চীনে মোদী, এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে থাকছেন পুটিনও
৩০ আগস্ট ২০২৫এর আগে জাপান সফরের দ্বিতীয় দিনটি ছিল ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জাপানের বিভিন্ন এলাকার ১৬ জন গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন মোদী। টোকিওর এই আলাপচারিতায় দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া উন্নত করার বিষয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে স্টার্ট আপ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা ইত্যাদি।
এ বিষয়ে এক্স হ্যান্ডেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লেখেন, বিভিন্ন প্রদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়া ভারত ও জাপানের বন্ধুত্বের স্তম্ভ হতে পারে। শুক্রবার ভারত ও জাপানের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, তার গুরুত্বের কথাও তুলে ধরেন মোদী। দুই দেশের মধ্যে ১৫তম বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে উভয়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা বৃদ্ধির উপরে জোর দেয়া হয়েছে।
গভর্নরদের সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও জাপানের আঞ্চলিক প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। দুই পক্ষ হাত মিলিয়ে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি ও বিনিয়োগে সহযোগিতা করবে, এমনটাই আশা প্রকাশ করেন মোদী।
ভারত ও জাপানের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এক্ষেত্রে দুই দেশ হাত মিলিয়ে কাজ করবে। কীভাবে স্টার্টআপ থেকে বড় বাণিজ্যিক উদ্যোগে এআই সহায়ক হতে পারে, সেটাই খতিয়ে দেখা হবে। শুক্রবার দুই দেশ আর এক দফা ডিজিটাল পার্টনারশিপের মউ স্বাক্ষর করেছে টোকিওয়।
সেমিকন্ডাক্টর ক্ষেত্রে বোঝাপড়া
গভর্নরদের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর গন্তব্য ছিল মিয়াগি অঞ্চলের সেনডাই। তিনি শনিবার জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে বুলেট ট্রেনে সফর করেন। দুজনে একসঙ্গে পৌঁছন সেনডাইতে। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরের ছবি এক্স হ্যান্ডেল প্রকাশ করেছেন মোদী। সেনডাই পৌঁছনোর পরে প্রবাসী ভারতীয় ও স্থানীয় মানুষজন তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান।
দুই প্রধানমন্ত্রী এরপরে যান টোকিও ইলেকট্রন ফ্যাক্টরিতে। এটি জাপানের শীর্ষস্থানীয় সেমিকন্ডাক্টার উৎপাদনকারী সংস্থা। এই শিল্পে টেল নিয়াগি নামের সংস্থার গুরুত্ব কতটা, তা তুলে ধরেন এখানকার শীর্ষ কর্তারা।
সেমিকন্ডাক্টর চিপের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে ভারত সহ গোটা বিশ্বে। এর যোগান নিশ্চিত করতে জাপানের সহযোগিতা চেয়েছে নয়াদিল্লি। কীভাবে ভারত ও জাপান সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ ব্যবস্থাকে দ্বিপাক্ষিক স্তরে গড়ে তুলতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
সেল ফোন থেকে টেলিভিশন ডিজিটাল ক্যামেরা থেকে কম্পিউটার, সব ক্ষেত্রেই অন্যতম চালিকাশক্তি এই মাইক্রোচিপ এই চিপের ভিতরে যে অংশটি তড়িৎ পরিবহনের কাজ করে তার নাম সেমিকন্ডাক্টর। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারত ও জাপান কীভাবে একটি বড় মাপের সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ ব্যবস্থা গঠন করতে পারে, সেই লক্ষ্যে দুই দেশ মতবিনিময় করেছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ভাস্কর গুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "জাপান সেমিকন্ডাক্টর ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া হলে ভারতের লাভ হবে।তাইওয়ানে চিপ তৈরি হয়, ইউরোপেও কিছু হয়। কিন্তু জাপান ডিজাইনে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। আমি আগেও বলেছি, সেমিকন্ডাক্টর চিপ হচ্ছে ভবিষ্যত।"
