জার্মানিতে অভিবাসী নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ
১১ আগস্ট ২০২৫তবে কেন, কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে কর্মবাজারে প্রবেশ করছেন না তারা?
২০১৬ সালের সেই রাতে দীর্ঘদিন পরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলেন ডোনিয়া (নাম পরিবর্তিত)৷ আফগানিস্তানে তাকে তাড়া করেছিল মৃত্যুভয়৷ নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন তার স্বামী৷ প্রাণ হাতে করে নিজের ১৯ বছরের ছেলেকে নিয়ে জার্মানিতে পা রাখেন এই প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ তথা ধাত্রী৷ মেলে সুরক্ষা, নিশ্চিন্তি৷ ডিডাবলিউকে তিনি বলেন, ‘‘সেই নিরাপদ রাতের কথা কিছুতেই ভুলবো না আমি৷’’
তার ঠিক পরেই তাকে ভাবতে হয়, এ দেশে কী কাজ করবেন? আফগানিস্তানের বিধ্বস্ত জীবনের স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়, যা মানসিক শান্তির অনেকটাই ব্যাহত করে৷ এ দিকে, যে কোনো কর্মজীবনের পূর্বশর্ত মানসিক স্থিতি৷
সেই সব কিছুর সঙ্গে লড়াই করে ফের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন এই আফগান নারী৷ গত দু’বছর ধরে বয়স্কদের যত্ন নেওয়ার কাজ করেন তিনি৷ আট মাসের একটি প্রশিক্ষণপর্ব শেষে এই কাজে যোগ দিয়েছেন৷ ৫৩ বছর বয়সি ডোনিয়ার কথায়, নিজের এই চাকরিতে তিনি খুশি৷
অন্য অনেক অভিবাসীর মতো ডোনিয়াকেও সাহায্য করেছে ‘ওয়ার্ক ফর রিফিউজিস’ প্রকল্প৷ বার্লিন সেনেটের আর্থিক সহায়তায় এই প্রকল্পটি চালায় ‘সোসাইটি ফর ইন্টারকালচারাল কো-এক্জিস্টেন্স অ্যান্ড আদার কোঅপারেশন পার্টনার্স’৷
নারী অভিবাসীদের রয়েছে তিনগুণ প্রতিবন্ধকতা
কিন্তু সব নারী অভিবাসীর অবস্থা কি ডোনিয়ার মতো?
২০১৬ সালের একটি সমীক্ষায় জানা যায়, নিজের যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ ছেড়ে জার্মানিতে পা রাখার আট বছরের মধ্যে কাজে যোগ দিয়েছেন ৬৮ শতাংশ মানুষ৷ কিন্তু ‘ইনস্টিটিউট অব এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ’, জার্মানির ‘ফেডারেল অফিস ফর রিফিউজিস’ ও ‘সোশিওইকোনমিক প্যানেল’ দেখিয়েছে, আট বছর পরেও মোট নারী অভিবাসীর দুই-তৃতীয়াংশ কর্মহীন৷ আইএবি গবেষক মায়ে এহাবের কথায়, ‘‘প্রথমত তারা নারী, দ্বিতীয়ত তারা অভিবাসী, আরো স্পষ্ট করে বললে শরণার্থী৷ তিন ক্ষেত্রেই তারা সুবিধাবঞ্চিত৷’’
বহু নারী অভিবাসী সন্তানসহ আসেন৷ এ দেশের ডে-কেয়ার সেন্টারগুলিতে উপযুক্ত সংখ্যায় ‘চাইল্ড কেয়ার’ কর্মী না থাকায় তারা সন্তানকে ছেড়ে প্রশিক্ষণ (যেমন জার্মান ভাষা শেখা) বা চাকরিতে যোগ দিতে পারেন না৷ এহাব আরো বলেন, ‘‘পুরুষরা অনেক সময়েই এমন কাজে যোগ দেন যেখানে জার্মান ভাষার দক্ষতা প্রয়োজন হয় না, যেমন নির্মাণশিল্প৷ ফলে তাদের পক্ষে কাজে যোগ দেওয়া সহজ৷’’
২০১৫ এবং ২০১৬ সালে জার্মানিতে আসা ১২ লক্ষ আশ্রয়প্রার্থীর বেশিরভাগই সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং ইরাকের৷ তাদের বেশিরভাগই পুরুষ৷ অন্যদিকে পরবর্তীতে আসা ইউক্রেনীয় আশ্রয়প্রার্থীদের তিন-চতুর্থাংশই নারী।
