৩০ মডেলের দুটি বিমান বিধ্বস্ত হলেও চারজন বৈমানিক নিরাপদে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন।
২০১৫ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে তামান্না রহমান নামে এক পাইলট নিহত হন।
অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর মো. খালিদ হোসেন বলেন," যুদ্ধ বিমান কী কারণে দুর্ঘটনায় পড়ে তা আশপাশের আলামত দেখে ধারণা করা যায়। তবে এই যুদ্ধ বিমানের ফ্লাইট রেকর্ডার প্যাসেঞ্জার ফ্লাইটের মতো অত উন্নত ও শক্তিশালী নয়। ফলে সব তথ্য পাওয়া যায় না। আর দুর্ঘনার কারণ যদি বড় কিছু হয় তাহলে তা সার্কুলেট করা হয়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও এটা নিয়ে কনসার্ন থাকে। আগাম কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে তাও তারা জানায়। উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলেও সার্ভিস থাকে।''