‘তৌহিদী জনতার' কাজ সমর্থন করছেন না দুই মাওলানা
৬ মার্চ ২০২৫ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘‘কাউকে ওড়না পরানো, বোরখা পরানো - এই মোরাল পুলিশিংয়ের কাজ কেউ কাউকে দেয়নি৷ এটা তৌহিদী জনতার কাজ হতে পারে না৷ আমরা ইসলামের আহ্বান জানাবো৷ ভালো ও সৎ কাজের আহ্বান জানাবো৷ কিন্তু কাউকে বাধ্য করা, জোর করা কোনো ভালো কাজ নয়৷ ইসলাম এটাকে সমর্থন করে না৷ আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান ও স্বাধীনতা দিয়েছে৷ সেই স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া যায় না৷''
মাওলানা রহমান বলেন, ‘‘আমার ধারণা কেউ বা কোনো মহল এই তৌহিদী জনতার ব্যানার নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে৷ আবার কেউ তাদের ব্যবহার করছে৷ তাদের জ্ঞানের স্বল্পতাও হতে পারে৷ তারা আসলে ইসলামের বদনাম করছে৷ সরকারের এটা দেখা উচিত৷''
তিনি বলেন, ‘‘যারা একাত্ববাদে বিশ্বাসী তারা সবাই তৌহিদী জনতা৷ এই নামে আলাদা কোনো গ্রুপ নেই৷ যারা ঈমানদার, যারা মুসলামান তারা সবাই তৌহিদী জনতা৷ ফলে এইভাবে তৌহিদী জনতা শব্দটির অপব্যবহার ঠিক না৷ এটাকে ব্যানার হিসাবে ব্যবহার করে বিতর্কিক করা চরম নিম্নমানের কাজ৷''
‘তৌহিদী জনতার' পরিচয়ে সবশেষ ঘটনাটি ঘটে বুধবার রাতে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে ওড়না ঠিক করার কথা বলে হেনস্তা করায় বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক কর্মচারী আসিফ অর্নব আটক হওয়ার পর বুধবার রাতে ‘তৌহিদী জনতার' ব্যানারে শাহবাগ থানা ঘেরাও করা হয়৷ তারা হেনস্তাকারীকে ছেড়ে দেয়ার চাপ দেন৷ থানা তাকে না ছাড়লেও বৃহস্পতিবার তাকে আদালত থেকে জামিন দেয়া হয়েছে৷ জামিনের পর তৌহিদী জনতা তাকে ফুলের মালা আর পাগড়ি দিয়ে বরণ করে নেয়৷
জানা গেছে, ছাত্রীটিকে সমঝোতায় বাধ্য করে ওই জামিনের ব্যবস্থা করা হয়৷ ওই শিক্ষার্থী এখন হলবন্দি হয়ে পড়েছেন৷ ফোনে অসংখ্য কল আসায় তিনি ফোনও বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন৷ মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতেও বাধ্য হয়েছেন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন, ‘‘সে মামলা প্রত্যাহারের জন্য স্বেচ্ছায় সমঝোতা করেনি, তবে তাকে বাধ্যও করা হয়নি৷ পরিস্থিতির কারণে সে হয়তো সমঝোতা করেছে৷ তার বিভাগের শিক্ষক ছিলেন, ডিন ছিলেন৷'' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা ঘটনা জানার পরই ব্যবস্থা নিয়েছি৷ মামলা হয়েছে৷ ওই কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তার বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে৷ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে তার কাজ থেকে বিরত রাখতে বলা হয়েছে৷'' ‘‘এখানে যা হয়েছে তা সব জাস্টিস৷ তবে ক্যাম্পাসে নারীদের নিরাপত্তায় আমরা সতর্ক আছি,'' বলেন তিনি৷
