দাগি শিক্ষকদের তালিকায় নেতা ঘনিষ্ঠরা
২ সেপ্টেম্বর ২০২৫দীর্ঘ অপেক্ষার পর এসএসসি প্রকাশ করেছে এক হাজার ৮০৬ দাগিদের নাম। সেই তালিকায় একগুচ্ছ এমন নামের সন্ধান মিলেছে, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে রয়েছেন নেতা, বিধায়ক, দলের পদাধিকারীরা। নেতা-নেত্রীদের ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধূ কিংবা দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও রয়েছেন।
দাগিদের তালিকা বেরিয়ে যাওয়ার পরে জোরদার বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিজেপির দু-একজন নেতার নাম তালিকায় থাকলেও চর্চা মূলত শাসক দলের নেতাদের নিয়ে।
নেতার পুত্রবধূ, কন্যার নাম তালিকায়
পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন আয়োজিত ২০১৬ সালের স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্ট (এসএলএসটি) নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল প্রথম থেকেই। বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের দাবি ছিল, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মে অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হচ্ছে। কখনো বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে। অভিযোগ ছিল, অর্থের বিনিময়ে অযোগ্যরা তো বটেই, রাজনৈতিক নেতার মেয়েও চাকরি পেয়েছেন। এমনকী পরীক্ষায় অকৃতকার্য প্রার্থীদের নিয়োগ করা হয়েছে।
দাগিদের তালিকায় যে নামগুলো উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম শম্পা ঘোষ। তিনি পানিহাটি তৃণমূল বিধায়ক ও বিধানসভার মুখ্য সচেতক নির্মল ঘোষের পুত্রবধূ। এ প্রসঙ্গে নির্মল সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, "সত্য বেরোবে। কিছু না দেখে বলতে পারব না।" তালিকায় রয়েছে উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমানের কন্যা রোশনারা বেগমের নাম। হামিদুল বলছেন, "আমার বলার কিছু নেই। ওটা ডিপার্টমেন্ট দেখছে, ডিপার্টমেন্ট বুঝবে।"
কোচবিহারের মেখলিগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক পরেশ অধিকারীর নাম অনেক আগেই উঠে এসেছিল। দাগিদের তালিকায় রয়েছে তার মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর নাম যার চাকরি আগেই চলে যায়। পরেশ বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাননি।
মানতে নারাজ যারা
অনেকে মানতে রাজি নন যে তারা দুর্নীতি করেছেন। অনেকে নিজেদের যোগ্যতার সপক্ষে সওয়াল করেছেন। অনেকে আদালতে যাওয়ার কথা বলছেন।
কুহেলি ঘোষ রাজপুর সোনারপুর পুরসভা এলাকার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর। তার নাম তালিকায় উঠে আসতে তিনি বলেছেন, "আমি আগেই মামলা করেছিলাম। সিবিআইকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম, আমাকে যে কোনো তদন্তকারী সংস্থা ডাকুক, আমি যাব। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ ডাকেনি। তালিকায় আমার নাম কেন আছে, সেটা পরিষ্কার নয়।"
নিউ ব্যারাকপুর পুরসভার উপপুরপ্রধান স্বপ্না বিশ্বাসের মেয়ে শতাব্দী বিশ্বাস এই তালিকায় রয়েছেন। স্বপ্না বলেন, "আমার মেয়ে ভূগোল নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেয়েছে। তার পরে বিএড করেছে। দুর্নীতি নয়, পরীক্ষায় পাশ করেই চাকরি পেয়েছিল।"
পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় জলচক ২ নম্বরের তৃণমূল সভাপতি অজয় মাঝির নাম তালিকায় রয়েছে। তিনি সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, "আমি যোগ্য না অযোগ্য সেটা স্কুলের শিক্ষক ও পড়ুয়ারা বিচার করবে। যোগ্যতা প্রমাণের জন্য যা করতে বলবেন, করব। এসএসসি কেন এমন করল, তা জানি না।"
পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা ১ ব্লকের রামজীবনপুরের কাউন্সিলর প্রিয়াঙ্কা পাঁজা এই তালিকায় রয়েছেন। তার বাবা সুজিত পাঁজা সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, "তৃণমূল নেতার ছেলেমেয়ে হলে কি তাদের চাকরি পাওয়ার অধিকার থাকবে না? আমার মেয়ে সব পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে। বিএড করেছে, পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছে। কোনো অসৎ উপায় অবলম্বন করেনি। কীভাবে নাম ঢুকল, তা জানি না। আমরা আদালতে যাব।"
