জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় অপ্রস্তুত ভারত?
২৭ মে ২০২৫কেরালার পরিস্থিতি
সবে বর্ষা এসেছে কেরালায়। এর মধ্যেই বৃষ্টির তাণ্ডবে বিপর্যস্ত দক্ষিণ ভারতের এই রাজ্য। ওয়ানাড়, কোঝিকোড়, কান্নুরে রেড অ্য়ালার্ট জারি করা হয়েছে। মাল্লাপুরমসহ তিনটি জেলায় অরেঞ্জ অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে।
কেরালায় নয়টি নদীর জল খুবই বেড়ে গেছে এবং বন্যা সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ১৬টি ত্রাণশিবির চালু করা হয়েছে। ২১টি বাড়ি পুরোপুরি ও ৫৮৬টি বাড়ি আংশিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
কেরালার মন্ত্রী আর রাজন জানিয়েছেন, ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। তাই ৫৮৬জনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
থিরুবনন্তপুরমসহ অনেক জায়গায় ৫০ কিলোমিটার বেগে ঝড় ও বৃষ্টির আশঙ্কা আছে বলে আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে। ইতিমধ্যে ঝড়ে এক হাজার ৫৬৯টি হাই টেনশন বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গেছে এবং ১০ হাজার ৫৭৩ লো টেনশন বিদ্যুতের খুঁটি নষ্ট হয়েছে। এর ফলে অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ নেই। কেরালা বিদ্যুৎ বোর্ডের ইতিমধ্যে ৫৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
কর্ণাটক ও গোয়াতেও রেড অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া দপ্তর।
মহারাষ্ট্রের অবস্থা
কোলাপুরে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে, মুম্বইতে হলুদ সতর্কতা রয়েছে. পুনের জন্য অরেঞ্জ সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া দপ্তর। মুম্বই, সাতারা, সোলাপুর, পুনেতে রাস্তাঘাটসহ পরিকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী ৮০টি পরিবারকে উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেছে। রাইগড়ে বাজ পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
মুম্বইয়ে ২৪ ঘণ্টায় ১৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অনেক বাড়িতে শর্ট সার্কিট হয়েছে, দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। রাস্তায় বড় বড় গর্ত দেখা দিয়েছে। প্রচুর এলাকা জলে ভেসেছে। বান্দ্রা-ভারসোভাতে দুইটি বার্জ ভেসে গেছে। এককথায় মরসুমের প্রথম বৃষ্টির তাণ্ডবে বিপর্যস্ত মুম্বইসহ মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ এলাকা।
দিল্লির অবস্থা
রাজধানী দিল্লিতে সপ্তাহান্তে প্রবল বৃষ্টি হয়। প্রায় পুরো শহর জলের তলায় চলে যায়। প্রবল ঝড়ে বহু গাছ পড়ে যায়। আইটিও, মিন্টো রোড, রিং রোড, দ্বারকা, মহিপালপুর, ধোলা কুঁয়াসহ দিল্লির অনেক রাস্তায় জল জমে যায়। অনেক আন্ডারপাসে জল জমে যায়। ব্যাপক যানজট হয়।
বিমানবন্দরের পাশের রাস্তা জলমগ্ন হয়ে যায়।
পশ্চিমবঙ্গেও ব্যাপক বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা সোমনাথ দত্ত বলেছেন, "পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন এলাকায় ঘূর্ণাবর্ত ঘনীভূত হচ্ছে নিম্নচাপে। মঙ্গলবার বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে৷”
কেন এই অবস্থা?
