চায়নাটাউন : কলকাতার বুকে চীনা পাড়া
প্রায় ৫০০ বছর আগে চীনের কিছু মানুষ বাস করতে শুরু করেন কলকাতায়৷ সেই থেকে ধীরে ধীরে সেখানে গড়ে ওঠে চায়নাটাউন৷ মূলত ভিন্ন স্বাদের চীনা খাবারের জন্য বিখ্যাত সেই জনপদ এখন জৌলুস হারিয়েছে৷ বিস্তারিত ছবিঘরে...
যেখান থেকে শুরু
আঠারোশ শতাব্দীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় বসবাস শুরু করেন চীন থেকে আসা কিছু মানুষ৷ এক সময় তাদের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৭০ হাজার হয়ে যায়৷ ফলে কলকাতার ট্যাংরা অঞ্চলের ওই জায়গাটার নাম হয়ে যায় চায়নাটাউন বা চীনা পাড়া৷ খাবারের জন্য এই পাড়াটি এখনও বিখ্যাত৷
সংস্কৃতির মেলবন্ধন
কলকাতার এই পাড়ায় চোখে পড়ে এক আশ্চর্য সামাজিক সেতুর৷ ছবির মন্দিরটি চীনা কালী মন্দির নামে পরিচিত৷ ভারতীয় ও চীনা সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ছাপ এই মন্দিরে স্পষ্ট৷ এক চীনা ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা করা এই মন্দিরে ঠাকুরের ভোগেও দেওয়া হয় নুডলস!
চীনা খাবারের রমরমা
একেবারে শুরুর দিকে এখানে চীনারা অনিয়মিত শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন৷ একসময় কয়েকটি পরিবার অন্য চীনা পরিবারদেরও খাবার রান্না করে দিতে শুরু করলে ধীরে ধীরে তা-ও অনেকের পেশা হয়ে যায় ৷ এভাবেই জন্ম নেয় টেরিটি বাজার৷ এখনো প্রতি দিন কাকভোর থেকে চীনা প্রাতরাশের লোভে সেখানে ভিড় করে অসংখ্য মানুষ৷ ভিড় সবচেয়ে বেশি থাকে রোববার৷
বিভক্ত পরিচিতি সত্ত্বা
কয়েক প্রজন্ম ধরে পাশাপাশি থাকার ফলে এখানকার চীনাদের জীবনে ‘ভারতীয়’ অনেক কিছুই ঢুকে পড়েছে৷ তার প্রভাব পড়ছে রান্নাতেও৷ প্রথমে চীনারা রান্নায় ব্যবহার করতেন বিশেষ ধরনের ওয়াইন, সেচুয়ান লঙ্কা, অর্থাৎ মরিচসহ এমন কিছু জিনিস যা ভারতে খুব সহজলভ্য নয়৷ তাই ধীরে ধীরে স্থানীয় কাঁচা লঙ্কা, আদা, রসুন ইত্যাদিও ঢুকে পড়ে চীনা রেসিপিতে৷
‘নতুন’ চাইনিজ
ভারতে যে ধরনের খাবার চীনা খাবার নামে পরিচিত, তার ‘উৎপত্তিস্থল’ এই ট্যাংরা পাড়া৷ এর সাথে চীনের রান্নার কোনো মিল আজ আর পাওয়া যায় না৷ চিলি চিকেন, সেচুয়ান আলু, চিলি ফুলকপি বা চিলি পনির চীনের কোনো রেস্তোরাঁয় পাওয়া এক কথায় অসম্ভব৷
দেশে-বিদেশে খ্যাতি
ভারতে ট্যাংরা স্টাইলের চীনা খাবার এখন খুব জনপ্রিয়৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ছোট-বড় রেস্টুরেন্টেও দেদার বিক্রি হয় এই ধরনের খাবার৷ এমনকি বিদেশেও বেশ কয়েকটি ‘ইন্দো-চাইনিজ’ বা ভারতীয় কায়দায় চীনা খাবারের দোকান রয়েছে৷
চায়নাটাউনে কমছে চীনা
চীনা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ব্যাপকহারে হ্রাস পেলেও ভারতের সব শহরের চেয়ে কলকাতাতেই এখন সবচেয়ে বেশি চীনাদের বাস৷ স্থানীয়দের মতে, এখন আড়াই হাজার চীনা থাকেন এখানে৷
ভূরাজনীতির প্রভাব
১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের সময় চায়নাটাউনের কিছু মানুষ নির্যাতনের শিকার হন৷ প্রায় তিন হাজার চীনাকে রাষ্ট্রদ্রোহে জড়িত থাকার সন্দেহে কারাগারে পোরা হয়৷এসবের ফলে, অনেকে কলকাতা ছেড়ে চলে যান৷ তরুণ প্রজন্ম পরে ফিরে এলেও সেই স্মৃতি তাদের পরিবারকে আজও তাড়া করে৷ বিশেষ করে, ভারতে যখন নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে চীনবিরোধী চিন্তা, বয়কট হচ্ছে চীনা পণ্য, এর প্রভাব পড়ছে বহু প্রজন্ম ধরে ভারতে থাকা এই চীনাদের ওপর৷
আমরা ভারতীয়, নাকি চীনা?
ভারতের ভাষায় কথা বলা, ভারতীয় হিসাবে পরিচয় দেওয়া, স্থানীয়দের ভালোবেসে বিয়ে করায় চায়নাটাউনের চীনাদের আত্মপরিচয় এখন মোড় বদলের দ্বারপ্রান্তে৷ আর পাঁচটা ভারতীয়ের মতো চীনারা সব উৎসবে যোগদান করলেও বিদ্বেষের শিকার হতে হয় প্রতিনিয়ত৷তারপরও কঠিন বাস্তবতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতেও দু’বার ভাবেন স্থানীয়রা৷ কারণ, অতীতের স্মৃতি পুরোপুরি ভোলেননি তারা৷