চীনা জঙ্গি বিমান ক্রয়: সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তীর, দায় পরবর্তীর?
২৭ আগস্ট ২০২৫রাজনৈতিক, সামরিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে আধুনিকায়নের জন্য অবশই আধুনিক যুদ্ধ বিমান কেনার দরকার আছে। ভিশন-২০৩০ তেও এই পরিকল্পনার উল্লেখ আছে। তবে সেটা কেনার কৌশল কী হবে আর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই অন্তর্বর্তী সরকার, নাকি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার নেবে তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত মার্চে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে চীনা যুদ্ধ বিমান কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, "প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্টের বৈঠকে জঙ্গি বিমান কেনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।” জানা গেছে, তখন চীনের প্রেসিডেন্ট ইতিবাচক মনোভাব দেখান।
প্রধান উপদেষ্টার ওই আলোচনার পর ১২ টি জে-১০ সি জঙ্গি বিমান কেনার জন্য দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে।
গত ২৬ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা চার দিনের সফরে চীনে যান। ওই সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে জানায়, দুই নেতার বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এর মধ্যে আছে, তিস্তা নদীর প্রকল্পে চীনের সহায়তা, মাল্টিপল রোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট (বহুমাত্রিক জঙ্গি বিমান) কেনা, বাংলাদেশের বন্দরগুলোর সঙ্গে চীনের কুনমিংয়ের বহুমাত্রিক সংযুক্তি প্রভৃতি।
তবে এর আগে গত ডিসেম্বরেও চীনা জে-১০ সি জঙ্গি বিমান কেনার ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা প্রকাশ করে বিদেশি সংবাদমাধ্যাম। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন, কমান্ডার অব দ্য চাইনিজ পিএলএ এয়ারফোর্সের আমন্ত্রণে ৯ থেকে ১৫ নভেম্বর চীন সফর করেন। ১৯ ডিসেম্বর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের খবরে তার সফরের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, "বাংলাদেশ তার বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য জে-১০ সি জঙ্গি বিমান কেনার কথা বিবেচনা করছে।” তখন বিমানবাহিনী প্রধান মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট অ্যান্ড অ্যাটাক হেলিকপ্টারের প্রতি আগ্রহ দেখান। তবে তখন চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনার বিষয়টিও রিস্ক ফ্যাক্টর হিসাবে বিবেচনায় রাখা হয়।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সক্ষমতা ও চীনা জে-১০সি যুদ্ধ বিমান
ওয়ার্ল্ড ডাইরেক্টরি অব মডার্ন মিলিটারি এয়ারক্রাফট (ডব্লিউডিএমএমএ) -এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে এখন ব্যবহারযোগ্য ১৮৮টি জঙ্গি বিমান আছে। এগুলোর মধ্যে আছে মিগ-২৯, এফ-৭, জে-৭. কে-৮, ইয়াক-১৩০৷ চীনা জে-১০সি যুক্ত করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে আরো আধুনিক করতে চায় সরকার।
চীনের সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য ওয়্যার জোনের তথ্য বলছে, চীনের তৈরি জঙ্গি বিমান জে-১০সি ‘ভিগোরাস ড্রাগন' নামেও পরিচিত। এটি মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট (এমআরসিএ)। চতুর্থ প্রজন্মের এই জঙ্গি বিমানের বহুমাত্রিক অভিযানের সামর্থ্য রয়েছে।
সুপারসনিক গতিতে উড্ডয়নে সক্ষম জে-১০সি শত্রুপক্ষের জঙ্গি বিমান শনাক্ত করতে অত্যন্ত দক্ষ। আকাশ থেকে আকাশে ও আকাশ থেকে ভূমিতে হামলার সক্ষমতা আছে। এটি ২০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এটি অন্যান্য জঙ্গি বিমান এবং ড্রোনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে অভিযানে যুক্ত হতে পারে। জঙ্গি বিমানটি শত্রুর নজর এড়িয়ে আক্রমণ পরিচালনা এবং নজরদারিতে সক্ষম।