বাধা সৃষ্টি করে যোগ্যতার স্বীকৃতিও
অন্য দেশের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি পাওয়া বেশ কঠিন জার্মানিতে৷ তার উপর ডোনিয়ার কাছে নিজের ১২ বছরের শিক্ষাজীবন ও দীর্ঘদিনের কর্মজীবনের কোনো প্রমাণপত্র ছিল না৷
জার্মানিতে ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ প্রত্যয়িত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় পড়ে এটি৷ এ দেশে একটি চাকরির ক্ষেত্রে শুধু অভিজ্ঞতা থাকলেই হবে না, যথাযথ প্রশিক্ষণও থাকতে হবে৷ সেই কারণেই বহু অভিবাসীকে ফের শূন্য থেকে শুরু করতে হয়৷ বহু আফগান নারীই কিন্তু কম লেখাপড়া জানেন৷ ২০২১ সালে আফগানিস্তানের দখল তালিবানের হাতে যাওয়ার পরে সে দেশের নারীশিক্ষার হার ও মান ক্রমহ্রাসমান৷
জার্মানিতে ‘ইন্টিগ্রেশন কোর্স’-এ মূলত শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা নির্বিশেষে৬০০ ঘণ্টা জার্মান ভাষা শেখার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত৷ ‘সোসাইটি ফর ইন্টারকালচারাল কো-এক্জিস্ট্যান্স’-এর কর্মী আফসানে আফরাজে মনে করেন, এই প্রক্রিয়াটি সকলের জন্য উপযুক্ত করা প্রয়োজন৷
২০১৪ সালে ইরান থেকে এ দেশে চলে আসেন আফসানে, পেশায় তিনি এক জন মনোবিদ৷ নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ডিডাবলিউকে জানান, ‘‘আমি ইংরেজি জানি৷ কিন্তু আমার সহপাঠিনী ছিলেন এক ৫৫ বছরের নারী, যিনি এর আগে কলমও ধরেননি৷’’ ডোনিয়ার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘‘ডোনিয়া ব্যতিক্রম, তার মতো লেখাপড়ার সুযোগ বহু আফগান মেয়ে পান না৷’’ প্রায় একই কথা বললেন ইউক্রেনীয় অভিবাসী নারী ইনা জিসা৷ নিজের ইংরেজি বলার দক্ষতার জন্য জার্মানিতে একটি রেস্তরাঁয় চাকরি পান তিনি৷
চাকরিজীবী বাড়াতে প্রয়োজন উপযুক্ত পথপ্রদর্শন
‘ওয়ার্ক ফর রিফিউজিস’ প্রকল্প নারী অভিবাসীদের চাকরি সংক্রান্ত কাউন্সেলিং সেশন ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করে৷ যে সমস্ত সংস্থায় মহিলাদের জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম রয়েছে, সেখানেও পাঠানো হয় চাকরিপ্রার্থীদের৷ টেন্ট ডয়েচলান্ড বলে এক সংস্থাও জব ফেয়ারের আয়োজন করে৷
এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি ৮০টি সংস্থার একটি নেটওয়ার্কের সহায়তায় প্রশিক্ষণ ও মেন্টরিংয়ের মাধ্যমে চাকরিরও ব্যবস্থা করে৷ এদের কয়েকটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুধু মেয়েদের জন্যই তৈরি৷
২০১৬ সালে বার্লিনে চালু হওয়া রেডি স্কুল অব ডিজিটাল ইন্টিগ্রেশনেও মেন্টরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়৷ বিশেষ করে যে সমস্ত অভিবাসীরা প্রযুক্তি ও ডিডিটাল দক্ষতা নিয়ে আগ্রহী, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে৷
আফসানে মনে করেন, ডোনিয়ার মতো নারীরাও এগিয়ে আসতে পারেন রোল মডেল হিসেবে৷ তার কথায়, ‘‘এ ভাবেই আরো বেঁধে বেঁধে থাকতে হবে আমাদের৷’’
জুলি গ্রেগসন/এসটি