নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে তাদের কমিটি ঘোষণা করে। সেই ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে বিপত্তি। গভীর রাতে ‘সাধারণ ছাত্র'—এই ব্যানারে বিপুলসংখ্যক ছাত্র চলে আসে উপাচার্যের কাছে। দাবি তাদের—হলে কোনো ছাত্র রাজনীতি চলবে না। এ নিয়ে বাক-বিতণ্ডা। এই সময়েই উঠে আসে ‘গুপ্ত রাজনীতি' বিষয়টা। যারা কমিটি দিয়েছে, অথবা দিতে চায়, তাদের প্রশ্ন হলে ছাত্র রাজনীতি না চললে, তাহলে কী চলবে? গুপ্ত রাজনীতি?
প্রশ্ন হচ্ছে, এই গুপ্ত রাজনীতি বিষয়টা কী? আগে শুনতাম আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সের কথা। স্বাধীনতার পরপর চরম বামপন্থিদের অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স করতেন। বহুল আলোচিত সিরাজ শিকদারের দল পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির রাজনীতি ছিল এই তালিকায়। যে দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাদের যে রাজনীতি, সেটাই আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স।
চলছে নিষিদ্ধ দলের তৎপরতা
বর্তমান সময়ে হিজবুত তাহরিরকে এই তালিকায় ফেলা যেতে পারে। তারা নিষিদ্ধ দল। কিন্তু তাদের তৎপরতা কিন্তু চলছে। প্রায়ই শহরের বিভিন্ন দেয়ালে তাদের ঢাউস ঢাউস পোস্টার দেখা যায়। এটা তারা কখন লাগায়, কে পড়ে বলতে পারব না। পোস্টারের লেখাগুলো ছোট ছোট। দূর থেকে দেখা যায়, কিন্তু পড়া যায় না। পড়তে হলে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় মাঝেমধ্যে এসব দেখেছি। কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়ার সাহস হয়নি। ভেবেছি—কেউ যদি দেখে ফেলে! যদি ভাবে এই সংগঠনের প্রতি আমার কেন এত আগ্রহ? ফলে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পড়া আর হয়নি। এটাই আন্ডারগ্রাউন্ড বা গোপন সংগঠনের বৈশিষ্ট্য। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, হাঁটতে হাঁটতে পড়া যে যায় না, এটা জেনেও এরা এমন ছোট আকৃতির লেখা সংবলিত পোস্টার লাগায় কেন? সম্ভবত তারা কেবল জানান দেয়, তাদের সংগঠনটিকে নিষিদ্ধি করা হলেও তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বোঝাতে চায় তারা বেশ ভালোভাবেই জীবিত আছে।
ছদ্মবেশী শিবিরের রাজনীতি
এখানেই আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সঙ্গে গুপ্ত রাজনীতির পার্থক্য। গুপ্ততে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে, কিন্তু সেটা চলবে অন্য পরিচয়ে। হাসিনার শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলের তেমন কোন অবস্থানই ছিল না। অন্য কোনো দল করলে হল থেকে বিতাড়িত হতে হতো। আর জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতি করার তো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেখা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মীরা তো ছিলই, এমনকি তাদের রীতিমতো কমিটি পর্যন্ত ছিল। কীভাবে থেকেছে এরা? এদের অনেকেই ছাত্রলীগের সঙ্গে মিশে ছিল। ছাত্রলীগের কর্মী ছিল, নেতা পর্যন্ত ছিল। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অনেক বছর ধরে একটা অভিযোগ ছিল তারা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালাতো। সেই সব অপকর্মে কি এই ছদ্মবেশী শিবিরের লোকেরা অংশ নিত না? অবশ্যই নিত। না নিলে তো তারা ছাত্রলীগেই থাকতে পারত না।
এই যে অন্য পরিচয়ে থেকে গোপনে নিজের রাজনীতিটা করে যাওয়া, এটাকেই বলা হচ্ছে গুপ্ত রাজনীতি। গুপ্ত রাজনীতির অসাধারণ একটা উদাহরণ তৈরি করেছে ছাত্রশিবির। ৫ আগস্টের পর ছাত্র শিবিরকে দেখা গেছে আন্দোলনে তাদের কত জোরালো ভূমিকা ছিল, সেটাকে ঘটা করে প্রচার করতে। সে সময়ই প্রথম জানা যায়—কীভাবে তাদের লোকজন বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে নিজেদের পরিচয় গোপন করে কাজ করেছে। এসময় একটা মোক্ষম প্রশ্ন তুলেছিলেন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিব। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, হাসিনার শাসনামলে ছাত্র শিবিরের যতগুলো কমিটি ছিল, সেগুলোতে আসলে কারা কারা ছিল। নামগুলো পেলে হয়ত বোঝা যেত কোন কোন সংগঠনের পরিচয়ে গুপ্তভাবে ছিল। বলাবাহুল্য, ছাত্রশিবির সেই তালিকাটি শেষ পর্যন্ত আর প্রকাশ করেনি। আগে না হয় একটা প্রতিকূল পরিবেশ ছিল, তাই তারা গুপ্ত থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। এখন তো আর সেই অবস্থা নেই। তাহলে এখনও কেনো তাদের পুরানো নেতৃত্বের নামগুলো প্রকাশে দ্বিধা করছে তারা?