জেলায় জেলায় অনেক নাম
দুর্নীতি শুধু শহর মফস্বল নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়েছে। হুগলির খানাকুলের জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য বিভাস মালিক ও তার স্ত্রী সন্তোষী মালিক দাগিদের তালিকায় রয়েছেন।
হুগলিরই তৃণমূল নেত্রী, সাবেক জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ শাহিনা সুলতানা, খানাকুলের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য শেখ নইমুল হোসেনের স্ত্রী নমিতা আদকের নাম রয়েছে। এরা মুখ খুলতে চাননি।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের তৃণমূল নেত্রী সন্ধ্যা মন্ডলের মেয়ে প্রিয়াঙ্কা মন্ডলের নাম দাগিদের তালিকায় ঠাঁই পাওয়ার পড়ে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বাড়ি ছেড়ে তারা অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। একইরকম ভাবে বালুরঘাট পুর এলাকার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর দীপান্বিতা দেব সিংহের নাম তালিকায় ওঠার পরে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তিনি বাড়িতে নেই।
পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের সাবেক নেতা অতনু গুছাইত, তাপস মন্ডল, সুব্রত সিংহ রায়ের জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে এসেছে তালিকা প্রকাশের ফলে।
বিজেপি নেতা-নেত্রী
বীরভূম জেলা বিজেপির কোষাধ্যক্ষ সুরজিৎ সরকারের স্ত্রী লক্ষ্মী বিশ্বাসের নাম দাগিদের তালিকায় উঠে এসেছে। তাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। উত্তর দিনাজপুর জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি অসীমকুমার মৃধার ভাই অনুপ কুমার মৃধার নাম রয়েছে। বিষয়টি বিচারাধীন বলে কিছু বলতে চাননি অসীম।
যোগ্যদের কী হবে
দাগিদের তালিকা দেরিতে হলেও প্রকাশিত হওয়ায় যোগ্যরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। অযোগ্যরা চিহ্নিত হওয়ায় শিক্ষক সমাজও স্বস্তিতে।
শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী ডিডাব্লিউকে বলেন, "নতুন করে বলার কিছু নেই যে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রী বিধায়করা নিজেদের লোকজনদের দুর্নীতি করে তালিকায় ঢুকিয়েছেন। অন্যান্যদের কাছ থেকে টাকাপয়সা নিয়ে অযোগ্যদের চাকরি দিয়েছেন। এই দুর্নীতি প্রকাশ্যে যাতে না আসে, সেটা আড়াল করার জন্য এই টালবাহানা। আমরা চাই না যে দুর্নীতির মাধ্যমে যারা পেয়েছেন চাকরি, তাদের একজনও যেন বহাল থাকেন।"
বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের পক্ষে আবু নাসের ডিডাব্লিউকে বলেন, "এই লিস্ট যেটা বেরিয়েছে, এটা নিয়ে আমাদের মাতামাতি তেমন কিছু নেই। এই লিস্ট আমরা ২০১৯ সাল থেকে দেখে আসছি। ১৯ এর পর ২২ -২৩ সালেও সেই একই লিস্ট দেওয়া হয়েছিল সিবিআই যখন নাইন টেন- ইলেভেন টুয়েলভ এর টার্মিনেনেট করল, তখনও সেই একই লিস্ট দিল। শুধুমাত্র ওএমআর দুর্নীতি যারা করেছিল ও যারা র্যাঙ্ক জাম্প করেছিল তাদের লিস্ট দিয়েছে। এসএসসি এমন ভাবে তালিকা বের করেছে, যাতে কেউ সহজে বুঝতে না পারে। কোন সাবজেক্ট বা ক্যাটাগরি ভাগ করে দেয়নি।"
তালিকা প্রকাশের পরে তৃণমূলের অস্বস্তি আরো বাড়ল। সিনিয়র সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে তৃণমূলের অস্বস্তি নতুন কোনো বিষয় নয়। পরেশ অধিকারীর মেয়ের চাকরি আগেই চলে গিয়েছিল। যেহেতু এটি বিচারাধীন বিষয়, তাই শাসক দল চাইছিল যে সিবিআই তালিকা প্রকাশ করুক। তারা নিজেদের কাঁধে বন্দুক রাখতে চাইছিল না। তবে তৃণমূলের দুর্নীতির তুলনায় এখন বড় প্রশ্ন, যদি অযোগ্যদের চিহ্নিত করে তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয়, তাহলে কেন যোগ্যদের আবার পরীক্ষায় বসতে হবে? এই প্রশ্নের যদি সমাধান করা যায়, সবাই খুশি হবেন।"
যোগ্য চাকরিহারা মঞ্চের আন্দোলনকারী শিক্ষকদেবাশিস অধিকারী বলেন, "শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা কম। গ্রুপ সি ও ডি তালিকা প্রকাশিত হলে নেতাদের আরো ঘনিষ্ঠজনের নাম বেরিয়ে আসবে। সিবিআই রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রুপ সি ও ডিতে দুর্নীতির পরিমাণ ৫৪ শতাংশ। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে যেটা সাত শতাংশের মতো।"