স্কাইমেট ওয়েদারের জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মহেশ পালওয়াট বিজনেস স্যান্ডার্ডকে বলেছেন, ''প্রতিবারই বর্ষায় এরকম হয়। তবে, বিশ্বে উষ্ণায়নের ফলে মৌসুমি বায়ুর ধরণে পরিবর্তন এসেছে। স্থল ও সমুদ্রের তাপমাত্রা সমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে বাতাসের আর্দ্রতা দীর্ঘ সময়ের জন্য ধরে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই ভারতে এই চরম আবহাওয়ার পিছনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা আছে। প্রতিবছর এই চরম আবহাওয়ার পরিমাণ বাড়ছে।''
আইআইটি মুম্বইয়ের অধ্যাপক এবং বৈজ্ঞানিক রঘু মুরুতুগুড্ডে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ''আগেও আমরা চরম আবহাওয়া দেখেছি। কিন্তু ২০২৩-এ দেখতে পেয়েছি, উষ্ণায়ন ও আরো কয়েকটি বিষয় বিশ্বের আবহাওয়াকে বদলে দিচ্ছে। এল নিনো, দাবানল, উত্তর অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে গরমের একটা পর্যায় চলা, আরব সাগরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, উপরিভাগে বায়ু চলাচলের অস্বাভাবিক প্যাটার্নের ফলে ভারতে এরকম আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে।
ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটিরিওলজির ডিরেক্টর কৃষ্ণন রাঘবন বলেছেন, ''আমরা সকলেই জানি যে পৃথিবীর উপরিভাগ এবং সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে জলীয় বাষ্পর পরিমাণ বাড়ছে। বৃষ্টিপাতও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে এটা হচ্ছে। জলীয় বাষ্পবেশি হওয়ার ফলে বৃষে্টির পরিমাণ বেড়েছে। চরম আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে।''
আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা মৃণাল কান্তি পালরায় ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''বর্ষার আগে এরকম মৌসুমী বায়ুর বিস্তার তৈরি হয়। এটা অস্বাভাবিক নয়। সবসময় এধরনের বৃষ্টি হয়। তবে সার্বিকভাবে পরিবেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। আবহাওয়া এখন অনেক বেশি খামখেয়ালি হয়ে গেছে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।''
'আমরাই দায়ী'
পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''মানুষই মানুষের শত্রু। এই যে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তার কারণ, মানুষ প্রকৃতিকে নষ্ট করছে। আমরা প্রতিদিন প্রকৃতিকে সংহার করে চলেছি। প্রকৃতিও তার খেয়ালখুশিমতো চলবে। প্রকৃতি এখন সারা বিশ্বকে এইভাবে শাসন করছে। ব্যতিক্রমী বিষয় হচ্ছে। প্রকৃতির গতিপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ফল মানুষ পাচ্ছে। এটাই অবশ্যম্ভাবী।''
'আমরা প্রস্তুত নই'
পরিবেশবিদ ও পরিচালক মল্লিকা জালান ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''আমার মনে হয়, কলকাতা হলো ক্লাইমেট হটস্পট। পরfবেশের প্রভাব কলকাতার উপর খুব বেশি করে পড়ে। বঙ্গোপসাগর একশ কিলোমিটার দূরে। জোয়ারের সময় আমরা তার প্রভাব বুঝতে পারি। ইউএনএফসিসিসি বলছে, বৃষ্টির পরিমাণ হয়ত বাড়বে না, কিন্তু ২০ দিনে যে বৃষ্টি হতো, তা একদিনে হবে। ফলে শহরের পরিকাঠামোর উপর অসম্ভব চাপ পড়বে। শহরের নিকাশী ব্যবস্থা কি সেই পরিস্থিতির জন্য তৈরি? আমার মনে হয়, আমরা তার জন্য তৈরি নই।''
মল্লিকা জালান বলেছেন, ''সমুদ্রের কাছে অধিকাংশ শহরে জলবায়ু পুরিবর্তনের প্রভাব পড়বেই। ঘটনা হলো, আমরা এই পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে পারছি না। আমাদের সিস্টেমকে ভালো করতে হবে। এই সময়ে প্রবল বৃষ্টি হবে, তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি কয়েকদিনে বেঙ্গালুরুতে ছিলাম। ভয়ংকর বৃষ্টি হবে। জলবায়ু পরিবর্তন হবে। আমাদের নিজেদের সিস্টেমকে সেভাবে পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের সেই প্রস্তুতি নেই।''