শুক্রবারের আলোচনায় ভারত ও জাপান ১০ বছরের পরিকল্পনায় সহমত হয়। মোট আটটি ক্ষেত্রকে এজন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আর্থিক সহযোগিতা, আর্থিক নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, রাজ্য ও আঞ্চলিক প্রশাসনের সঙ্গে সংযোগের মতো বিষয় রয়েছে। জাপান আগামী ১০ বছরে ভারতে দশ ট্রিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছে।
দুই দেশের দক্ষ কর্মীদের জন্য আরো উন্মুক্ত হয়ে যাবে কাজের ক্ষেত্র, এমনই আশা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ আদান-প্রদানে সম্মত হয়েছে ভারত ও জাপান। আগামী পাঁচ বছরে পাঁচ লক্ষ মানুষের আদান-প্রদান হবে দুই দেশের ভিতরে। এর মধ্যে ৫০ হাজার দক্ষ ও মাঝারি মানের দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরও থাকবেন।
যৌথভাবে মহাকাশ চর্চায় আগ্রহ প্রকাশ
বিজ্ঞান ও মহাকাশ চর্চার ক্ষেত্রেও দুই দেশ কাছাকাছি আসছে। ভারত ও জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা একে অপরের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আগ্রহী। ভারতের চন্দ্রযান-৫ প্রকল্পের জন্য এই সহায়তা ইতিবাচক হতে চলেছে।
মহাকাশ বিজ্ঞানী ড. দেবীপ্রসাদ দুয়ারী ডিডাব্লিউকে বলেন, "জাপান হল পঞ্চম দেশ যারা চাঁদের বুকে তাদের উপগ্রহ সফলভাবে অবতরণ করাতে সক্ষম হয়েছে। চন্দ্রযান ৩ এবং স্মার্ট মুন ইনভেস্টিগেশন মিশনের সাফল্যের নিরিখে গতকালের চুক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এতে ভারত এবং জাপান চন্দ্রযান ৫ এবং লুনার পোলার এক্সপ্লোরার এই মিশনটি একসঙ্গে সহযোগিতা করে কাজ করবে। যেখানে একটি জাপানি রকেটের মাধ্যমে উপগ্রহতে পাঠানো হবে অবতরণকারী যান। এই অবতরণকারী যানটি বানাবে ভারতের ইসরো। এই অবতরণকারী যানের ভিতরে থাকবে একটি স্বয়ংক্রিয় ছোট যান, যেটা চাঁদের বুকে নেমে ঘুরে বেড়াবে। এই যান মূলত তৈরি করবে জাপান।"
তিনি ব্যাখ্যা করেন, "এই প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য বিরাট। চাঁদের পৃষ্ঠদেশের তলায় জলীয় বরফের উপস্থিতি কতটা আছে, জানা খুব জরুরি। আর এক দশকের মধ্যে চাঁদে উপনিবেশ তৈরি করা হবে বলে বৈজ্ঞানিকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার জন্য দরকার হবে জলের। সেই ক্ষেত্রে চন্দ্রযান ৫ বা লুপেক্স (লুনার পোলার এক্সপ্লোরার) বিরাট ভূমিকা নেবে। এদের প্রধান কাজ হবে চাঁদের পৃষ্ঠদেশে জল এবং অন্যান্য জিনিস কতটা আছে, তা পরিমাপ করা। তাই ভারত ও জাপানের এই সহযোগিতা যুগান্তকারী বলে মনে হয়। প্রথম এই দু'টি দেশ চাঁদকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছে। শুধু চন্দ্রযান ৫-এর ক্ষেত্রেই সহযোগিতা থেমে থাকবে না। নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সেটা আরো ছড়িয়ে পড়বে। এর মধ্যে ভারতের ইসরো ও জাপানের জ্যাক্সা হাতে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রকেট উপগ্রহ বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকবে।"
সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের বৈঠক