অনেকে বলেন কেবল ছাত্র লীগেই নয়, ছাত্রদল বা অন্যান্য সংগঠনেও ছাত্র শিবিরের অনেকে ছদ্মবেশে ছিল। তারা হয়ত এখনও মূল দলে দাপটের সঙ্গে বিরাজ করছেন। সে কারণেই তারা পূর্ববর্তী কমিটিগুলোর নাম প্রকাশ করতে চান না! হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। তবে বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়েছে। সকল সংগঠনের মধ্যে এ নিয়ে কেবল আলোচনাই নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে আতঙ্ক পর্যন্ত ছড়িয়েছে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গুপ্ত রাজনীতির প্রসঙ্গটি এসেছে কিছুটা অন্যভাবে। ছাত্রদল যখন ১৮টি হলে তাদের শাখা গঠন করল, তখন ‘সাধারণ ছাত্র'—এই নাম নিয়ে প্রতিবাদ করা হলো। তারা বলল, হল পর্যায়ে রাজনীতি শুরু হলে, আবার সেই গণরুম সংস্কৃতি শুরু হতে পারে। এমন আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। ছাত্রলীগ বিতাড়িত ও নিষিদ্ধ হওয়ার পর, নতুন সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুমের সেই নির্যাতন কিন্তু আর অবশিষ্ট নেই। জোর করে কাউকে মিছিলে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা নেই। আগের এবং পরের এই দুই অবস্থা যারা দেখেছে, তুলনা করেছে, তাদের মধ্যে এমন আতঙ্ক থাকতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ‘সাধারণ ছাত্র' এর ব্যানারে যারা আপত্তিটা তুলছে, তারা কি আসলেই সাধারণ ছাত্র? হলে রাজনীতি বন্ধের কথা যারা বলছেন তারা নিজেরাও কি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট নন?
অনেকেই বলছেন, এরা আসলে ছাত্র শিবিরের লোক। ছাত্র শিবিরের নতুন ছদ্মবেশ হচ্ছে ‘সাধারণ ছাত্র।' তাহলে তারা কি হলগুলোতে রাজনীতি করছে না? তাদের কি সেখানে কমিটি নেই? আসলে তারা হলগুলোতে গুপ্ত রাজনীতি করছে। বিভিন্ন সমাজকল্যাণ বা সেবামূলক সংগঠন গড়ে তুলেছে। ছাত্রদের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে ফিলটার দিচ্ছে, ভালোমন্দের দিকে খেয়াল রাখছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে বলছে, আমরা শিবির নই সাধারণ ছাত্র। এটা শিবিরের বহুল ব্যবহৃত এবং পরীক্ষিত কার্যকর একটা পদ্ধতি। প্রয়োজন অনুযায়ী এরা কখনো অরাজনৈতিক সাধারণ ছাত্র, আবার কখনো বা শিবিরের পরীক্ষিত কর্মী।
দুএকটা উদাহরণ দিই। বর্তমানে ছাত্র শিবিরের যিনি কেন্দ্রীয় সভাপতি তিনিবুয়েটের ছাত্র। অথচ আমরা সবাই জানি আবরার হত্যার পর থেকে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ছিল। তাহলে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি কোনও রাজনীতি করতেন না? অরাজনৈতিক একজন ব্যক্তিকে শিবির তাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বানিয়ে দিয়েছেন? একই কথা বলা যায় শিবিরের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কেও। তিনি এসেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, এখানেও অনেক বছর ধরে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল! অর্থাৎ, আরও অনেকের মতো এই দুইজনও অরাজনৈতিক পরিচয়ে রাজনীতি করেছেন। অর্থাৎ গুপ্ত রাজনীতি করেছেন!
