দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর ওপর হামলা, নিরাপত্তায় গাফিলতি
২১ আগস্ট ২০২৫দিল্লিতে ভিআইপি-রা সকলেই কড়া নিরাপত্তার বলয়ে থাকেন। তার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী নিজের বাসভবনে আক্রান্ত হলেন, তাকে চড় মারা হলো, ধাক্কা দেওয়া হলো, চুল ধরে টানা হলো। তারপর নিরাপত্তা রক্ষীরা এসে মুখ্যমন্ত্রীকে বাঁচালেন। আক্রমণকারী যুবককে ধরা হলো। তাকে এখনও জেরা করা হচ্ছে। তার সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য সামনে আসছে।
তবে এর মধ্যে একটা বিষয় স্পষ্ট, মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তায় ঘাটতি ছিল। এই আক্রমণের একদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুখ্যমন্ত্রীকে জেড পর্যায়ের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। দিল্লি পুলিশ আর নয়, ইতিমধ্যেই তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র উদ্ধৃত করে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানাচ্ছে, প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তায় বড় ধরনের গাফিলতি ছিল। তাই তার নিরাপত্তার দায়িত্ব সিআরপিএফের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জনসুনবাই বা দিল্লির সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সমস্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি আলোচনার সময় এই ঘটনা ঘটে। সেখানেও নিরাপত্তা কর্মীদের ভূমিকা সন্তোষজনক ছিল না বলে সূত্র জানিয়েছে। তাই সিআরপিএফ এখন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে রেখা গুপ্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে তা ঠিক করবে।
মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা এতদিন দেখত দিল্লি পুলিশের সিকিউরিটি ডিভিশন। তারা অন্য মন্ত্রীদের সুরক্ষার দায়িত্বে আছে। দিল্লিতে পুলিশ হলো সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ফলে এখানে নিরাপত্তাসংক্রান্ত গাফিলতি থাকলে তার দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপরেই বর্তায়।
উদ্দেশ্য কী?
রেখা গুপ্তার আক্রমণকারী আবার গুজরাটের বাসিন্দা। কয়েকদিন আগে সে দিল্লিতে আসে। তার মা ভানু জানিয়েছেন, আক্রমণকারী রাজেশভাই কিমজিভাই সাকারিয়া কুকুরপ্রেমী। সুপ্রিম কোর্ট দিল্লির পথকুকুরকে সরিয়ে আশ্রয়স্থলে রাখার খবরে সে ক্ষুব্ধ হয়।
মা আরো জানিয়েছেন, রাজেশের মানসিক সমস্যা আছে। কিন্তু সে ওষুধ খেত না। এর বাইরে তিনি আর কিছু জানেন না।
রাজেশ রাজকোট থেকে আহমেদাবাদ হয়ে দিল্লি আসে। সে দিল্লির কোথায় কোথায় ঘুরেছে, কাদের সঙ্গে দেখা করেছে, কাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে, তা এখন পুলিশ খতিয়ে দেখছে। বিভিন্ন জায়গায় সিসিটিভি-র ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রাজেশ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ঢোকে তার এক আত্মীয় জেলে আছে দাবি করে তার বিষয়ে কথা বলার জন্য। তার হাতে কিছু কাগজপত্র ছিল। কিছু কাগজপত্র সে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে দেয়। পরে পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে, তার কোনো আত্মীয় জেলে নেই। তবে গুজরাটে তার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ আছে।
রাজেশ পেশায় অটোচালক। তার নামে গুজরাটে পাঁচটি মামলা আছে। তিনটি মদ পাচারের এবং দুইটি সরকারি কর্মীদের লাঞ্ছনা করার জন্য। কয়েকটি অভিযোগের বিচার হয়ে গেছে। সে খালাস পেয়েছে।
কিন্তু কোন উদ্দেশ্য নিয়ে সে রেখা গুপ্তাকে আক্রমণ করেছিল, সেই বিষয়ে পুলিশ মুখ খোলেনি। কাকতালীয় হলেও ঘটনা হলো, গুজরাট, দিল্লিতে বিজেপি-র সরকার এবং কেন্দ্রেও বিজেপি-র নেতৃত্বে এনডিএ সরকার।