চীনের শহর তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ২৫ তম সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের শীর্ষ সম্মেলন। দুদিনের এই বৈঠকে অংশ নিতে নরেন্দ্র মোদী এরই মধ্যে চীনে পৌঁছেছেন। এই বৈঠকে অংশ নেবেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন সহ অন্যান্য নেতারা।
এই বৈঠকের বাইরেও অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হওয়ার কথা। মূলত অর্থ, নিরাপত্তা, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই জোটের নেতারা কথা বলবেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতিতে ভারত যখন সমস্যায় পড়েছে, সেই সময়ে এই জোটের দুই শক্তিধর দেশ রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বৈঠকে মোদী কতটা সুফল তুলতে পারেন, এ নিয়ে আগ্রহ রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ী ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমার কাছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জাপান এশিয়াতে প্রথম প্রমাণ করেছিল যে এই ২১ শতক এশিয়ান শতাব্দী। তারপর জাপানের সঙ্গে সঙ্গে এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিও উন্নতি করে। প্রযুক্তিতে জাপানের ভূমিকা নিয়ে আমার বলার প্রয়োজন নেই। স্টিল, অটোমোবাইল থেকে শুরু করে প্রযুক্তির সবকিছুতেই ওরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। ১০ ট্রিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগ হবে ভারতে। মারুতি, তারপর সুজুকিতে ডেমনস্ট্রেশন হয়। তাতে অন্যান্য দেশের শিল্পপতিরাও দেখতে পান যে ভারতবর্ষে ব্যবসা করা যায়, উন্নয়ন হয়। এই বিনিয়োগের ফলে যেমন প্রত্যক্ষ শিল্প হবে, তেমনি পরোক্ষ শিল্প গড়ে উঠবে। এতে মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়বে। শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা একটা বড় উন্নয়ন দেখতে পাব এতে কোন সন্দেহ নেই।"
দক্ষিণ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "জাপানের উপরে পারস্পরিক শুল্ক চাপানো হয়েছে ১৫ শতাংশ। তার জন্য চুক্তি হয়েছিল যে জাপান ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে অ্যামেরিকা। কিন্তু অ্যামেরিকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একই চুক্তি করেছে। তাতেও ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে, কিন্তু আগের সমস্ত শুল্ক তুলে নেয়া হবে। জাপানের ক্ষেত্রে সেগুলো হয়নি। অর্থাৎ এখনকার ১৫ শতাংশের সঙ্গে আগেকার সমস্ত শুল্ক দিতে হবে। তার ফলে জাপান ৫৫০ বিলিয়ন ডলার এক্ষুনি অ্যামেরিকাতে বিনিয়োগ করতে চায় না। এবং বলা হচ্ছে মুনাফা ৯০ শতাংশ অ্যামেরিকাকে দিতে হবে। এখানেই জাপানের আপত্তি।"
তিনি বলেন, "এরকম অবস্থায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওখানে গেছেন। বাণিজ্যচুক্তি হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে। জাপানি বিনিয়োগ ভারতবর্ষে বাড়ছে, নতুন স্টার্টআপ গড়ে উঠবে। এই জায়গায় জাপান দেখছে ভারতে বিনিয়োগ করা অ্যামেরিকার থেকে অনেক বেশি লাভজনক। কিন্তু অ্যামেরিকার নানা ধরনের চাপ জাপানের উপর রয়ে গেছে।। তা থেকে জাপান কতটা বেরোতে পারবে সেটা জানি না। ভারত জাপান যদি সুসম্পর্ক রাখে তাহলে দুই দেশেরই সুবিধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাপানের সেভাবে নিজস্ব কোন প্রতিরক্ষা নেই। পুরোটাই অ্যামেরিকা সেখানে রক্ষা করে। এখন জাপান নিজের সেনাবাহিনীর কথা ভাবছে। ভারতের সঙ্গে চুক্তিতে এটা বোঝা যাচ্ছে জাপান অ্যামেরিকার দাদাগিরি পছন্দ করছে না। তারই প্রতিবাদ শুরু করে দিয়েছে।"