তালেবানকে কোন দেশ কতটা স্বীকৃতি দিচ্ছে?
৫ জুলাই ২০২৫বৃহস্পতিবার থেকে মস্কোর আফগান দূতাবাসের সামনে উড়ছে তালেবানের সাদা পতাকা৷ ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসেই অবশ্য মিলেছিল এর ইঙ্গিত, সন্ত্রাসবাদীদের তালিকা থেকে তালেবানকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেয় রুশ প্রশাসন৷
উল্লেখনীয় বিষয় হলো, বিশেষজ্ঞদের একাংশ বরাবর দাবি করে এসেছেন, যে প্রায় ২০ বছর পরে তালেবানের উত্থানের পিছনে পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল রাশিয়া ও চীনের৷ বৃহস্পতিবার রাশিয়ার সিদ্ধান্তের পরে সেই দাবি আরও জোরালো হয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ৷
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়ছে আফগানিস্তানের গুরুত্ব৷ ২০২১ সালে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট আশরফ গনি সরকারকে হটিয়ে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পরেই সিদ্ধান্ত হয়, এই সরকারকে বিশ্বের কোনও দেশই স্বীকৃতি দেবে না৷ ফলে বলা চলে, প্রায় চার বছর পরে রাশিয়ার এই কৌশলগত সিদ্ধান্ত ভূ-রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে৷ অন্য দেশগুলিও সম্ভবত তালেবানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কে আরও জোর দেবে৷ বিশেষ করে, ইরানের সঙ্গে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার সীমান্ত থাকায় বর্তমান পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে৷
চীনের ভূমিকা
সরাসরি স্বীকৃতি না দিলেও অনেক দেশই ২০২১ সালের পর থেকে আফগানিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেছে৷ এই সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা, এমনকি তালেবান নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূতকে স্বীকৃতি দেওয়া৷ এই বিষয়ে সর্বপ্রথম পদক্ষেপ করে চীন৷ ২০২৪ সালে বেইজিংয়ে তালেবান রাষ্ট্রদূতকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়৷ তবে, তালেবান সরকারকে অবশ্য তারা এখনও স্বীকৃতি দেয়নি৷ এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার তালেবান নিযুক্ত আফগান দূত গুল হাসানকে মস্কোর অতিথি বলে স্বীকৃতি দিয়েছে রুশ সরকার৷ রাশিয়ার এই স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করেছে চীন৷
ভারতের ভূমিকা
অন্যদিকে, তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক বরাবর বজায় রেখেছে ভারত৷ পাশাপাশি, হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে পাঠিয়েছে ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা৷ আফগান নারী ও শিশুদের মানবাধিকার খর্ব হওয়ায় ভারত কড়া সমালোচনা করেছে ৷ ২০২২ সালেই কাবুলে চালু হয় ভারতীয় দূতাবাস৷ ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রী দুবাইয়ে দেখা করেন তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে৷ সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত থামতেই ফের ‘আফগান তাস' সামনে আনে ভারত৷ মুত্তাকির সঙ্গে সরাসরি ফোনে আলাপচারিতায় যোগ দেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর৷ ২০২১ সালের পরে দুই দেশের দুই মন্ত্রীর এই প্রথম কথা৷ কূটনীতিকদের দাবি, তালেবান ও ভারতের সম্পর্ক আগামী দিনে অন্য খাতে বইলেও বইতে পারে৷ তবে সবই হবে ভারসাম্য রেখে৷ এ দিকে, আফগানিস্তানের সীমান্ত লাগোয়া পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে হামলা চালানো সশস্ত্র গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবানকে আশ্রয় দিচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তানের এই অভিযোগ থাকায় আফগান-পাক সম্পর্কের ফাটল ক্রমশ চওড়া হচ্ছে৷ পাকিস্তান ও তালেবানের সম্পর্ক বরাবরই বেশ জটিল ও বহুমাত্রিক৷
জার্মানি কী ভাবে দেখছে রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তকে?