মধ্যরাতে ‘সাধারণ ছাত্র'রা যখন মিছিল করে ভিসির কাছে গেলেন, নানা আলোচনার পর ভিসি জানালেন হল পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি চলবে না, গুপ্ত রাজনীতিও চলবে না। প্রথমটি বললেন ‘সাধারণ ছাত্র'দের দাবিতে, দ্বিতীয়টি ছাত্রদলের দাবির প্রেক্ষিতে। এমন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে একটা সরল প্রশ্ন কিন্তু উঠতেই পারে—যে রাজনীতি গুপ্ত, সেটাকে আপনি বন্ধ করবেন কীভাবে? কেউ তো আর স্বীকার করবে না যে, সে গুপ্ত রাজনীতি করছে।
এখানে আর একটি প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক, সেটা হচ্ছে—হলে যদি ছাত্র সংগঠনের কমিটি না থাকে, তাহলে সেখানে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন হবে কীভাবে? এই যে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে সেটা নির্দলীয়ভাবে হচ্ছে? না, এতে ছাত্রলীগ ব্যতীত সকল রাজনৈতিক দলই অংশ নিচ্ছে। যে ছাত্র ডাকসুতে ভোট দেবে সেই একই ছাত্র তো তার হল সংসদ নির্বাচনেও ভোট দেবে। তাহলে ডাকসুতে ছাত্র সংগঠনের উপস্থিতি থাকলে হলে থাকবে না কেন? এসব প্রশ্নের আসলে কোনোই জবাব নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসির কিছু কিছু কর্মকাণ্ড আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। যতদূর জানি, ছাত্রজীবনে উনি শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সে বিবেচনায় শিবিরের প্রতি ওনার এক ধরনের ভালোবাসা থাকতেই পারে। কিন্তু সেই ভালোবাসা যেন দৃষ্টিকটু পর্যায়ে উপনীত না হয়, সেদিকেও উনাকেই খেয়াল রাখতে হবে। আর একটা বিষয়, উনি যদি মনে করেন ছাত্রনেতাদের কর্মকাণ্ড হলগুলোতে শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করছে, তখন সেটাকে থামানোর দায়িত্বও তো তারই। প্রতিটা হলে প্রোভোস্ট আছেন, হাউস টিউটরগণ আছেন। এদের দায়িত্ব হলের মধ্যে ভালো-মন্দ কী হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখা। এখন এসব পদে যদি দলীয় শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে তাদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে পক্ষপাতিত্ব দেখা দেবেই। আওয়ামী লীগের শাসনামলে খুব প্রকটভাবে দেখা গেছে। আগামীতেও যে এটা দৃশ্যমান হবে না, সে গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারবে না। এরা যতটা না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তারচেয়েও যেন অনেক বেশি দলদাস শিক্ষক। সরকারি দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে এদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলে। সেই প্রতিযোগিতায় যারা এগিয়ে থাকেন, তারাই পান বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব পদ। ফলে যতদিন শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ না হবে, যতদিন এরা নিজস্ব মেরুদণ্ডের ওপর শক্ত হয়ে না দাঁড়াতে পারবে, ততদিন ছাত্র রাজনীতির দানবীয় রূপ প্রকাশিত হতেই থাকবে, সাধারণ ছাত্রদের ওপর নিপীড়ন চলতেই থাকবে। সেক্ষেত্রে রাজনীতি গুপ্ত নাকি উন্মুক্ত—সেটা তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হবে না। কৌশলগত কারণেই কিছু সময়ের জন্য সেটা ‘গুপ্ত' চেহারা নেবে, পরে আবার সময় বুঝে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বের হয়ে আসবে।