ডাকসু নির্বাচন: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের লিটমাস টেস্ট?
৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫রাজনৈতিক মহলসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন এবার আলাদা মাত্রা পেয়েছে। যারা এই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন।
সবশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের পর সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে হওয়া সেই নির্বাচনও দেশজুড়ে সাড়া ফেলেছিল। ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া নুরুল হক নুর।
এবারও কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং সবশেষে সরকার পতনের সফল আন্দোলনের এক বছর পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
যে কারণে এবারের নির্বাচনটি বিশেষভাবে দেখা হচ্ছে
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনের আগে এই ছাত্রসংসদ নির্বাচনটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি লিটমাস টেস্ট। অতীতের নির্বাচনগুলোর চেয়ে নানা দিক দিয়ে এবারের নির্বাচনকে আলাদাভাবে দেখা হচ্ছে।
এবার প্রার্থী সংখ্যা অনেক বেশি। নারী প্রার্থীও আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় বেশি। তবে নারী প্রার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এবার ডাকসুতে ২৮টি পদের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন ৪৭১ জন। ১৮টি হল সংসদে নির্বাচন হবে ১৩টি করে পদে। হল সংসদের ২৩৪টি পদের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন এক হাজার ৩৫ জন। সব মিলিয়ে এবার ভোটারদের ৪১টি ভোট দিতে হবে। মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। নারী ভোটর প্রায় অর্ধেক ১৮ হাজার ৯৫৯ জন।
ভিপি পদে মোট প্রার্থী হয়েছেন ৪৫ জন। তাদের মধ্যে পাঁচজন নারী। ডাকসুর বিভিন্ন পদে মোট নারী প্রার্থী আছেন ৬২ জন।
এবারের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর বাইরে অনেক স্বতন্ত্র প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। শিক্ষার্থীদের অনেকেই রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের বাইরে গিয়ে ভোট দেয়ার চিন্তা করছেন বলে জানিয়েছেন ডয়চে ভেলেকে।
শিক্ষার্থীরা যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিলা তাসনিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এবারের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর একক আধিপত্য নাই। অনেক স্বতন্ত্র প্রাথী আমাদের মনোযোগ কাড়তে পেড়েছে। আবার অনেক সংগঠন আছে নতনু যারা জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এবার বহু মত আর পথের নির্বাচন হচ্ছে আমাদের ক্যাম্পাসে।”
তবে তিনি মনে করেন, "নির্বাচনের প্রচারে সংঘাত সংঘর্ষ না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক অপপ্রচার হয়েছে। আর নারী প্রার্থীরা সেখানে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের হুমকির মতো ঘটনাও ঘটেছে।”
"বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও আমরা জানি নানাভাবে কয়েকটি সংগঠন টাকা ছড়িয়েছে,” অভিযোগ করেন তিনি।
আরেক শিক্ষার্থী খালিদ ইবনে মিজান বলেন, "আসলে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ কাকে ভোট দেবে তা বোঝা কঠিন। কারণ তারা ক্যাম্পাসে পুরনো ধারার ছাত্র রাজনীতি দেখতে চায় না। এই নির্বাচনের মাধ্যমে তারা সেটার প্রকাশ ঘটাতে চায়। জুলাই আন্দোলনের স্পষ্ট প্রভাব আছে এই নির্বাচনে। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আমরা এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষই মনে হয়েছে।”
"অনেক দিন ডাকসু নির্বাচন হয়নি। তাই এবারের নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে,” বলেন শিক্ষার্থী শুভ সেন। তিনি মনে করেন, "প্রচারে যেমন নতুনত্ব ছিলো, তেমনি বাড়াবাড়ি ছিলো না। আর শিক্ষার্থীরা রাজনীতির চেয়ে ছাত্রদের কল্যাণ চিন্তাকে মাথায় নিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের বাইরে অনেক প্রার্থী আলোচনায় আছেন।”
শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডাকসু নিয়ে বিপুল প্রত্যাশা
১৯৮৯ সালে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হয়েছিলেন ডা. মুশতাক হোসেন। তিনিও মনে করেন, এবারের নির্বাচন নানা দিক থেকে আলাদা।
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "এবারের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য হলো একটি গণঅভ্যুত্থানের পর নির্বাচন হচ্ছে। কিন্তু এর আগে ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের আগে নির্বাচন হয়েছে। তখন ডাকসুর নেতারা নির্বাচিত হওয়ার পর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়েছেন। আর এবার গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর নির্বাচন হচ্ছে। ফলে এখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি আলাদা প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হয়েছে। ফলে এবার প্রচুর প্রার্থী। নারী প্রার্থী কম হলেও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।”
"আমার কাছে মনে হয়েছে, আগে যেমন দুইটি প্যানেল প্রাধান্য বিস্তার করত। তারা রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের প্যানেল। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের মধ্যেই হতো। কিন্তু এবার অনেক প্যানেল। অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী। আর শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ রাজনৈতিভাবে চিন্তা করছে না, তারা ছাত্রদের অধিকারের কথা ভাবছে,” বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, "২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে যে এক নতুন অবস্থার তৈরি হয়েছে সেই প্রেক্ষাপটে এবারের ডাকসু নির্বাচন। আওয়ামী লীগ আমলে যে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে তা ছিলো এক পাক্ষিক। অন্যদের অংশগ্রহণের সুযোগ তারা সংকুচিত করেছে। কিন্তু এবারের নির্বাচন অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আর আগের নির্বাচনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার যে ধারা তৈরি হয়েছে, এবার সেই ধারাটি প্রবল হয়েছে। অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাদের প্রচার কৌশলও আকর্ষণীয়।”
"আর সংবাদমাধ্যমেরও একটা ব্যাপক প্রচারের কারণে এবারের নির্বাচন বেশি আলোচনায়। মিডিয়া অনেক কাভারেজ দিচ্ছে,” বলেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের টেস্ট কেস, নজর রাখছে রাজনৈতিক দলগুলোও
প্রতিটি দলই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম নির্বাচন এবং সামনেই জাতীয় নির্বাচন থাকায় ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়াকে সরকারের একটা পরীক্ষা হিসাবে দেখছে।
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক এবং সাবেক এমপি ব্যারস্টার রুমিন ফারহানা মনে করেন বেশ কয়েকটি কারণে এবার ডাকসু নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের আগ্রহ।
তার মতে, "১৭ বছর পরে দেশে একটি নির্বাচন হচ্ছে। সেটা ডাকসু নির্বাচন। আওয়ামী লীগের আমলে তো কোনো নির্বাচন হয়নি। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে এই প্রথম কোনো নির্বাচন। এটা কোনো জাতীয় নির্বাচন নয়। তারপও এই কারণে এই নির্বাচন নিয়ে সবার মধ্যে এত আগ্রহ।”
"এই নির্বাচনকে সবাই একটি টেস্ট কেস হিসাবে নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন থাকে, প্রচার-ভোট কতটা সুষ্ঠু হয়, তা সবাই দেখতে চায়,” বলেন তিনি।
রুমিন ফারহানা মনে করেন, "জামায়াত ও এনসিপি জানে তারা জাতীয় নির্বাচনে তেমন কোনো ইমপ্যাক্ট রাখতে পারবেনা। তাই তারা মরিয়া হয়ে চাচ্ছে এই নির্বাচনে তারা যেন একটা ভালো ফলাফল নিয়ে ফিরতে পারে। যাতে জাতীয় নির্বাচনে ভালো ফল না করতে পারলে তারা তখন অভিযোগ করতে পারবে যে আমরা তো ডাকসু নির্বাচনে ভালো ফল করেছি, তাহলে জাতীয় নির্বাচনে নয় কেন?”
