জাপানে ভালুকের হুমকি: শিকারিদের সংকট ও প্রযুক্তির নতুন লড়াই
৮ ডিসেম্বর ২০২৪খাঁচায় বন্দি একটি বাদামি ভালুক নিস্তেজ হয়ে পড়ল, আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুনাগাওয়া শহরের কিছু কর্মকর্তা এবং শিকারি।
এই ভালুকটি আশপাশের ঘরবাড়ি এবং ভুট্টার খেতে তাণ্ডব চালাচ্ছিল। শিকারিরা ফাঁদ পেতে একটি হরিণের দেহ ব্যবহার করে এটিকে আটক করেছিল। তবে এভাবে ভাল্লুক শিকার যেন শিকারিদের নিজের বিবেকের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। আর সেটিই ফুটে উঠলো স্থানীয় শিকারি সংস্থার প্রধানের কথায়। ৭৫ বছর বয়সী হারু ইকেগামি বলেন, "যখন একটি ভালুক ধরা পড়ে, তখন আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। আমাদের কাজ কঠিন। একটি জীবনের ভার নেওয়া সহজ বিষয় নয়।"
ভালুক বনাম মানুষ: সংকটের গভীরতা
বর্তমানে জাপান ভালুক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। গত এক বছরে ভালুক আক্রমণের শিকার হয়েছেন ২১৯ জন, যার মধ্যে ৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। একই সময়ে ৯ হাজারের বেশি ভালুককে ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয়েছে।
জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপে ভালুকের সংখ্যা ৩০ বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। অন্যদিকে, হনশু দ্বীপে কালো ভালুকের সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্যের অভাব, এবং প্রাকৃতিক বাসস্থান সংকুচিত হওয়ায় ভালুকগুলো মানুষের বসতিতে ঢুকে পড়ছে। পরিত্যক্ত কৃষিজমি এবং গ্রামীণ অঞ্চলের জনসংখ্যা হ্রাস এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
সংকটে শিকারিরাও
একসময় শিকার ছিল একটি লাভজনক পেশা। তবে ১৯৮০-এর দশক থেকে পরিবেশ সুরক্ষার উপর জোর এবং শিকারের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় এই পেশাটি অলাভজনক হয়ে পড়েছে।
শিকারিরা বলছেন, ভালুক ধরা এবং হত্যা করতে যে পরিমাণ খরচ হয়, তার তুলনায় তাদের প্রাপ্তি অত্যন্ত কম। একটি ভালুক হত্যার জন্য মাত্র ৮ হাজার ইয়েন (প্রায় ৫১ ইউরো) দেওয়া হয়, যা জ্বালানি খরচ মেটাতেও যথেষ্ট নয়।
৭২ বছর বয়সী শিকারি তাতসুহিতো ইয়ামাগিশি বলেন, "আমাদের বয়স হয়ে গেছে। যখন আমরা আর শিকার করতে পারব না, তখন এই পেশার ওপর নির্ভরশীলতা টিকে থাকবে না।"
ভালুক মোকাবিলায় প্রযুক্তির ব্যবহার
মানুষ এবং ভালুকের সংঘাত কমাতে জাপান এখন প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে। সাপ্পোরো-ভিত্তিক একটি কোম্পানি তৈরি করেছে "মনস্টার উলফ" রোবট। এই রোবটটি সেন্সরের মাধ্যমে ভালুক শনাক্ত করে এবং উচ্চস্বরে গর্জন এবং হুমকি দেয়।
৪ লাখ ইয়েন (প্রায় ২ হাজার ৫৩০ ইউরো) দামের এই সৌরশক্তিচালিত রোবটটি কিছু ক্ষেত্রে ভালুক তাড়াতে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তবে এটি মানুষের দক্ষতার বিকল্প হতে পারবে না, বলছেন শিকারি ইয়ামাগিশি।
শিকারি ও পরিবেশবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভালুকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞ কোজি ইয়ামাজাকি মনে করেন, মানুষের বসতিস্থল এবং ভালুকের বাসস্থানের মধ্যে পরিষ্কার সীমারেখা তৈরি করা প্রয়োজন। অপরদিকে, কৃষি বিষয়ক অধ্যাপক ইয়োশিকাজু সাতো বলেন, "আমাদের প্রতিদিনের চেষ্টায় নিশ্চিত করতে হবে যে ভালুকগুলো মানব এলাকা থেকে দূরে থাকে।"
৮৪ বছর বয়সী শিকারি কাতসুও হারাদা তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, "২০ বছর আগে একটি ভালুক আমার মাথায় কামড় বসিয়েছিল। আমি সেদিন টিকে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেই ভয়ানক মুহূর্ত আজও ভুলতে পারিনি।"
বর্তমানে, হারাদা একটি অলাভজনক সংস্থা চালান, যা স্থানীয় কমিউনিটিকে বন্যপ্রাণী সমস্যা মোকাবিলায় সহায়তা করে।
সমাধানের পথে
ইতিমধ্যে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে শিকারিদের প্রশিক্ষণ এবং ভালুক মোকাবিলায় স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা বাড়ানো। তবে শিকারিদের মতে, এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে আরও আর্থিক সহায়তা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন।
জাপানে ভালুক এবং মানুষের সংঘাত শুধু একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং এটি মানব সমাজের টিকে থাকার লড়াইও। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং মানুষের নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
টিআই/এসিবি (রয়টারর্স)