জর্জিয়ায় দেখার আছে অনেক কিছু
২০২৩ সালে আইটিবি বার্লিনের আয়োজক দেশ ছিল জর্জিয়া। পর্যটনের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য বিষয়ক আয়োজন আইটিবি বার্লিন। ৭ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত এই আয়োজন চলেছে। এই দেশে কী কী দেখার আছে?
জর্জিয়া বহু সংস্কৃতির মিশ্রণ
বহুসংস্কৃতি, বহুজাতিক, বহুধর্মীয় দেশ হলো জর্জিয়া। ককেশাস পর্বতমালা এবং কৃষ্ণসাগরের মধ্যবর্তী অপূর্ব সুন্দর দেশটি বিশ্বের প্রাচীনতম বসতি এলাকাগুলির একটি। এই ছোট দেশে প্রায় ৩৭ লাখ মানুষ মানুষ বাস করে। ভৌগোলিকভাবে, এটি ইউরোপ এবং এশিয়ার সীমানায় অবস্থিত, তবে দেশের নাগরিকেরা জর্জিয়াকে "ইউরোপের ব্যালকনি" বলে।
তিবিলিসি, একটি সাংস্কৃতিক রাজধানী
পঞ্চম শতাব্দী থেকে তিবিলিসি জর্জিয়ার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। রোমান, আরব, তুর্কি, পার্সি সহ অনেকেই দখল করতে এসেছে শহরটিকে। তারা সকলেই এ শহরে নিজেদের চিহ্ন রেখে গিয়েছে। ১৭৯৯ সালে জর্জিয়া আক্রমণ করে রাশিয়া এবং সোভিয়েত আমলের শেষ পর্যন্ত এখানেই ছিল তারা। তিবিলিসি শান্তি সেতু এবং কনসার্ট হলের মাধ্যমে বর্তমান সময়কে উদযাপন করে।
পুরোনো শহর এবং দুর্গ
তৃতীয় শতাব্দী থেকে, নারিকালা দুর্গটি প্রাচীন শহরটির উপর নজরদারি চালাতো। তখন ঘরগুলিতে সাধারণ কাঠের বারান্দা ছিলো। একাধিক গলির গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে দুর্গে পৌঁছাতে হয়। বিশাল দুর্গটি একাধিক সময়ে একাধিক শাসককে আধিপত্য বিস্তার করতে এবং পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে দেখেছে। এই দুর্গ বারবার ধ্বংস হয়েছে এবং পুনর্নির্মিত হয়েছে। ১৮২৭ সালে গানপাউডারের গুদামে বজ্রপাতের ফলে এটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
যেখানে রাজাদের বাস
মেতেখি ভার্জিন মেরি চার্চটি তিবিলিসিতে প্রবাহিত কুরা নদীর তীর থেকে দেখা যায়। দ্বাদশ শতাব্দি থেকে, জর্জিয়ান রাজাদের বাসস্থান ছিল এখানে। গির্জার পাশের অশ্বারোহী স্মৃতিস্তম্ভের মাধ্যমে তা বোঝা যায়। তিবিলিসির প্রতিষ্ঠাতা রাজা ভাখতাং গোরগাসালির ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে। ১৯৩৭ সালে, সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় বাসভবনটি ভেঙে ফেলা হলেও গির্জাটি রক্ষা পেয়েছিল।
৭০০ বছরের গোসল সংস্কৃতি
আবানোতুবানি জেলাটি তার উষ্ণ প্রস্রবণের ফলে তিবিলিসির প্রাচীনতম অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রস্রবণগুলি ৭০০ বছর ধরে ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু পার্সিয়ান-শৈলীর গোসলখানাগুলি পরে সপ্তদশ শতকে নির্মিত হয়। গোসলের ঘরগুলি গম্বুজযুক্ত ইটের খিলানের নীচে অবস্থিত। তাদের মধ্যে অনেকগুলি এখনো ব্যবহার করা হয়। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য এই জায়গা বেশ জনপ্রিয়।
সাত হাজার বছর ধরে ওয়াইন
জর্জিয়া থেকে আসা আঙুরের প্রজাতি যেমন চিনুরি, রকাতসিটেলি বা ওজালেশির রীতিমতো সুনাম রয়েছে। সবচেয়ে বড় ওয়াইন উৎপাদনকারী এলাকাগুলি পূর্বদিকে কাখেতিতে অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, জর্জিয়ায় সাত হাজার বছর আগে ওয়াইন বানানো শুরু হয়েছিল। এখনও অ্যামফোরায় ওয়াইন উৎপাদন হয়। ইউনেসকো এই পদ্ধতিটিকে ২০১৩ সালে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (ইনটানজিবল) তালিকায় স্থান দিয়েছে।
সোভিয়েত শাসনের ৭০ বছর
