প্রথম জমানার (২০১৬-২০২০) অভিজ্ঞতার আলোকে তারা এবার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই ঠিক করে ফেলেছিলেন যে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয়ার পরপরই পরিকল্পনামাফিক একের পর এক পদক্ষেপ নেয়া হবে কোনো সময়ক্ষেপণ না করে। তার ফলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ১০০দিনের কম সময়ের মধ্যে সারা দুনিয়াকে রীতিমতো অস্থির, উদ্বিগ্ন ও বেসামাল করে দিয়েছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২ এপ্রিল তিনি ১৫০টির বেশি দেশ ও অঞ্চলের ওপর ১০ শতাংশ হারে সার্বজনীন শুল্ক (ইউনিভার্সেল ট্যারিফ) আরোপ করেছেন। এদের মধ্যে'রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ' বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বাংলাদেশসহ ৬০টি দেশের ওপর যা সার্বজনীন হার ১০ শতাংশের চেয়ে বেশি। এদের সবার সাথেই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এখন ট্রাম্পের এই শুল্ক নিয়েই দুনিয়া জুড়ে তোলপাড় চলছে, শেয়ার বাজার টালমাটাল হয়ে পড়েছে, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
ট্রাম্পের যুক্তি হলো দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদারতার সুযোগ নিয়ে অন্যায্যভাবে বেশি পরিমাণে পণ্য রপ্তানি করছে, বিপরীতে আমদানি করছে সামান্য। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বিরাট আকার ধারণ করেছে, যার ভুক্তভোগী অ্যামেরিকার লোকজন। আর অ্যামেরিকায় পণ্য রপ্তানিকারক দেশগুলো নিজের দেশে উচ্চ হারে শুল্ক বজায় রাখার পাশাপাশি নানা ধরনের অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা আরোপ করায় এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়ছে না। তাই ঘাটতি অব্যাহত থাকছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আরো দাবি, বহুবার বিভিন্ন অনুরোধ করার পরও এসব দেশ তাদের বাণিজ্যনীতি সংশোধন করেনি, শুল্কহার কমায়নি, অশুল্ক বাধা অপসারণ করেনি। পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-র বিভিন্ন নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে, যার সুযোগ নিচ্ছে অন্য দেশগুলো।
এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল, যার মাধ্যমে দেশটির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি, সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা এবং জাতীয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জোরদার করা যায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সে কাজটিই করেছেন বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের মাধ্যমে – এমনটিই দাবি ট্রাম্প প্রশাসনের। তাদের ভাষায়: আমরা অন্য দেশগুলোকে শুধু এটাই বলতে চাচ্ছি যে, আমরা তাদেরকে যেভাবে দেখি ও তাদের সাথে যেরূপ আচরণ করি, তাদেরকেও এখন থেকে আমাদেরকে সেভাবে দেখতে ও আমাদের সাথে সেরূপ আচরণ করতে হবে। ইউএসটিআর এটা ব্যাখ্যা করতে যেয়ে বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে পারা একটি অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা, এটা কোনো দেশের অধিকার নয়। আর সুবিধা বজায় রাখতে হলে বা পেতে হলে পাল্টা সুবিধাও দিতে হবে। পাল্টা শুল্কারোপ করে ট্র্রাম্প সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু যেভাবে এই শুল্কারোপ করা হয়েছে, তা কি ঠিক হয়েছে? বিভিন্ন দেশ অ্যামেরিকা থেকে পণ্য আমদানিতে বাস্তবে যে হারে শুল্ক আরোপ করে থাকে, তার সাথে ট্রাম্পের নির্ণীত শুল্ক অসঙ্গতিপূর্ণ ও বিকৃত। ট্রাম্প প্রশাসন একটি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতিকে সেই দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি দিয়ে ভাগ করে যে সংখ্যাটা পেয়েছে, সেটাকেই শতকরা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ঐ দেশের আরোপিত শুল্ক ধরেছে। যেমন: ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আর একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২২১ কোটি ডলার । ফলে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৬১৫ কোটি ডলার। এখন ৬১৫-কে ৮৩৬ দিয়ে ভাগ দিলে পাওয়া যায় ৭৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা প্রায় ৭৪ শতাংশ। ট্রাম্প প্রশাসন এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বাংলাদেশের আরোপিত শুল্ক বিবেচনা করেছে। এর অর্ধেক হলো ৩৭ শতাংশ, যা বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্কহার হিসেবে ধার্য্য করা হয়েছে। বাস্তবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির ওপর গড়ে মাত্র ছয় শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করে থাকে। আর পণ্যভেদে শুল্ক হার শূন্য থেকে ৬১১ শতাংশ পযরন্ত আছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে এতদিন গড়ে সাড়ে ১৫ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করে আসছিল।
বাংলাদেশের উদ্বেগ
