ড. ইউনূসের সফরে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের গতি বৃদ্ধির প্রত্যাশা
৩০ মার্চ ২০২৫অধ্যাপক ইউনূস চারদিনের চীন সফরের পর দেশে ফিরেছেন শনিবার৷ এই সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের একটি চুক্তি এবং আটটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে৷
সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে দুই দেশের কালজয়ী সাহিত্য ও শিল্পকর্মের অনুবাদ ও সৃজন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও খবর আদান-প্রদান, গণমাধ্যম, ক্রীড়া এবং স্বাস্থ্য খাতে বিনিময়ে সহযোগিতা৷ আর বাংলাদেশ ও চীন
অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি৷
এর পাশাপাশি, প্রধান উপদেষ্টার দ্বিপাক্ষিক চীন সফরে দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি বিষয়ে সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়েছে৷ এগুলো হলো- বিনিয়োগ আলোচনা শুরু করা, চীনের জন্য বাংলাদেশে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু, মোংলা বন্দরের আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ, একটি রোবট ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ এবং একটি কার্ডিয়াক সার্জারি গাড়ি অনুদান৷
এ ছাড়াও চীনের সরকার ও কোম্পনিগুলোর কাছ থেকে ২১০ কোটি মার্কিন ডলারের অনুদান, ঋণ ও বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি মিলেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷ তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চীনের ৩০টি কোম্পানি বিশেষ অর্থনেতিক অঞ্চলে ১০০ কোটি ডলার বিনিযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ মোংলা বন্দর আধুনিকায়নে ৪০ কোটি ডলার দেবে চীন৷ চীনা শিল্প ও অর্থনেতিক অঞ্চল উন্নয়নে ৩৫ কোটি ডলার , ১৫ কোটি ডলার প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে৷
২০২৮ সাল নাগাদ চীনে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে৷ এই সুবিধা ২০২৬ সাল পর্যন্ত ছিলো৷ চীনে বাংলাদেশ আম ও কাঁঠাল রপ্তানির সুযোগ পাবে৷ মে-জুন মাস থেকে আম রপ্তানি শুরু হতে পারে৷ তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সহযোগিতা চেয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ এই প্রকল্পে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে চীন৷ তবে আগে থেকেই এই সহযোগিতা চেয়ে আসছিল বাংলাদেশ৷ অধ্যাপক ইউনূস নদী ও পানি ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ৫০ বছরের মাস্টার প্ল্যানও চেয়েছেন চীনের কাছে৷
‘স্থবির বিষয় সচল হবে'
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘‘এই সফরের ইতিবাচক দিক হলো চীন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসকে একটি নিয়মিত সরকারের প্রধান হিসাবে গুরুত্ব দিয়েছে৷ আর চীনের সঙ্গে কিছু বিষয় স্থবির হয়ে গিয়েছিলো সেগুলো আবার সচল হচ্ছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরে আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা স্থবিরতা দেখা গিয়েছিলো৷ বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ হচ্ছিলো৷ কিন্তু চীন সফরই প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর প্রফেসর ইউনূসের৷ আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন গতি সঞ্চার হলো এবং চীনের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার জায়গাগুলো আবার সচল হলো৷ ভারতের সঙ্গে আমাদের টানাপোড়েন এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভাটা পড়েছে৷ তার বিপরীতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গতি পেল৷ এটা এই সরকারের জন্য একটা ভালো দিক৷''
তিনি মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বড় কোনো সহযোগিতা নিয়ে কোনো কোনো দেশের দ্বিধা থাকতে পারে৷ কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে সেই দ্বিধা দেখা যায়নি৷ মোংলা বন্দর, চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চল, তিস্তা প্রকল্পে চীনের সহযোগিতা এগুলো বিদ্যমান সহযোগিতাকে গতি দেবে৷
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর ভারত ভিসা সুবিধা সীমিত করেছিল৷ এতে ভারতে চিকিৎসা সেবা নিতে যাওয়া বাংলাদেশিরা বিপাকে পড়েছেন৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়ে আসছিল৷ ইউনূসের সফরে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীনকে সহযোগিতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ মুন্সি ফয়েজ বলেন, ‘‘তাদের যেসব প্রযুক্তি তা যদি এখানে আসে তাহলে আমরা লাভবান হব৷ শুল্কমুক্ত সুবিধা আমাদের চলমান আছে তার সময়সীমা আরো বাড়বে৷ কিন্তু আমরা কতটা রপ্তানি করতে পারি তার ওপরে নির্ভর করছে কতটা সুবিধা নিতে পারবো৷”
বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধির আশা
