ছেলের মৃত্যুর বিচারপ্রার্থী মা ভোটযুদ্ধে
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২২০২০ সালের ১০ জুলাই ইছাপুরের নেতাজি পল্লীর বাসিন্দা শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। তাকে প্রথমে অসুস্থ অবস্থায় কামারহাটির ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কোভিড সন্দেহে নানা টালবাহানা ও তারপর দিনভর শুভ্রজিৎকে নিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন তার বাবা-মা। একের পর এক নার্সিংহোম আর হাসপাতালে ঘুরে রাত পৌনে দশটায় মৃত্যু হয় বছর আঠারোর শুভ্রজিতের। এরপর এক নার্সিংহোম, তিনটি বড় হাসপাতাল ও বেলঘরিয়া থানার বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে কলকাতা হইকোর্টের দ্বারস্থ হন অসহায় শুভ্রজিতের অভিভাবকেরা। এরপর হাইকোর্ট শুভ্রজিতের ময়নাতদন্ত ও আরটিপিসিআর টেস্টের নির্দেশ দেয়। মৃত্যুর এক বছর পরে রিপোর্টে জানা যায়, শুভ্রজিতের কোভিড হয়নি।
শুভ্রজিতের মৃত্যুর পর তার মা শ্রাবণী চট্টোপাধ্যায়ের লড়াই থেমে যায়নি। এখনো বিচারের আশায় বসে তিনি। তারই মাঝে পুরভোটে উত্তর ব্যারাকপুর পুরসভায় ছয় নং ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিএম প্রার্থী হয়েছেন তিনি। সন্তান হারানোর ব্যথা ভুলতে ভোট ময়দানে, নাকি এটা পুত্রের মৃত্যুর বিরুদ্ধে জেহাদ? কেন এলেন রাজনীতির মঞ্চে?
বছর ৪৭-এর শ্রাবণী বলেন, "দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছিলাম। সেটা এখনো অধরা। সরকার আমার পাশে দাঁড়ায়নি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবে না। তবে সরকারের বিরোধিতা করতে নয়, ব্যক্তিগত পছন্দেই বামপন্থায় বিশ্বাস রেখেই প্রার্থী হয়েছি।"
রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে তিনি হতাশ। ছেলের মৃত্যুর সময় যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তাতে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শূন্য দিতে চান তিনি। বলেন, "একটা ১৮ বছরের তরতাজা ছেলে সামান্য অসুস্থতা নিয়ে চারটে হাসপাতাল ঘুরল এবং বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। কলকাতা মেডিকেল কলেজ কি ছেলেটাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে আরটিপিসিআর টেস্ট করাতে পারত না? কোভিড হয়েছে বলে দেহ সরিয়ে দিয়েছিল। অথচ কোনো রিপোর্ট দেয়নি। বিনা টেস্টে এটা কীভাবে হল?"
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র শুভ্রজিতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আঠারোয় পা রেখেছিল ছেলে। সেবার ভোটাধিকার পেত। কিন্তু সেটা হল না।" বেদনার সুর এখন প্রতিবাদের
কন্ঠে পরিণত হয়েছে শ্রাবণীর। কতটা বিচার পেয়েছেন? তিনি বলেন, "আইনের উপর সম্পূর্ণ ভরসা আছে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া এগোয়নি। দু বছর হয়ে গেল আমার দায়ের করা মামলার শুনানি হয়নি।"
২৭ ফেব্রুয়ারি উত্তর ব্যারাকপুরের ভোট। প্রচারে নেমে এলাকার মানুষের অভাব অভিযোগ নিয়ে কথা বলছেন তিনি। এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর দিকেই তার নজর। যে মর্মান্তিক ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেছে, সেটা যাতে অন্য কারো ক্ষেত্রে না হয়, সেটাই লক্ষ্য। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেন, "উত্তর ব্যারাকপুর পৌরসভার অধীনে একটি পৌর হাসপাতাল রয়েছে, সেটা প্রায় পরিষেবাহীন। আমি দেখেছি এলাকার কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে দূরে বি এন বসু হাসপাতাল নিয়ে যেতে হয়। একটা ভাল হাসপাতাল থাকলে এই সমস্যায় কেউ পড়ত না।"
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প সাড়া জাগিয়েছে। মাথাপিছু পাঁচ লাখ টাকা স্বাস্থ্যবিমার সুযোগ পান রাজ্যবাসী। এই প্রকল্প নিয়ে শ্রাবণীর প্রশ্ন, স্বাস্থ্যসাথীর মত প্রকল্প কি সকলের কাছে পৌঁছেছে? শুধু প্রকল্প থাকলেই হবে না, তার সুবিধা যাতে সবাই পান, সেটাও দেখতে হবে।
প্রতিবাদের মুখ যারা, তাদের সরাসরি নির্বাচনী লড়াইয়ে দেখা যাচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে উন্নাও গণধর্ষণ কাণ্ডে নির্যাতিতা কিশোরীর মা আশা সিংকে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস। অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নারী সুরক্ষা ও ন্যায় বিচারের দাবিতে লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কংগ্রেস আশাকে বেছে নিয়েছে। একইরকম ভাবে পশ্চিমবঙ্গেও বিনা চিকিৎসায় মৃত সন্তানের মাকে প্রার্থী করা হয়েছে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে। অতীতে বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসের হত্যার পর তৃণমূল তাঁর স্ত্রী রূপালী বিশ্বাসকে লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী করেছে।
এটা কি নির্বাচনী রাজনীতির নতুন ঝোঁক? রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীলাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, "যাদের জীবনে এত বড় বিপর্যয় ঘটেছে, সেটা ব্যবহার করে কোনো রাজনৈতিক দলের ভোট পাওয়া উচিত নয়। এটা অনৈতিক। অনেক সময় এতে সিমপ্যাথি ভোট পেতে সুবিধা হয় দলের। শহিদদের পরিজন বা রাজনৈতিক কারণে নিহতদের অনেক সময় ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। এটা মানবিকতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ। ভোট আসবে, ভোট যাবে। কিন্তু মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা উচিত।"
কিন্তু সাধারণ মানুষের লড়াইকে একমাত্র রাজনীতিই সফল করতে পারে। ভোটের জয় এনে দিতে পারে ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা সাধারণের আছে নাকি? সন্তানহারা মায়েরা প্রতিবাদের মুখ নয় তাহলে? নীলাদ্রি বলেন, "প্রতিবাদের মুখ সবসময়
বিপর্যস্ত পরিবার থেকে হতে হবে কেন? তাহলে প্রশ্ন আসে, আড়ালে রাজনৈতিক দল সিমপ্যাথি ভোট চাইছে না তো? এমনকি ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ার পর সহানুভূতি ভোটে কংগ্রেস বিপুল জয় পেয়েছিল।"