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনিম তানজিলা বলেন, ‘‘আসলে এখানে সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির৷ তারা আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সক্রিয় নয়৷ আবার পরিস্থিতি বুঝে তারা চুপ থাকে৷ গা বাঁচিয়ে চলে৷ আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না যে একজন ছাত্রীকে হেনস্তা করার পরও ওই কর্মচারী জামিন পেয়েছেন৷ তার সঙ্গে সমঝোতা করতে ওই ছাত্রীতে বাধ্য করা হয়েছে৷ সে এখন আরো বিপদের মুখে আছে৷''
হেফাজতে ইসলামীর নায়েবে আমীরের আহ্বান
হেফাজতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, ‘‘তৌহিদী জনতার ব্যানারে কোনো বিতর্কিত বা আইন বহির্ভূত কাজ করা যাবে না৷ কোনো অযৌক্তিক বা অশান্তির কাজ করা যাবে না৷ এটা আমরা সমর্থন করি না৷ এটা যদি কেউ করেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা ইসলামের কথা বলি, ইসলামের বিধি-নিষেধের কথা বলি৷ কিন্তু জোর করে চাপিয়ে দেই না৷ জোর করা আমাদের কাজ নয়৷ আমরা অন্যদের জোর জবরদস্তি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি৷''
তৌহিদী জনতা কারা জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামীর নায়েবে আমীর বলেন, ‘‘যত মুসলমান আছে তারা সবাই তৌহিদী জনতা৷ আর হেফাজতে ইসলাম তো সকল তৌহিদী জনতার সংগঠন৷ কখনো কখনো হয়তো হেফাজতে ইসলামের ব্যানার ব্যবহার করতে সংকোচ বোধ করেন৷ অথবা নেতৃবৃন্দের অনুমতি নেয়া হয়নি৷ তখন অনেকে তৌহিদী জনতার ব্যানারে কাজ করেন৷ বা কোনো কর্মসূচি পালন করেন৷ জাতীয় পার্টি, বিএনপি বা কোনো রাজনৈতিক দলও তৌহিদী জনতা৷ সবাই তৌহিদী জনতা৷''
উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
তৌহিদী জনতা ও তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা, তা জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে সফল হয়নি ডিডাব্লিউ৷
তবে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় টুরিষ্ট পুলিশের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা এ নিয়ে প্রশ্ন করলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জবাব না দিয়ে চলে যান৷ অবশ্য গত মাসে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা তৌহিদী জনতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা সব জনতাকেই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি৷ শুধু এক জনতা তো নয়, বিভিন্ন জনতা বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করছে৷ সব জনতাকেই নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আমাদের৷ এখন কোন জনতা কিসের জন্য সমস্যা করছে আমরা সেগুলো দেখার চেষ্টা করছি৷''
অতীতে সরকারের পক্ষ থেকে তৌহিদী জনতার ব্যাপারে কড়া অবস্থানের কথা জানানো হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না৷ উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার এক ফেসবুক পোস্টে আগে ‘তৌহিদী জনতার' নামে যারা হামলা করেছেন তাদের সতর্ক করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘এ কঠোরতার হুঁশিয়ারি অপরাধীদের জন্য, যারা তৌহিদের কথা বলে নিপীড়ন করছে, নৈরাজ্য করছে৷ কিন্তু আগে যেভাবে ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সাধারণ মুসলিমদের নিপীড়ন করা হতো, যার শিকার আমিও হয়েছি তা কোনো মতেই আর পুনরাবৃত্ত হবে না৷''
ছদ্মবেশে উগ্রবাদীতা?