আকাশ থেকে শত্রুর স্থল ঘাঁটি, ট্যাংক, আর্টিলারি বা অবকাঠামোতে হামলা চালাতে সক্ষম। এছাড়া নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, আকাশ থেকে সমুদ্রে যুদ্ধজাহাজে আক্রমণ পরিচালনা এবং শত্রুর রাডার এবং যোগাযোগব্যবস্থায় হামলা চালিয়ে তা বিকল করে দিতে পারে। এই জঙ্গি বিমান বহুমাত্রিক অভিযানে সক্ষম।
গত মে মাসে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর চীনের তৈরি জে-১০সির প্রযুক্তিগত এবং সামরিক সামর্থ্য প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি পাকিস্তানের। ইসলামাবাদ বলছে, তখন প্রথমবারের মতো কোনো সম্মুখ লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছিল চ্যাংদু জে-১০ বা জে-১০সি। পাকিস্তান চ্যাংদু জে-১০-এর মাধ্যমে ফ্রান্সে তৈরি জঙ্গি বিমান দাসল্ট রাফাল ভূপাতিত করার দাবি করেছে।
সামরিক বিশ্লেষকরা যা বলছেন
বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন," আসলে বিমান বাহিনী আধুনিকায়নের জন্য তো আমাদের আধুনিক জঙ্গি বিমান কিনতে হবে। আর সবাই তো বিক্রি করবে না। চীনের এই জঙ্গি বিমানটি আধুনিক এবং ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় দাম কম। এটা পশ্চিমা যুদ্ধ বিমানের একটি সাশ্রয়ী মডেল।”
"তবে আমরা অ্যামেরিকান যুদ্ধবিমানও কিনতে পারি, যেগুলো সারপ্লাস হয়ে যায় ওরা স্টোরেজ করে রাখে । যেমন এফ-১৬। এগুলো সার্ভিসেবল। পাকিস্তানও এগুলো কিনেছে। তবে এটা বিক্রির সাথে তারা শর্ত জুড়ে দেয়। বলে দেয়, কোন দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না। যেমন, পাকিস্তান ওইগুলো ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে না,” বলেন তিনি।
তার কথা, " আর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য আলাদা ঘাঁটি প্রয়োজন। আমাদের ঘাঁটিগুলো কমার্শিয়াল বিমানবন্দরের সঙ্গে যুক্ত, যা ঝুঁকিপূর্ণ।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন," চীনা জঙ্গি বিমান কেনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার হোমওয়ার্ক করে রাখতে পারে। নির্বাচিত সরকার এসে পরবর্তীতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "প্রযুক্তিগতভাবে চীনের এই যুদ্ধবিমান বেশ ভালো। সেটা নিয়ে সংকট নাই। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এর সক্ষমতা প্রমাণ হয়েছে। ”
"তবে উদ্বেগের কারণ হলো, এখন ভূ-রাজনৈতিক যে টানাপড়েন চলছে, সেখানে এটা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে কিনা। সেদিকে আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এখন যে ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন আছে, সেখানে চীনের কাছ থেকে যদি কোনো যুদ্ধ বিমান কেনা হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা কোনোভাবে বিঘ্নিত হয় কিনা সেটা আমাদের দেখতে হবে। রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল কেনার কারণে ভারতের ওপর এখন ৭৫ শতাংশ মার্কিন শুল্কের চাপ পড়েছে। এটা আমাদেরও ভাবতে হবে,” বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, " তবে চীনের কাছ থেকে কেনার সুবিধা আছে। এর আগে আমরা যখন সামরিক সরঞ্জাম কিনেছি, তখন তারা আমাদের নানা সুবিধা দিয়েছে। দীর্ঘকালীন পেমেন্ট সুবিধা দিয়েছে। ধীরে ধীরে দাম শোধ করেছি। আবার বিনা সুদে বা স্বল্প সুদে লোন দিয়েছে।”
তিনি বলেন, "আমাদের সক্ষমতা সব দিক থেকেই বাড়াতে হবে। আমাদের এখন ড্রোনের দিকেও নজর দেয়া উচিত। কারণ, ড্রোন অনেক কার্যকর এবং খরচ কম।”