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্সের(বিসিসিআই) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা বলেন," এখানে চীনা বিনিয়োগ বিশেষ করে চীনা ইকোনমিক জোন বাড়লে বাংলাদেশি অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে৷ মোংলা সমুদ্র বন্দরের উন্নয়ন হলে চীনা বিনিয়োগ অনেক বাড়বে৷ ওই এলাকায় তাদের শিল্প আছে৷ সেগুলো আরো বিস্তৃত হবে৷”
"চায়না ইকোনমিক জোন দীর্ঘদিন ধরে আমলাতান্ত্রিত জটিলতায় আটকে ছিলো৷ এটা চীনাদের জন্য একটা কমফোর্ট জোন৷ প্রফেসর ইউনূস সেই ডেডলক খুলে দিলেন৷ ফলে এখানে বিনিয়োগের সাথে সাথে এদেশের মানুষের কর্মসংস্থান হবে,” বলেন তিনি৷
চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার৷ ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১১২ কোটি মার্কিন ডলার৷ বিপরীতে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য৷ এক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ তা কতটা কাজে লাগাতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ আল মামুন মৃধা বলেন, ‘‘শুল্কমুক্ত সুবিধা নিতে হলে আমাদের চীনে রপ্তানির জায়গাগুলো খুঁজতে হবে৷ চীনে তৈরি পোশাক রপ্তানির তেমন সুযোগ আমাদের নেই৷ তারাই সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক৷ আমাদের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির বড় একটা বাজার হতে পারে চীন৷ আম, কাঁঠাল রপ্তানি হবে৷ আমরা আরো অনেক কৃষিপণ্যের বাজার খুঁজতে পারি৷ কারণ চীন তো সবচেয়ে বড় বাজার৷ চীনের কাছ থেকে আমরা নদী ব্যস্থাপনা আয়ত্ব করতে পারলে তা কৃষি ও যোগাযোগে বড় ভূমিকা রাখবে৷”
রোহিঙ্গা ইস্যু, তিস্তা প্রকল্পের সহযোগিতা
অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ চায়না অ্যালামনাই'র (এবিসিএ) সাধারণ সম্পাদক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পতনের আগে জুলাই মাসে চীন সফর করেছিলেন৷ সফরটি ছিলো তিন দিনের, কিন্তু তিনি একদিন আগেই দেশে ফিরে এসেছিলেন৷ তার মাত্র সাত মাসের মাথায় বাংলাদেশের সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস আবার চীন সফর করলেন৷ সচরাচার এটা হয় না৷ এত অল্প সময়েন মধ্যে ড. ইউনূসের সফর বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টিই স্পষ্ট করে৷ এই সফরে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক কেমন হবে৷ আর সেটা আরো ভালো হবে তা বোঝা যাচ্ছে৷”
যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী চীন পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতা দেবে৷ মো. সাহাবুল হক বলেন, ‘‘চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের কথা বলা হয়েছে৷ আর আমরা জানি এরইমধ্যে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে মিয়ানমার সামরিক জান্তার প্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে বসার কথা বলেছেন৷ তার মানে এরইমধ্যে আমরা অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি,” বলেন তিনি৷
ড. ইউনূস তার সফরে চীনের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে৷ এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন. ‘‘তিস্তা প্রকল্পে ড. ইউনূস বাংলাদেশের অবস্থান পরিস্কার করেছেন৷ যেটা আগে ভারতের চাপের কারণে পরিষ্কার করছিলো না আগের সরকার৷ চট্টগ্রামে চীনের যে এক্সপোর্ট জোন হওয়ার কথা এটা চীনা বিনিয়োগে নতুন মাত্রা তৈরি করবে৷ দুই দশমিক এক বিলিয়ন ডলারের যে বিনিয়োগ আসছে বাংলাদেশে এটা থেকেও আমরা বড় সুবিধা পাব৷”
তিনি বলেন," আমরা দেখতে পাচ্ছি চীনের সাথে বাংলাদেশের ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির জায়গা তৈরি হচ্ছে৷ বাংলাদেশে চীনের এক হাজারেরও বেশি কলকারখানা চালু আছে৷ এই অঞ্চলে বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কার সাথে চীনের ভালো সম্পর্ক৷ বাংলাদেশ যদি আরো সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যায় তাহলে ভারত চাপে থাকবে৷”
বাংলাদেশ ও চীন চলতি বছর কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে৷ এই সময়ে দাঁড়িয়ে দুই দেশের সম্পর্ক ‘নতুন মাইল ফলক স্থাপনের দিকে যাচ্ছে' বলে উল্লেখ করেন তিনি৷
সবার সাথে সুসম্পর্ক প্রয়োজন
রোববার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, "ড. ইউনূসের চীন সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিএনপি ইতিবাচক৷৷ ভূরাজনৈতিক কারণেই চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি৷''
তিনি আরো বলেন, "ভারত, চীন, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র সব দেশের সঙ্গে আমরা সুসম্পর্ক গঠন করে চলতে চাই৷ সকল দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই আমাদের কাজ করতে হবে৷ বিশেষ করে পাশের দেশ ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে৷ এমনকি মিয়ানমারের সঙ্গেও আমাদের সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলা প্রয়োজন৷”
রোববার বিকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক ব্রিফিং-এ বলেন, "চীন সরকারের আমন্ত্রণে অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফর ছিল ঐতিহাসিক৷”