জুনিয়র ডাক্তার নেতাদের শাস্তিমূলক পোস্টিং? বিতর্ক তুঙ্গে
২৯ মে ২০২৫সরকারের বক্তব্য, যে কোনো জায়গায় করতে হবে ডিউটি। চিকিৎসকদের সওয়াল, কাউন্সেলিংয়ের তাহলে কি ভূমিকা?
আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের পরে বড় মাপের আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। এদের নেতৃস্থানীয় তিনজনের বদলি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
জুনিয়রদের বদলি
সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনার পরে তিন বছর বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিষেবা দিতে হয় সদ্য পাশ করা চিকিৎসকদের। ডাক্তারির স্নাতকোত্তর এমডি-এমএস পাশ করার পরে সিনিয়র রেসিডেন্ট হিসেবে তাদের পোস্টিং দেয়া হয়। এই পোস্টিং দেয়ার আগে কাউন্সেলিং করানো হয়। বিতর্ক তৈরি হয়েছে আরজি কর আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা তিন জুনিয়র চিকিৎসকের পোস্টিং ঘিরে।
হাওড়া জেলা হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল দেবাশিস হালদারের। তালিকা বেরোতে দেখা যাচ্ছে, তাকে পাঠানো হয়েছে মালদার গাজোল স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। অনিকেত মাহাতোর ক্ষেত্রে আরজি করের বদলে রায়গঞ্জ মেডিক্যাল এবং আশফাকুলা নাইয়াকে আরামবাগ মেডিক্যালের বদলে পুরুলিয়ার দেবেন মাহাতো মেডিক্যাল কলেজে পোস্টিং দেয়া হয়েছে।
এই তালিকা প্রকাশিত হতেই প্রতিবাদ জানায় জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট। মঙ্গলবার এ নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনে স্মারকলিপি জমা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য সচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের সঙ্গে দেখা করেন প্রতিনিধিরা। তার জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে স্বাস্থ্য সচিবের ঘরের বাইরে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করেন সিনিয়র রেসিডেন্টরা।
আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম মুখ অনিকেত বলেন, "প্রায় এক হাজার ছয়শ জনের এনগেজমেন্ট এবং নিয়োগ হয়েছে। আমি ও আশফাকুল্লা নাইয়া এবং আমাদের সিনিয়র ব্যাচের দেবাশিস হালদারের ক্ষেত্রে যে মেধাভিত্তিক কাউন্সেলিং হয়েছিল, তালিকায় সেটার বড় পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। রাজ্যের যে কোনো জায়গায় যেতে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু স্বচ্ছ মেধাভিত্তিক যে কাউন্সিলিং প্রক্রিয়া, সেটা কেন অনুসরণ করা হবে না? তাহলে কেন কাউন্সেলিং করা হল? শুরুতেই বলা যেত, সরকারি পরিকাঠামোর অংশ হিসেবে আমাদের যে কোনো নির্দেশ পালন করতে হবে।"
আশফাকুল্লা বলেন, "যদি কাউন্সেলিংয়ে মালদার গাজোলে একটা আসন থাকত, তাহলে যার মালদায় বাড়ি, তিনি ওই হাসপাতালকে বেছে নিতেন। যার বাড়ি মালদায় তাকে কেন সুন্দরবনের হাসপাতাল বেছে নিতে বাধ্য করা হবে? যখন কাউন্সেলিং হয়, তখন গাজোলের কোনো আসন ছিল না। এখন কাউকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়ে কাউন্সেলিং প্রক্রিয়াকে বানচালের চেষ্টা করা হচ্ছে।"
বিরোধীরা এ নিয়ে তৃণমূলকে আক্রমণ করেছে। কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, "এটা এদের পুরোনো স্টাইল। আরজি কর আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তাই তাদের নেতৃত্বকে ছিটকে দেওয়ার চেষ্টা। সে কারণেই দূরে দূরে পোস্টিং দেয়া হচ্ছে।"
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, "এটা কেমন ভাবধারা যে, ডাক্তাররা শুধু কলকাতার আশেপাশেই ঘোরাফেরা করবেন! গ্রামের মানুষ কি চিকিৎসা পাবেন না? সরকারি চাকরিতে যে কোনো জায়গাতেই যেতে হবে। পুরুলিয়া বা মালদার মানুষকে চিকিৎসা দেয়া হবে না! অভয়ার একটা দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এরা আর কী কী সুবিধা নিতে চান?"