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, চীনা জে-১০ সি যুদ্ধ বিমানের দাম ৫০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর(অব.) এমদাদুল ইসলাম মনে করেন," যুদ্ধ বিমান কিনতে হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তটা একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের নেয়াই ভালো।”
"আমাদের ডিফেন্স গোল আগে নির্ধারণ করতে হবে। আর সেই গোল হঠাৎ করেই কোনো পরিস্থিতি বিবেচনা করে হয় না। এটা করতে হয় ভূ-রাজনীতি ও দীর্ঘকালীন টার্গেটের ওপর ভিত্তি করে,” বলেন তিনি। তার কথা, ‘‘আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।”
তবে সাবেক কূটনীতিক মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, "আসলে বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন আমাদের জরুরি প্রয়োজন। এটা কোনো স্ট্র্যাটেজিক্যাল বিষয় নয়। এটা সার্ভাইভালের প্রশ্ন। আমাদের বিমান বাহিনীতে প্রয়োজনীয় যুদ্ধ বিমান নেই। গত ১০ বছর ধরে আমরা ভুগছি। আর আধুনিকায়নের পরিকল্পনাও অনেক আগেই করা হয়েছে। ফলে এই অন্তর্বর্তী সরকারই এটা নিয়ে এগোতে পারে। আমাদের আকাশ সীমা নিরাপদ রাখতে হবে।”
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় সুবিধা পেতে সেখান থেকে বাংলাদেশের ২৫টি মার্কিন বোয়িং বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা আছে। এরপর চীন থেকে এই ১২টি যুদ্ধবিমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য নতুন কোনো সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি করবে কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস)-এর গবেষণা পরিচালক এবং অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, "দুটো ভিন্ন জিনিস। বোয়িং আমাদের আদৌ প্রয়োজন কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু আপনি যে যুদ্ধ বিমানের কথা বলছেন, সেটা তো প্রয়োজন। আমাদের ভিশন ২০৩০-এ তিন বাহিনীর আধুনিকায়নের টার্গেট তো আছে। বিমান বাহিনীকেও তো সময়ের সাথে আধুনিক করতে হবে। আমাদের ডিফেন্স ক্যাপাসিটি তো বাড়াতে হবে।”
"তবে আমি মনে করি আমাদের একটু ধীরে এগোতে হবে। শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের যে সুন্দর সমঝোতা হয়েছে, সেটা বজায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে। সবকিছু দেখে-শুনে ধীরে আমাদের এগোতে হবে,” বলেন তিনি।”
আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, "এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নাই যে, আমাদের বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে গবে। আরো আধুনিকায়ন করতে হবে। এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা হচ্ছে।”
"তবে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা পলিসি ডিসিশন, স্ট্র্যাটেজিক ডিসিশন। এটা এই অন্তর্বর্তী সরকার নিতে পারে না। এটা একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের কাজ.” বলেন তিনি।
তার কথা, "এটা নিয়ে সরকার কারুর সাথে কোনো কথা বলছে না। কোনো আলাপ নাই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তারা এটা কিসের ভিত্তিতে নিচ্ছে? এটা নিয়ে তো আলাপ হতে হবে। চীনা যুদ্ধ বিমান ভালো হতে পারে। আবার অ্যামেরিকানও হতে পারে। কিন্তু সেটা তো এই সরকারের কাজ না।”
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, "এটা এই সরকারের কাজ নয়। এটা তার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। তার ম্যান্ডেটও নাই। তাদের কাজ নির্বাচন করা। সেদিকে তাদের মনোযোগ দেয়া উচিত।”
"এটা দেখে আমার মনে হয়, যারা ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তাদের প্রভাবে থেকে তাদের ভাগ দিয়ে এরা ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায় বলে আমার মনে হয়,” বলেন তিনি।