২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই একটি সাক্ষাৎকালে তালেবান মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছিলেন, জার্মানির সঙ্গে একটা দৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করার কথা তাঁরা ভাবছেন৷ যদিও ২০২১ সালেই কাবুলে জার্মান দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ পাশাপাশি একাধিক বার তালেবানের মানবতাবিরোধী পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছে জার্মান প্রশাসন৷ বার্লিন স্পষ্ট জানিয়েছে, কোনও ভাবেই তালেবানকে সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয় তারা৷ অর্থাৎ, রাশিয়ার পদক্ষেপ ও জার্মানির পদক্ষেপের মধ্যে ফারাক রয়েছে৷
যদিও বৃহস্পতিবারই জার্মানির অন্তর্বর্তী মন্ত্রী আলেকজ়ান্ডার ডোব্রিন্ট জানিয়েছেন, তিনি তালেবানের সঙ্গে সরাসরি সংলাপ শুরু করতে চান৷ তবে তার পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক এক বিশেষ কারণ৷ যে সমস্ত আফগান জার্মানিতে অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করাই হবে সেই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য৷
বর্তমানে জার্মানি ও তালেবানের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখে তৃতীয় পক্ষ কাতার৷ ২০২৪ সালের অগস্ট মাসে সেই পক্ষের সহায়তায় অভিযুক্ত ২৮ জন আফগান নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছিল জার্মান সরকার৷ তার পর থেকে আর সেই পদক্ষেপ কার্যকর হয়নি, যা ক্রমশ ইন্ধন জোগাচ্ছে জার্মানির নিজস্ব রাজনৈতিক চাপান-উতোরে৷ বিশেষ করে, গত বছর জার্মানির বহু জায়গায় হামলার ঘটনা ঘটেছে, সন্দেহের তালিকায় রয়েছে একাধিক আফগানের নাম৷ জার্মানির নতুন সরকারের তাই সিদ্ধান্ত, যত দ্রুত সম্ভব বিদেশি অপরাধীদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো এবং অবৈধ অভিবাসন রুখে দেওয়া৷
ডোব্রিন্ট এও জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের পাশাপাশি সিরিয়াতেও শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা শুরু করতে চান তাঁরা৷ ২০১২ সাল থেকে তা বন্ধ হয়ে রয়েছে৷ চেষ্টা করা হচ্ছে সিরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের, তবে এখনও উত্তর আসেনি৷ প্রসঙ্গত, ১৫ বছর পরে বৃহস্পতিবার সিরিয়ার এক অভিবাসীকে তাঁর দেশে ফেরত পাঠাল অস্ট্রিয়া৷ গত এপ্রিল মাসেই অস্ট্রিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গেয়ারহার্ড কার্নার ও জার্মানির তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী ন্যান্সি ফেজার দামাস্কাস সফরে যান৷ এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিযুক্ত ও বিপজ্জনক সিরীয় অভিবাসীদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা৷
পশ্চিমা দুনিয়ার প্রায় সমস্ত দেশ ও অ্যামেরিকা বরাবরই জানিয়েছে, তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে তারা রাজি নয়৷ একই সুর শোনা গিয়েছে ফ্রান্স ও চেকিয়ার কথাতেও৷ স্রেফ মানবাধিকার রক্ষার কারণেই কৌশলগত সংলাপ চলে ২০২১ সাল থেকে৷ অ্যামেরিকা ২০২১ সালের পর থেকে আফগানিস্তানের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ফান্ড জব্দ করেছে, নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে একাধিক তালেবান নেতার উপর৷ ক্যানাডা ও তাজিকিস্তান সরাসরি সন্ত্রাসবাদী বলেই মনে করে তালেবানকে৷ রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সারা বিশ্বের একাধিক মানবাধিকার সংগঠন৷ তাদের দাবি, তালেবান সরকার এ বার আফগানিস্তানের নারী ও শিশুদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার চালাতে পারে৷
রাশিয়ার ‘ডমিনো' প্রভাব
তবে কূটনীতিকদের দাবি, রাশিয়া মূলত মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াতে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে চায়৷ এই সিদ্ধান্ত সেই কারণেই৷ পাশাপাশি বাণিজ্য, শক্তিসম্পদ, অবকাঠামো-সহ একাধিক বিষয়ে তালেবদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের শক্তি আরও বাড়াতে চায় রাশিয়া৷ আর এই সিদ্ধান্তের বিশ্বব্যাপী প্রভাব পড়তে পারে, যা ঠিক ‘ডমিনো'-র মতো৷ অর্থাৎ, চীন, মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলি ধীরে ধীরে এই একই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতে পারে৷ অন্য খাতে বইতে পারে ভূ-রাজনীতি৷
এসটি/এসবি (ডিপিএ, এএফপি)