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং ঢাকা মহানগরের (দক্ষিণ) আমীর মো. নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানসহ অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে দেশের মানুষের আকর্ষণ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর এই প্রথম কোনো নির্বাচন। এটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় কী না তাও দেশের মানুষ দেখতে চায়। এই নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা, নিরপেক্ষতা নিয়ে যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে অন্য নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে তো জাতীয় নির্বাচনের কথা আছে।''
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, "গণঅভ্যুত্থানের পরে হওয়ার কারণে এই নির্বাচন গুরুত্ব পাচ্ছে। আর ডাকসুর নেতৃত্ব পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখে। নির্বাচনে যারা প্রার্থী তাদের অনেকেই জাতীয় নেতা। তারা গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ফলে এই নির্বাচনের প্রতি সবার এত আগ্রহ।”
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, "দীর্ঘদিন ভোটের পরিবেশ ছিলো না। গণঅভ্যুত্থানের পরে একটা ভোট হচ্ছে- এই কারণে এটা নিয়ে আগ্রহ বেশি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গণআন্দোলনে অংশ নিয়েছে। তাই এই নির্বাচনও তাদের আকাঙ্খার ফসল। ফলে তাদেরও আগ্রহ বেশি, ভোটে দাঁড়ানো, ভোট দেয়া আদের আগ্রহ।”
জাতীয় রাজনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে?
ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কী না, এ নিয়ে অবশ্য রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন ডাকসু নির্বাচন কীভাবে হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন থাকে তা দিয়ে বোঝা যাবে আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে।
জামায়াত নেতা নূরুল ইসলাম বুলবুল মনে করেন, "এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়েও মানুষের মনে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। আর এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলে পুরো রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।”
এনসিপি নেতা মনিরা শারমিন মনে করেন, ডাকসু নির্বাচন "জাতীয় নেতৃত্ব কেমন হবে তা পছন্দ করার নির্বাচন।”
তিনি বলেন, "আমার মনে হয় এই নির্বাচন আগামী জাতীয় নির্বাচনেও একটা বড় রকমের প্রভাব ফেলবে। এই নির্বাচন থেকে বোঝা যাবে তরুণরা কেমন নেতৃত্ব পছন্দ করেন। আর এরপর যে ছাত্র সংসদ গুলোর নির্বাচন হবে যেমন, জাকসু, রাকসু সেখানেও এর প্রভাব পড়বে।”
তবে বিএনপি নেতা রুমিন ফারহানা এ বিষয়ে একমত নন। তার মতে, "জাতীয় নির্বাচন আর ডাকসু নির্বাচন এক নয়। দুইটির ভোটার, প্রার্থী সব আলাদা। ফলে ডাকসুর কোনো প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে না।”
রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন ডাকসুতে জয়ী হলে জাতীয় পর্যায়ে সেই দলের প্রভাবও বাড়বে বলে মনে করেন রুহিন হোসেন প্রিন্স। তবে তিনি মনে করেন, "সেটা জাতীয় রাজনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।”
ডা. মুশতাক হোসেন ডিডাব্লিউকে বলেছেন, "ডাকসুতে যারা জিতবে তারা যে জাতীয় নির্বাচনেও ভালো করবে এই ধরনের সরলীকরণ করা যাবে না। তবে এই নির্বাচনের মাধ্যমে বোঝা যাবে, ছাত্ররা কোন ধরনের রাজনীতি পছন্দ করে। তারা কেমন জাতীয় রাজনীতি চায়, কেমন নেতৃত্ব চায়। তার একটা প্রতিফলন এই নির্বাচনে পাওয়া যাবে।”
এবার কোনো রাজনৈতিক দলের প্যানেলের একক প্রাধান্য না থাকার পরও যদি কোনো দল এককভাবে ভালো ফল করতে পারে, সেটা জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ।
তবে তিনি বলেন, "আমি মনে করি কোনো একক প্যানেল নয়, ডাকসুর নেতৃত্ব হবে মিশ্র।”২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে হতাহতের ঘটনার বিচার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগও নিষিদ্ধ রয়েছে। ফলে এবার ডাকসু নির্বাচনে এই সংগঠনটি অংশ নিতে পারছে না।