ছাত্র সংসদ নির্বাচন, কলেজের ঘাড়ে দায় চাপালো সরকার
২৭ আগস্ট ২০২৫কয়েক বছর ধরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গে। এই নিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়। সরকারী আইনজীবীর মতে, "কলেজগুলোর উদ্যোগের অভাবেই নির্বাচন হয়নি।" এর পরেই শুরু হয় তর্জা।
কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বাধা দেয়নি রাজ্য। মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টে এই কথা জানালেন সরকার পক্ষের আইনজীবি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বেশ কয়েক বছর হলো ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গে। অথচ প্রতি বছর এই নির্বাচন হওয়ার কথা। রাজ্যের অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর অভিযোগ, রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র শাখা তৃণমূল ছাত্র পরিষদ এই নির্বাচন হতে দিচ্ছে না।
এই নিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়। মঙ্গলবার সেই মামলার শুনানিতে কল্যাণ বলেন, "কলেজগুলোর উদ্যোগের অভাবেই নির্বাচন হয়নি।" এই শুনানির পরেই শুরু হয় তর্জা। মামলাকারীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য কল্যাণের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আদালতে তথ্য দিতে বলেন। হাইকোর্ট কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এই মামলায় যুক্ত করে।
এসএফআইসহ অন্যান্য বাম ছাত্র সংগঠনগুলি নির্বাচনের দাবিতে একাধিকবার আন্দোলনে নেমেছে। এসএফআই-এর সর্বভারতীয় সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "সরকার কি মানুষকে সত্যি এত বোকা ভাবে? এটা কখনো হতে পারে যে সরকার ছাত্রভোট করাতে চাইছে, কিন্তু কলেজগুলো করছে না? সরকারি দল নিজেদের ছাত্রসংগঠনের সভার জন্য পরীক্ষার তারিখ অবধি পালটে দিচ্ছে জোর করে! আসল কথা হলো, ছাত্রভোট করানোর মুরোদ নেই! তৃণমূল জানে, যেখানে ভোট হবে, সেখানে ওরা হারবে। আর যেখানে ওরা একচ্ছত্র, সেখানে ওরা নিজেদের মধ্যে মারপিট করে বগটুই ঘটাবে! মনোজিৎদের হাতে কলেজ ইউনিয়নগুলো রেখে দিতে চায় সরকার, তাই এত টালবাহানা!"
'শিক্ষার বেসরকারিকরণ করতে চায় সরকার'
অন্যদিকে, আইসা বা অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সভাপতি ঋতম মাজির মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের মতো শিক্ষাকে বেসরকারিকরণ করতে চায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারও। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "শিক্ষা বিষয়ে ডাব্লিউটিও ভারতকে যে পরামর্শ দিয়েছিলো তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষার বেসরকারিকরণ এবং ক্যাম্পাসগুলিকে রাজনীতি মুক্ত রাখা। কেন্দ্রীয় সরকার অক্ষরে অক্ষরে সেই নীতি মেনে চলছে। এমনকী, আমরা দেখতে পাচ্ছি রাজ্য সরকারও একই নীতি নিয়েছে। ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিকেশ করার চক্রান্ত যেমন জেএনইউতে দেখা গেছে ঠিক অনুরূপ চক্রান্ত দেখা যাচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে। ছাত্র নির্বাচন বন্ধ করাই নয়, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষণার পর দীর্ঘ সময় পার করে তবে সরকারি কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করা হলো। এতে লাভবান হলো বেসরকারি কলেজগুলো। এর ফলে ভবিষ্যতে শিক্ষাকে বেসরকারিকরণ করতে সুবিধা হবে।"
প্রসঙ্গত, ছাত্র নির্বাচনের দাবিতে এই বছর মার্চে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কাছে ডেপুটেশন দিতে যান ছাত্রছাত্রীরা। সেই সময় মন্ত্রীর গাড়ি গতি বাড়ানোয় তার তলায় পড়ে যান এক ছাত্র। সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে এসএফআইএর কলকাতা জেলার সেক্রেটারি দীধিতি রায় বলেন, "নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ভাবে হতে পারে সেই আলোচনা করার জন্য একাধিক বাম ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। আমরা চেয়েছিলাম, সরকারপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্র ছাত্রীরা একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নিক। তার পরে যা হলো তা কোনো সভ্য সমাজে হয় না। সরকার একেবারেই চায় না নির্বাচন হোক। এর আগেও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারিম উপাচার্যকে আমরা নির্বাচন করার কথা জানিয়েছিলাম। কেউ মৌখিক ভাবে, আবার কেউ লিখিত আকারে জানিয়েছিলেন সরকারের অনুমতি পেলে নির্বাচন হবে। কিন্তু সেই অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না। একাধিক অজুহাত দেখিয়ে সরকার নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করছে।"
'পরীক্ষার কারণেই হচ্ছে না নির্বাচন'
তৃণমূল ছাত্র পরিষদ অবশ্য সরকার এবং তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "যারা অভিযোগ করছেন ৯০ শতাংশ ক্যাম্পাসে তাদের ইউনিট পর্যন্ত নেই। আমরাই কলেজগুলিতে আছি। তাহলে আমরা নির্বাচন চাইব না কেন? আমরা চাই নির্বাচন হোক। ওদেরকে (অন্যান্য ছাত্র দলকে) খুঁজে পাওয়া যাবে না।"
নির্বাচন না হওয়ার পিছনে তৃণাঙ্কুর অবশ্য সিবিসিএস-এর শিক্ষা এবং পরীক্ষা পরিকাঠামোকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন। "ছয় মাসে একবার করে পরীক্ষা হয়। একটা বড় সময় ফর্ম ভরা, রেজিস্ট্রেশন পর্বে কেটে যায়। তার উপর মূল পরীক্ষার আগে টেস্ট, প্রিটেস্ট এবং ক্লাস চলে। তাহলে নির্বাচনটা হবে কখন?"
'সরকারি সদিচ্ছার অভাব'
আদালতে জনস্বার্থ মামলাটি করেছিলেন আইনজীবী সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই নির্বাচন হয়নি। তিনি জানান, "দুই বছর ধরে মামলা চলছে। সরকার একাধিক বার নোটিফিকেশন দিয়ে নির্বাচন বন্ধ করেছে। ২০১৭-তে কলেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আইন নিয়ে এসেছে। তার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নির্দেশ দিয়ে নির্বাচন করাতেই পারত। করায়নি। কারণ রাজ্য সরকার চায়নি। কখনও পার্মানেন্ট ভিসি নেই বলে, কখনও মামলার অজুহাতে নির্বাচন করায়নি। আমাদের লক্ষ্য সেটা সঠিক ভাবে করানো। একটা সাফল্য হলো জে কলেজে ইউনিয়নগুলো ডিফাঙ্কট, শখিন কলকাতা ল কলেজের ধর্ষণের ঘটনার পর আদালতের নির্দেশে সেই ইউনিয়নও রুমওগুলোকে আমরা বন্ধও করতে পেরেছি। ভবিষ্যতে নির্বাচনও হবে।"
নির্বাচনের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি তৈরি করা নিয়েও জনস্বার্থ মামলা চলছে।