ঢাকা থেকে বিমান ঘাঁটি ও সেনানিবাস সরিয়ে নেয়ার দাবি
২৩ জুলাই ২০২৫পাশাপাশি এই ঘটনায় জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা৷
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তরায় বিমানবন্দরের কাছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে সোমবার ভেঙে পড়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি জঙ্গি বিমান৷ এই ঘটনায় নিহত ২৯ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে সরকার৷
বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এই বিমান দুর্ঘটনার পর মঙ্গলবার সারাদেশে শোক পালন করা হচ্ছে৷ দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে এবং সব উপসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে৷
সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলা বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি থেকে উড়ান শুরু করে জঙ্গি বিমানটি৷ তারপরেই ভেঙে পড়ে স্কুলভবনের উপর৷
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘‘নিহতদের মধ্যে অন্তত ২৫টি শিশু রয়েছে৷ এছাড়া একজন শিক্ষিকা ও বিমানচালক নিহত হয়েছেন৷''
তিনি আরও জানান, দগ্ধ হয়ে ৮৮ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন৷ এই ঘটনায় গভীরভাবে শোকপ্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷
অন্যতম প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা
ঢাকায় বিধ্বস্ত এফ-৭ বিজিআই বিমানটি পুরোপুরি একটি যুদ্ধবিমান৷ চীনের চেংডু জে-৭/এফ-৭ বিমানের একটি উন্নততর সংস্করণ৷
২০১১ সালে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে ১৬টি এমন বিমান আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করে৷ ২০১৩ সালের মধ্যে সেই আমদানি সম্পন্ন হয়৷
পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, সোমবারের ঘটনা গত কয়েকদশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হলেও অতীতে বেশ কয়েকবার এই ধরনের যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে৷
২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান ঢাকার ৮৩ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলের একটি গ্রামে ভেঙে পড়ে৷ মৃত্যু হয় বিমানচালকের৷ তিনি বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগ রয়েছে বুঝতে পেরে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন৷
২০১৫ সালের জুন মাসে বন্দর শহর চট্টগ্রামের কাছে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান৷ বিমানচালকের কোনও খোঁজ মেলেনি৷
২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলে প্রশিক্ষণ চলাকালীন দুর্ঘটনায় পড়ে একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান৷ ঢাকা থেকে উড়ান শুরু করার মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যে ভেঙে পড়ে সেটি৷ মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাতে আগুন লেগে যায়৷
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বসবাসরত অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান মনে করেন, এত দুর্ঘটনাসত্ত্বেও স্রেফ ‘‘অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা, ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা পরিকাঠামো রক্ষা এবং আধুনিক বিমান আমদানির সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ার কারণে'' বাংলাদেশের বিমান বাহিনী এখনও এই বিমান ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইউরোফাইটার বা জেএফ-১৭ জেট কেনার পরিকল্পনায় অগ্রগতি থাকলেও বাংলাদেশের সীমিত বাজেট এবং জটিল ক্রয় প্রক্রিয়ার কারণে এফ-৭ এর ফেজ আউটের দেরি হচ্ছে৷''
তিনি আরও বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে রক্ষণাবেক্ষণ ও দ্রুত আধুনীকিকরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়৷ কিন্তু এগুলোর করতে গেলে অর্থনৈতিক ও লজিস্টিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়৷''
ঢাকা থেকে সেনানিবাস ও বিমান ঘাঁটি সরানোর দাবি
সোমবার বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পরপরই অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন তোলেন, জনবহুল রাজধানীর মাঝে কেন সেনানিবাস রাখতে হবে? দাবি উঠেছে বিমান ঘাঁটিও সরানোর৷
ঢাকাকে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর বলা হয়৷ এখানে প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি মানুষ বাস করেন৷ এই শহরের মধ্যে রয়েছে সেনানিবাস ও বিমান ঘাঁটি৷
নিরাপত্তা বিবেচনায় এগুলো জনাকীর্ণ ঢাকা শহর থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে৷
ঢাকার আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘‘সেনানিবাসে যে বিধিনিষেধ আছে, অন্যান্য মানুষ ঢুকতে পারে না, এটা আরও সমস্যাজনক৷ দুই কাতারের মানুষ কেন থাকবে যারা সেনানিবাসে ঢুকতে পারেন, এবং অন্যারা পারেন না৷ রাস্তাঘাট অন্য সবার জন্য অবরুদ্ধ৷ এগুলোর কোনো যুক্তি দেখি না৷''
প্রায় একই প্রশ্ন তোলেন ঢাকার সাংবাদিক জাইমা ইসলাম৷ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘‘ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ বেসামরিক এলাকায় সত্যিই কি সামরিক প্রশিক্ষণ করা উচিত?''