ট্রাম্পের শুল্কারোপ নিয়ে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও যৌক্তিক কারণে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ১৮ শতাংশ এসেছে আমেরিকা থেকে। আবার অ্যামেরিকায় মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক (আরএমজি) থেকে। বাকিটা আসে বস্ত্র (টেক্সটাইল), চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত চিংড়ি ইত্যাদি থেকে। এসব পণ্যের ওপর বিভিন্নহারে শুল্কারোপ করা ছিল এতদিন। সেই শুল্ক দিয়েই বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে আসছিল শুধু যাদেরকে শুল্কমুক্ত ও শুল্কছাড় সুবিধা দেয়া হয়েছিল, তারা ছাড়া। এখন ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কে সব এলোমেলো হয়ে যেতে বসেছে।
সহজভাবে বললে তৈরি পোশাককেই যদি এখন ৩৭ শতাংশ হারে শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হয়, তাহলে এক ধাক্কায় দ্বিগুণের বেশি শুল্কের মুখে রপ্তানি ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোই সাধারণ এই শুল্ক পরিশোধ করে থাকে। বাড়তি শুল্কের বোঝা তারা স্বাভাবিকভাবেই নিতে চাইবে না। সে কারণে তারা বাংলাদেশি উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের চাপ দিবে দাম কমানোর জন্য। বাংলাদেশি পোশাক প্রস্তুতকারকরা দাম কমাতে গিয়ে প্রথমেই শ্রমিক ছাঁটাই ও বেতন-ভাতা কর্তনের দিকে যাবে। ব্যবস্থাপনাগত ব্যয় কমানোসহ দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে তাদের বেশিরভাগেরই মনোযোগ কম। এতে করে দেশে বড় ধরনের শ্রম অসন্তোষ জন্ম নেবে, প্রচুর মানুষ নতুন করে বেকার হয়ে পড়বে যা আবার সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করবে।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে আগের দেয়া কারযাদেশ স্থগিত করার কথা জানানো হয়েছে। আর ৯ এপ্রিল বুধবার থেকে পাল্টা শুল্ক কারকর হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে বা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে পৌঁছে যাওয়া পণ্য খালাস করতে হলে অন্তত ৩৭ শতাংশ হারে শুল্ক দিয়ে তা করতে হবে। আর তা করতে গেলেই ঐ পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এক আনুষ্ঠানিক পত্রে আরোপিত শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র শুল্কমুক্তভাবে পণ্য আমদানি করা ও তা বাড়ানো এবং বিভিন্ন অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা অপসারণে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউএসটিআরকে দেয়া আরেক চিঠিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশে রপ্তানি করে এমন বিভিন্ন পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক দ্রুত তুলে নেয়ার কথা জানিয়েছেন।
সমস্যা হলো, শুল্ক আরোপ করা হয় পণ্যভিত্তিক এবং তা এইচএস কোডের মাধ্যমে। ফলে যখন কোনো পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন তা শুল্কায়ন হয় ঐ কোড ধরে তা যে দেশ থেকেই আসুক। ব্যতিক্রম হয় যেসব দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি আছে। সেসব দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যে শুল্কছাড় বা শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া থাকলে সেগুলো পৃথকভাবে শুল্কায়ন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নেই। ফলে, এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে গেলে একদিকে কারিগরি (টেকনিক্যাল) সমস্যা দেখা দেবে শুল্কায়ন ও পণ্য ছাড়ের ক্ষেত্রে, অন্যদিকে তারচেয়ে বেশি হবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-র এামএফএন নীতির লংঘন। এই নীতি অনুসারে আলাদাভাবে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি ছাড়া একটি দেশ আরেকটি দেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে পারে না। দিতে হলে এই সুবিধা অপরসব দেশকেও দিতে হবে। এটি প্রতিপালিত না হলে শুল্ক সুবিধা না পাওয়া দেশগুলো ডাব্লিউটিও-তে অভিযোগ দায়ের করতে পারে।
তবে ট্রাম্প নিজেই যেহেতু ডাব্লিউটিও-কে পছন্দ করেন না, ডাব্লিউটিওর মাধ্যমে তৈরি করা বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিধি-বিধানে তাঁর ঘোর আপত্তি, সেহেতু কোনো দেশ ডাব্লিউটিও-র বিধান লংঘন করল কি করল না, তাতে তাঁর কিছু আসে যায় না। বরং তাঁরা এই পাল্টা শুল্কের কারণে দলে দলে বিভিন্ন দেশ এখন ডব্লিউটিও-র এমএফএন নীতিকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিপক্ষীয়ভিত্তিতে শুল্কছাড় দিতে প্রস্তুত হচ্ছে। এমতাবস্থায় কেউ কাউকে এমএফএন নীতি-বিধির লংঘনে অভিযুক্ত করে বাড়তি জটিলতার দিকে যাবে বলে মনে হয় না। তারা বরং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এফটিএ করার দিকেই মনোযোগী হতে পারে। বাংলাদেশকেও একই পথে হাঁটতে হতে পারে। কারণ, ট্রাম্প তিনমাসের জন্য স্থগিত রাখা পাল্টা শুল্ক আবার হঠাৎ করেই অন্য কোনোভাবে আরোপ যে করবেন না, তাই বা কে বলতে পারে।