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘তৌহিদী জনতা কারা এটা বলা কঠিন৷ তবে এটার ছদ্মবেশে উগ্রবাদীতা থাকতে পারে৷ যারা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চায় না৷ যারা পরিচয় গোপন করে কাজ করতে চায় তারা এই ধরনের ব্যানার ব্যবহার করতে পারে৷''
‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী হেনস্তার ঘটনায় একজনকে আটকের পর রাতে তৌহিদী জনতার ব্যানারে থানায় গিয়ে একদল মব তৈরি করে৷ তারা আসলে এভাবে প্রকাশ্যে আসতে চায় শক্তি দেখাতে চায়,'' বলেন তিনি৷
তার কথা, ‘‘সরকার শুধু এইসব ঘটনায় বিবৃতি দেয়, ব্যবস্থা নেয় না৷ সরকারকে এগুলো কঠোর হাতে দমন করতে হবে৷''
সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, ‘‘কিছু লোক আছে যারা মারপিট করতে চায়, ঝামেলা করতে চায়, মব তৈরি করতে চায়৷ কিন্তু এগুলো আইনের দৃষ্টিতে অন্যায়৷ তাই যখন এই কাজটি তারা করতে যায় তখন নিজেদের তৌহিদী জনতা পরিচয় দেয়৷ তারা বোঝাতে চায় যে তারা আল্লাহর আইনে কাজ করছে৷ তারা একটা সাপোর্ট বা সুবিধা পাওয়ার জন্য এটা করে৷ কিন্তু এটা আল্লাহর আইনে এটা বৈধ কিনা এই প্রশ্ন কিন্তু আপনি তাদের করতে পারবেন না৷ তার এভাবে পার পেয়ে যায়৷''
‘‘সরকার নিজেরা তামাশা করে, তামাশা দেখে৷ এই সরকার একটা দায়িত্বহীন সরকার৷ আগে আমি বলতাম এই সরকার একটা নন-সিরিয়াস সরকার৷ এখন আমি বলছি দায়িত্বহীন সরকার৷ এটা হলো এখন মূল সমস্যা৷''
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের নারীর পোশাক, নারীর চলাচল, নারীর স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থা নেয়ার কথা ছিলো, যদি সেটা অন্যের ক্ষতি না করে৷ সেটা না করে যারা রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আছেন তারা অন্যায় চর্চ্চাকে হতে দিচ্ছে৷ এটা এই রাষ্ট্রের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে৷''
‘‘নারীদের সঙ্গে তৌহিদী জনতার নামে যে আচরণ করা হচ্ছে সেখানে রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ এটা এই বার্তা দেয় যে, এই রাষ্ট্র নারীদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে না৷ নারীরার তাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিকারে রাষ্ট্রের সমর্থন পাচ্ছেনা,'' বলেন তিনি৷
‘তৌহিদী জনতা' পরিচয়ে কিছু বিতর্কিত কাজ
‘তৌহিদী জনতার' কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উত্তরায় বসন্ত উৎসব বন্ধ করে দিতে হয়েছে৷ একই দিনে টাঙ্গাইলের ভুঞাপুরে বসন্ত ও ভালবাসা দিবসে ফুল বিক্রি করায় ফুলের দেকানে হামলা হয় তৌহিদী জনতার ব্যানারে৷ আর ওই ভয়ে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি সেখানে পূর্ব নির্ধারিত ঘুড়ি উৎসব বাতিল করা হয়৷ ঘুড়ি উৎসব বিরোধী একটি লিফলেট ছড়িয়ে দেয়ার পর ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷
১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে লালন স্মরোণসব বন্ধ করা হয় হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে৷ এর আগে নারায়ণগঞ্জে লালন ভক্তদের মিলনমেলা পন্ড করা হয়েছিলো হামলা চালিয়ে৷
১০ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের বই রাখায় ‘সব্যসাচী প্রকাশনা'র স্টলে গিয়ে মব তৈরি করে তৌহিদী জনতা৷ ওই স্টলটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়৷
২৮ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নারী ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের প্রতিবাদে তৌহিদী জনতার ব্যানারে মাঠে ভাঙচুর চালানো হয়৷ তারা পরের দিনে ওই ফুটবল ম্যাচ হতে দেয়নি৷
গত ১৮ জানুয়ারি পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৪ আগস্টের পর থেকে ৪০টি মাজারের ৪৪ বার হামলা হয়েছে৷ সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে৷ এখানে ১৭টি মাজারে ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছে৷ এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ১০টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে সাতটি হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ ঘামলার ঘটনায় ফৌজদারি মামলায় মোট ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
আর বিশ্ব সুফি সংস্থা ২৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮০টি মাজারে হামলা হয়েছে৷