তবে এই ঘটনা ঘটার পর বিজেপি-র কিছু নেতা আপের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলে। রাজেশ গুজরাটের এক আপ বিধায়কের ঘনিষ্ঠ বলে অভিযোগ করা হয়। এমনকী গুজরাটের আপ নেতার সঙ্গে রাজেশের ছবিও সামাজিক মাধ্যমে ঘুরতে থাকে। আপ অভিযোগ করে, ছবিটি জাল এবং কৃত্রিম মেধা বা এআইয়ের সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে।
আপ বিধায়কের অভিযোগ
দিল্লির আপ বিধায়ক অনিল ঝা অভিযোগ করেছেন, ''কোনো আক্রমণ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এটা তৈরি করেছেন। আমি তাকে অনেকদিন ধরে চিনি। উনি যখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন, আমি তখন সহ সভাপতি ছিলাম। আমি অনেকবার দেখেছি, তিনি যখন কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, তখন ব্যাগে গ্লিসারিন নিয়ে যেতেন। কথা বলার সময় তা চোখে লাগিয়ে নিতেন, যাতে চোখে জল এসে যায়। যখন আন্দোলন হত, তখন তিনি এক-আধটা চুল দেশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে নিতেন। তিনি নাটক করেন। শুরু থেকেই করেন।''
অনিল বলেছেন, ''এটাও নাটক। খবরের মধ্যে থাকতে হবে। কেউ যেন যমুনা নিয়ে প্রশ্ন না করে বসেন। জল নিয়ে প্রশ্ন না করেন, সেজন্য এই নাটক করা হয়েছে।''
আপ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজ টুইট করে বলেছেন, ''আগে কেজরিওয়ালের উপর যখন আক্রমণ হয়েছে, তখন দিল্লি পুলিশ মিডিয়ার মাধ্যমে এই প্রশ্ন প্লান্ট করাত যে, কেন মানুষ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে নারাজ? এখন সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী বদলে গেছে। এখন পুলিশ তাই বিভ্রান্ত।''
তবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতিশি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে বলেছেন, এই স হিংসতা মানা যায় না। গণতন্ত্রে ক্ষোভপ্রকাশের উপায় আছে। দিল্লি পুলিশ নিশ্চয়ই কড়া ব্যবস্থা নেবে।
কংগ্রেসের প্রশ্ন
দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি দেবেন্দ্র যাদব বলেছেন, ''দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী যখন এইভাবে আক্রান্ত হন, তখন সাধারণ মানুষ, বিশেষত নারীদের অবস্থা কী, তা বোঝাই যাচ্ছে। যদি মুখ্যমন্ত্রী নিজের বাড়িতে জনসুনবাইতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দিল্লির আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে।''
তার মতে ''এটা মুখ্যমন্ত্রীর সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিশাল গাফিলতি। এটা দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে যেমন প্রশ্ন তুলছে, তেমনই বহু এলাকায় মাদক ব্যবসার রমরমা ও সেই সংক্রান্ত অপরাধ নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।''
রেখা গুপ্তার বক্তব্য
রেখা গুপ্তা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে বলেছেন, তাকে হত্যা করার জন্য সুপরিকল্পিত চক্রান্ত হয়েছিল। তবে শুভানুধ্যাায়ীরা যেন এখন তার সঙ্গে দেখা করতে না আসেন। খুব তাড়াতাড়ি তিনি আবার আরো বেশি উদ্যম ও নিষ্ঠা নিয়ে কাজ শুরু করবেন। জনসুনবাই চলবে।
'গাফিলতি তো আছে'
দীর্ঘদিন ধরে দিল্লির খবর করা নবভারত টাইমসের সাবেক সিটি এডিটর গুলশন ক্ষত্রী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''রাজেশ তো রেইকি করে গেছে। তাও নিরাপত্তা বাহিনী কোনো ধ্যান দেয়নি। নিরাপত্তায় গাফিলতি তো আছেই। তবে তার কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না বলে বড় ক্ষতি হয়নি। কিন্তু একজন নারী মুখ্যমন্ত্রীকে এইভাবে আক্রমণ করাটা সুরক্ষার ক্ষেত্রে বড় গাফিলতি।''
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তাও মনে করেন, নিরাপত্তা গাফিলতি আছে। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, ''নিরাপত্তা গাফিলতি আছে বলেই বিজেপি-র পক্ষে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি হইচই করা সম্ভব নয়।''
জিএইচ/এসজি