‘যান্ত্রিক গোলযোগে' বিমান ভেঙে পড়েছে, সামরিক বাহিনীর এই দাবির প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে দ্য ডেইলি স্টারের এই সিনিয়র রিপোর্টার ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমরা সকলে জানি বেসামরিক এলাকায় সামরিক প্রশিক্ষণ চালানো হচ্ছিল৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে বাবা-মা কখনওই ভাবতে পারেন না যে তাদের বডিব্যাগে করে ফিরিয়ে আনতে হবে৷''
‘ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমান প্রশিক্ষণ নিষিদ্ধ করা উচিত'
ঢাকায় অবস্থিত বিমান বাহিনীর ঘাঁটি কয়েক দশক ধরে প্রশিক্ষণের জন্য দেশের প্রধান বেসামরিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ব্যবহার করে আসছে৷
পর্যবেক্ষকরা জানান যে বিমান চলাচলের পরিভাষায় ‘ফাইনাল' নামে পরিচিত রানওয়ের ‘এপ্রোচ পাথ' ৬ থেকে ৮ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত৷ রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা উত্তরার যে বিদ্যালয়ে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে সেটি রানওয়ের ‘টাচডাউন পয়েন্ট' থেকে মাত্র ১.৯ নটিক্যাল মাইল (৩.৫ কিলোমিটার) দূরে অবস্থিত৷
সারা হোসেন মনে করেন, সোমবারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনবহুল এলাকার উপর বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান উড়ান নিষিদ্ধ করে সরকারের একটি প্রশাসনিক আদেশ জারি করা উচিত৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাটি এড়ানো সম্ভব ছিল৷ ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে প্রশাসনিক আদেশ জারি করা উচিত৷''
‘নগরপরিকল্পনা উন্নত করা প্রয়োজন'
সারা হোসেন জানান, এই ধরনের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণে অনুমোদন দেন কারা, এবং অনুমোদনের আগে ঝুঁকি পর্যালোচনা করা হয়েছিল কিনা তা তদন্ত করে বের করে দোষীদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন৷
তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিক খান মনে করেন, জনবহুল এলাকায় ‘‘ইচ্ছে করে প্রশিক্ষণের'' আয়োজন করে না বিমান বাহিনী৷ তিনি সমস্যা হিসেবে ‘‘দুর্বল নগর পরিকল্পনাকে'' সামনে এনেছেন৷
তিনি বলেন, ‘‘এরকম একটি ‘হাই রিস্ক এভিয়েশন জোন'-এ কীভাবে স্কুল তৈরির অনুমতি পাওয়া যায়, সেদিকে আলোকপাত করলে দুর্বল নগর পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়৷ বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় সরকারকে ‘রানওয়ের কাছাকাছি বসতি স্থাপনের' অনুমতি দেওয়ায় জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে৷''
‘‘সাধারণ মানুষের আরও উন্নত নগর পরিকল্পনা ও ‘জোনিং' আইনের আরও কড়া প্রয়োগের দাবি তুলতে হবে,'' বলেন খান৷
আরাফাতুল ইসলাম/এসটি