জর্জিয়ায় গেলে সোভিয়েত যুগের ধ্বংসাবশেষ যেমন বাড়ি, কারখানা, স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে পাবেন। কাজবেগি পর্বতের কাছে একটি সাবেক সামরিক সড়কে এই ভিউয়িং প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। এগুলি সবই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসাবে জর্জিয়াকে ৭০ বছর 'দখল' করে রাখার করার চিহ্ন। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে জনগণ গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়।
ককেশাসে হাইকিং
একাধিক বৈচিত্র্যময় দৃশ্য এবং জলবায়ুর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় এখানে। ককেশাসের পাহাড়ি গ্রাম থেকে কৃষ্ণসাগরের সৈকত পর্যন্ত, জর্জিয়ার প্রায় অর্ধেক অরণ্যে ঢাকা। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ পাহাড়ি এলাকা, যেখানে বেশ কিছু পাঁচ হাজার মিটার (১৬ হাজার ৪০৪ ফুট) চূড়া রয়েছে। অসংখ্য প্রকৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র এবং জাতীয় উদ্যানের উপস্থিতির ফলে হাইকারদের আদর্শ জায়গা জর্জিয়া।
একটি দূরবর্তী ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,২০০ মিটার (৭২১৮ ফুট) উপরে, গ্রেট ককেশাসে রয়েছে উশগুলি। চারটি গ্রামের মিলিত এই জায়গার শিকড় খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকের। উশগুলিকে ইউরোপের সর্বোচ্চ স্থায়ী বসবাসের স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে সুরক্ষিত টাওয়ার সহ গ্রামগুলি ইউনেসকোর ঐতিহ্যবাহী এলাকার তালিকায় জায়গা পেয়েছে।
ভার্দজিয়া — পাথুরে শহর
জর্জিয়ার দক্ষিণে ভার্দজিয়া গুহা শহরে ৫০ হাজার জন লোক বাস করত। তুর্কি এবং পার্সিদের হাত থেকে রক্ষা করতে দ্বাদশ শতকে দুর্গ আকারে এটি তৈরি করা হয়। ৫০০ মিটার (১৬৪০ ফুট) উচু একটি পাথরের মুখ সাধারণ সরঞ্জামের মাধ্যমে হাত দিয়ে খোদাই করা হয়। সাতটি তল রয়েছে এই দুর্গের। শহরে বেকারি, আস্তাবল, কোষাগার এবং একটি গির্জাও ছিল।
কুতাইসির সাবেক রাজধানী
কৃষ্ণসাগরের উপকূল থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার (৯৯ মাইল) দূরে জর্জিয়ার সাবেক রাজধানী কুতাইসি অবস্থিত। এটি দশম শতাব্দী থেকে ১১২২ সাল পর্যন্ত জর্জিয়ান রাজাদের বাসস্থান ছিল। অনেকের সমাধি আছে এখানে। গির্জা, মঠ, প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এবং ভালভাবে সংরক্ষিত মধ্যযুগীয় শহর এই শহরটি সত্যি দেখার মতো। এটি পশ্চিম জর্জিয়ার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
উপকূলীয় শহর বাতুমি
কৃষ্ণসাগরের উপকূলে একটি হালকা ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু রয়েছে। বাতুমি বন্দর শহরটি হলো জর্জিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর। সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যেতে চাইলে এটি আদর্শ। প্রাচীন আমলের আবাসিক ভবন, বিশাল মল এবং বিলাসবহুল আবাসিক ভবন সবই এখানে পাবেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখানে বিনিয়োগ করেছেন।
আতিথেয়তা এবং ঐতিহ্য
আজারবাইজানীয়, আর্মেনিয়ান, আর্মেনিয়ান, ইহুদি এবং গ্রিকসহ জর্জিয়ায় ২০টিরও বেশি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তারা তাদের ঐতিহ্য ও রীতিনীতি সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। আর জর্জিয়ানরা? তারা নিজস্ব ঐতিহ্য ভালোবাসে এবং ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত এবং নৃত্যের মাধ্যমে উৎসব উদযাপনের সময় ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরার সুযোগ ছাড়ে না। এখানকার লোক উৎসব সত্যিই দেখার মতো।
আনে তেরমেশে/আরকেসি