চিকিৎসকদের মত
সিনিয়র চিকিৎসকদের একাংশ আরজি কর আন্দোলনে এই জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে ছিলেন। এক্ষেত্রেও তাদের সমর্থন পাচ্ছেন অনিকেতরা।
চিকিৎসক তমোনাশ চৌধুরী বলেন, "আমাদের রাজ্যে মেধার কোন মূল্য নেই। মেধার ভিত্তিতে যারা পোস্টিং পেয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে প্রতিহিংসার আচরণ করা হয়েছে, যেহেতু তারা তাদের সহপাঠী ডাক্তারের হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। এর তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছি।"
রাজ্য সরকারের বক্তব্য, এর মধ্যে প্রতিহিংসার কিছু নেই। কাউন্সেলিং করার অর্থ কোনো প্রার্থীকে তার পছন্দের জায়গা বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মেনে নেয়া হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে মেনে নেয়া হবে, এই গ্যারান্টি নেই। সিনিয়র রেসিডেন্টের মধ্যে কয়েকজনকে কাউন্সেলিংয়ের বাইরে অন্যত্র পোস্টিং দেয়া হয়েছে। সরকারের এই অধিকার আছে।
প্রতিবাদী চিকিৎসকদের বদলি নিয়ে এর আগেও বিতর্ক হয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের ডেপুটি সিএমওএইচ থেকে সুবর্ণ গোস্বামীকে বদলি করা হয় দার্জিলিংয়ের যক্ষ্মা হাসপাতালের সুপার পদে ৷ তিনি চাকরি জীবনে বারবার বদলির মুখে পড়েছেন। তিনি বলেন, "সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বদলির একটা নিয়ম আছে। সেটাকে সরকার লঙ্ঘন করতে পারে না। আর এই জুনিয়র ডাক্তাররা সরকারি কর্মীও নন। যারা সরকারি হাসপাতাল থেকে পাশ করেছেন, তারা আগে বন্ডে সই করেছিলেন যে, তিন বছর সরকারকে পরিষেবা দেবেন। এই জুনিয়র ডাক্তাররা পোস্টিং পাবেন মেধাভিত্তিক কাউন্সিলিংয়ের ভিত্তিতে, কিন্তু তা হয়নি।"
চিকিৎসক সংগঠন প্রগ্রেসিভ হেলথ অ্যাসোসিয়েশন সরকারের সমর্থক হিসেবে পরিচিত, যার মাথায় রয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা। এই সংগঠনের সম্পাদক করবী বড়ালের বক্তব্য, "ডাক্তারি পড়ার শর্তই এটা যে, গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। আমাদেরও করতে হয়েছে। সিনিয়র ডাক্তাররা আমাদের শিখিয়েছিলেন, বদলি হলে আগে নতুন জায়গায় ডিউটিতে যোগ দিতে হবে। পরে নিজের অভাব-অভিযোগের বিষয় আসতে পারে। দুঃখের কথা, এখানে কয়েকজন সিনিয়র ভুল শিক্ষা দিচ্ছেন জুনিয়রদের।"
প্রতিহিংসার অভিযোগ আরো উঠেছে। থ্রেট কালচারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। অভিযুক্তদের একজন অভীক দে। তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য দপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ উৎপল দাঁ। এই কমিটিই অভীক দে-কে দোষী সাব্যস্ত করে স্বাস্থ্য দপ্তরের কাছে রিপোর্ট দিয়েছিল। উৎপলকে ডায়মন্ডহারবার মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে বদলি করে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়েছে। এটাকেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে চিকিৎসকদের একাংশ চিহ্নিত করেছেন। যদিও সরকারের তরফ থেকে এটাকে রুটিনমাফিক বদলি বলা হয়েছিল।
চলতি বিতর্ককে গ্রাম-শহরের বিভাজনের ছবি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলছে বলে মত জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের। আশফাকুল্লা বলেন, "এখানে গ্রাম-শহর বলে গুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা গ্রামে কাজ করতে চাই। কলকাতার বড় সরকারি হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নেন, তাদের একটা বড় অংশ গ্রামের মানুষ, গরিব মানুষ। তাদের আমরা রোজ পরিষেবা দিই। প্রশ্নটা পদ্ধতি নিয়ে, গ্রামে যাওয়া নিয়ে নয়।"