জার্মান নির্বাচন: অভিবাসীদের ভাবনায় উগ্র ডানপন্থার উত্থান
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫জার্মানিতে রোববার জাতীয় নির্বাচনের দিনে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া ছিল৷ ছুটির এমন দিনে সাধারণত ঘরে থাকেন না জার্মানরা৷ বাংলাদেশি-জার্মান পেশাজীবী জাকির হোসেন জানালেন, গাড়ি পার্ক করতে বেগ পেতে হয়েছে৷ কারণ শহরের কেন্দ্রে অনেক মানুষের ভিড়৷
জার্মানির সাবেক রাজধানী বনের বাসিন্দা জাকির৷ দীর্ঘদিন চাকুর করেছেন একটি ব্যাংকে৷ এখন চাকুরি বদলের প্রক্রিয়ায় আছেন৷ তার সঙ্গে কথা হয় বনের কেন্দ্রীয় চত্বরে৷ জার্মানির প্রায় ছয় কোটি ভোটারের একজন তিনি৷ সকাল সকাল ভোটকেন্দ্র ঘুরে এসেছেন৷
জাকির বলেন, ‘‘এবার দেখলাম প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলই অভিবাসনে ফোকাস করেছে বেশি৷ অবৈধ অভিবাসন, শরণার্থী কিংবা দক্ষ অভিবাসী - আসলে প্রত্যেকটা দলের কিছু লক্ষ্য থাকে৷ কোনো দল চাচ্ছে দক্ষ শ্রমিক বাড়াতে, কোন দল চাচ্ছে অবৈধ অভিবাসনকে সরিয়ে দিতে - তো আমার মনে হয়েছে অভিবাসনকে তারা ফোকাস করেছে বেশি৷''
জাকির জার্মানিতে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ আশা করেন৷ সরাসরি কোনো দলের নাম না নিলেও কিছুটা শঙ্কা ফুট উঠেছে তার কথায়৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা সবাই চাই একটা স্থিতিশীল পরিবেশ৷ অন্য দল আসলে হয়ত পরিবেশটা অন্যরকম হতে পারে৷ আমরা যারা বিদেশিরা আছি, আমরা সবাই চাই যাতে পরিবেশটা স্থিতিশীল থাকে৷ এবং অভিবাসীদের পর্যাপ্ত সুযোগ দেয় যাতে আমরা আমাদের লক্ষ্য পৌঁছাতে পারি৷''
আরেক বাংলাদেশি অভিবাসী সোফিয়া উল্লাহ জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থার একটা উত্থান লক্ষ্য করছেন৷ তিনি আশা করছেন এবার ভোটারের সংখ্যা অনেক বেশি হবে, বিশেষ করে তরুণ ভোটাররা ভোট দিতে আগ্রহী হবে কট্টর ডানপন্থি হিসেবে পরিচিত এএফডি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা খর্ব করতে৷
সোফিয়া বলেন, ‘‘অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এএফডির সঙ্গে কাজ করবে না৷ কারণ ওরা জানে যে এটা করলে ওদের অনেক ক্ষতি হবে৷ ওদের ভোটার কমে যাবে, ওদের প্রতি সমর্থন কমে যাবে৷''
সোফিয়া মনে করেন জার্মানিতে বিভিন্ন সমস্যা আছে৷ আর সেসব সমস্যা পুঁজি করে আগাতে চাচ্ছে এএফডি৷ তিনি বলেন, ‘‘মানুষের মধ্যে যে ভয় আছে, এএফডি সেটা ব্যবহার করে৷ এরকম করে ভোট বাড়ায়৷''
বনের আরেক বাসিন্দা নাজমুল হকও সকাল বেলা ভোট দিয়েছেন৷ বাংলাদেশেও অতীতে ভোট দেয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার৷ ভোটের দিন যে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ বাংলাদেশে তিনি দেখে এসেছিলেন, সেই পরিবেশ জার্মানিতে না দেখে কিছুটা আশাহত নাজমুল৷
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক যে প্রচারণা, সেটা আসলে সবাইকে টেনে নিয়ে আসে নির্বাচনের দিনে ভোট দেওয়ার জন্য৷ এখানেও হয়ত এরকমের প্রচারণা রয়েছে, অবশ্যই অন্যভাবে৷ কিন্তু আমরা যেহেতু অভিবাসী সম্প্রদায়, সাধারণত ঐ ধরনের প্রচারণা আমাদেরকে টেনে নিয়ে আসে না৷ যার জন্য আমাদের একটা বড় অংশ নির্বাচনের যে আবহটা, যে উত্তেজনাটা সেটার বাইরে থাকে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা যারা খুবই উৎসাহী, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করি, তারা হয়ত ইলেকশনের দিনক্ষণ যেনে ভোট দিতে আসি৷ এটা একটা বড় পার্থক্য বাংলাদেশের সাথে যে হৈ হৈ রৈ রৈ আবেগ উত্তেজনার ব্যাপারটা এখানে অনেক বেশি অনুপস্থিত৷ আমার ধারনা অভিবাসীদের ভোট কম পড়ার এটা একটা কারণ হতে পারে৷''
জার্মানির নির্বাচনে বিদেশি শক্তি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে কিনা সেদিকেও সতর্ক নজর রাখছেন নাজমুল হক৷ তিনি বলেন, ‘‘ইলন মাস্ক যখন বলেন এএফডিকে ভোট দেন, এটাতো একটা বড় জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করে৷ সুতরাং এখন দেখা যাচ্ছে আসলে রাষ্ট্রকে ছাপিয়ে ব্যক্তির প্রভাব অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে যদি অনেক টাকা এবং ক্ষমতা থাকে৷''
জার্মানি এবং ডেনমার্কে দীর্ঘদিন বসবাসের অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কারিম উল্লাহর৷ জার্মানির অন্যতম বড় দুই রাজনৈতিক দল খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল সিডিইউ এবং সামাজিক গণতন্ত্রী দল এসপিডির রাজনীতি নিয়ে ওয়াকিবহাল তিনি৷ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তার আস্থা রয়েছে৷
তবে ইউরোপের রাজনীতিতে একধরনের পরিবর্তনও দেখতে পাচ্ছেন তিনি৷ রাখঢাক না রেখেই কারিম উল্লাহ বলেন, ‘‘ইউরোপীয় দেশগুলোতে গত বিশ বছর ধরে শুরু হয়েছে যে ‘মাইনরিটিদের অ্যাটাক' করলে ভোট পাবো৷ আসলে এটা ভোটের জন্যই করে৷ তারা এর বাইরে কিছু করতে পারে না৷ কারণ আমাদেরকে দরকারও তাদের৷''
তিনি বলেন, ‘‘যেমন মুসলমানদের কথা ধরা যাক৷ এরাই আমাদের সব সমস্যা তৈরি করছে এরকম একটা ধারনা দেয়া হয়৷ অথচ মুসলমানদের অবদান অনেক এখানে৷''
বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রত্যাশা উগ্র ডানপন্থিরা জার্মানির রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারবে না৷ বরং মূলধারার পুরনো রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের মধ্যে যে ভয়, শঙ্কা রয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে কাজ করবে আগামী বছরগুলোতে৷