ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কিনা তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভক্ত। এই নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত।
বাকের মজুমদার (আহ্বায়ক, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
গত বছরের ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী হল প্রশাসনের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে হলে ছাত্র রাজনীতি করা যাবে না। এখানে লাভ-ক্ষতির চেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষার্থীরা কি চায়? তারা একমত যে, হলে তারা ছাত্ররাজনীতি চায় না। আমরা যেহেতু শিক্ষার্থীদের পক্ষে, তাদের চাওয়াই আমাদের চাওয়া। আমরা হলে যেমন ওপেন রাজনীতির বিরোধিতা করছি, তেমনি গুপ্ত রাজনীতির যে কথা শুনতে পাই, সেটাও বন্ধ হওয়া উচিৎ।
নুজিয়া হাসিন রাশা (সভাপতি, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নিজেই একটি রাজনৈতিক প্রজেক্ট - জনগণকে রাজনৈতিকভাবে নিরস্ত্র করার, তাদের সংগঠিত প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়ার এবং শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষিত করার কৌশল। রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ মূলত গুপ্ত সংগঠন, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থগোষ্ঠী, কর্পোরেট এনজিও ও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করে, যা জনগণের গণতান্ত্রিক স্পেসকে সংকীর্ণ করে। প্রতিরোধের রাজনীতি করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার।
মেঘমল্লার বসু (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব না, হয় তা প্রকাশ্যে থাকে নয়তো তা গুপ্ত পথ নেয়। রাজনীতি নিষিদ্ধ করার অর্থ, প্রকাশ্য রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করে গুপ্তপন্থাকে প্রণোদনা দেওয়া। এহেন পদক্ষেপ অন্তর্ঘাতের দরজা খুলে দেয়।
আরমানুল হক (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আমি যখন হলে অবস্থান করব, তখন তো আমার পরিচয়কে লুকাতে পারি না! হলে ছাত্র রাজনীতি সমস্যা, নাকি হলের দখলদারিত্ব সমস্যা? হলে যদি ১ম বর্ষ থেকেই প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে বৈধ সিটের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে কীভাবে একটা নির্দিষ্ট দল দখল করতে পারে? আর ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হল সংসদকে প্রশ্ন করার জন্য ছাত্র রাজনৈতিক দল ছাড়া ভিন্ন কোন ফোরাম আছে কিনা, তা একটা বড় প্রশ্ন।
আশরেফা খাতুন (মুখপাত্র, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, হলে নিয়োজিত হাউজ টিউটররাও ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গণরুম, গেস্টরুমের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারেন নাই। হলভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কমিটি দেওয়া শুরু হলে আবারও এক চিত্রের আবির্ভাব ঘটবে। আমি চাই, আবাসিক হলগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই প্রতিনিধিত্ব করুক যাতে দখলদারিত্ব, গণরুম, গেস্টরুমের বিভীষিকা ফিরে না আসে।
নাহিদুজ্জামান শিপন (সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনগুলোর সূত্রপাত ঘটে হলগুলোর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। হলে রাজনীতি বন্ধ রাখার এমন সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অগণতান্ত্রিক। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে ডাকসু নির্বাচনকে অর্থবহ করা যাবে না।
এস এম সাইফ কাদের রুবাব (মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হল রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা আদতে ডাকসুকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যন্ত্রের হাতে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোন কল্যাণে আসবে না।
জাহিদুল ইসলাম তাহসিন (শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
ক্যাম্পাসের বড় সমস্যাগুলোর একটি সিট সংকট, আর হলে রাজনীতি ফিরে এলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নেতারা প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের অগ্রাধিকার দিতে পারে। একই সঙ্গে হলে একক প্রশাসনিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে, কারণ ভিন্ন ভিন্ন দল নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠবে। এর ফলে হলের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে এবং পড়াশোনার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
মারুফ হাসান শাহিন (শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হলে ছাত্র রাজনীতি চালু হলে আগের মতো গণরুম প্রথা ফিরে আসতে পারে, কারণ অতীতে দেখা গেছে সরকার দলের রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে বছরের পর বছর অবৈধভাবে হলে অবস্থান করত। একইভাবে পরিচয় পর্ব ও ম্যানার শেখানোর নামে গেস্টরুম প্রথাও আবার শুরু হতে পারে। দলীয় কোন্দল বেড়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কেননা আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কিনা তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভক্ত। কেউ চান রাজনীতি ফিরে আসুক, কেউ চান রাজনীতি বন্ধ থাক। এসব বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা, সাধারণ শিক্ষার্থীরা ডয়চে ভেলের কাছে জানিয়েছেন তাদের মতামত।