ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া সিপিএমের আত্মবীক্ষণ
৩৪ বছর রাজ্য শাসন করেছে যে দল, তারাই এখন অস্তিত্ব-সংকটে৷ সংকট কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে সিপিএম? তা নিয়ে আলোচনা হলো রাজ্য সম্মেলনে৷ উঠে এলো নানান প্রস্তাব৷
ব্যর্থতার কারণ অন্বেষণ
ডানকুনিতে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে আলোচনার বিষয়ই ছিল কেন এই অবস্থা এবং কী করলে এই অবস্থা থেকে দল বেরিয়ে আসতে পারবে? পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এবং লোকসভা নির্বাচনে রাজ্য থেকে একজন সিপিএম প্রার্থীও জিততে পারেননি। বৈঠকে বলা হয়েছে, দলের নেতাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ নষ্ট হয়েছে। সিপিএম আর তাদের স্বপ্ন দেখাতে পারছে না। বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না।
প্রকাশ কারাটের বক্তব্য
দলের জাতীয় অন্তর্বর্তী সমন্ব য়ক প্রকাশ কারাটের মতে, দলকে গ্রামমুখি হতে হবে। গ্রাম থেকে আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন যত জোরদার হবে, দল ততই শক্তি ফিরে পাবে। আর আন্দোলন লাগাতার করতে হবে। আরজি কর নিয়ে দলের আন্দোলনের প্রশংসা করে কারাট বলেছেন, লাগাতার আন্দোলন না করলে ফল পাওয়া যাবে না। আর দলে যুবশক্তিকে আরো সংহত করতে হবে।
মহম্মদ সেলিমের মতে
দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের মতে, সিপিএমের সংগঠনকে শক্তিশালী করতেই হবে। সংগঠন শক্তিশালী না করতে পারলে ঘুরে দাঁড়ানো যাবে না। নতুন প্রজন্মের নেতাদের দায়িত্ব দিতে হবে। ছাত্র ও যুবদের গুরুত্ব দিতেই হবে। ছাত্র, যুবরা এলেও কেন তাদের ধরে রাখা যাচ্ছে না তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সেলিম। সেলিমই আবার রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।
সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রস্তাব
সাবেক রাজ্য সম্পাদক এবং বর্তমানে পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রর প্রস্তাব হলো, দলের সব সংগঠনকে একসুরে কাজ করতে হবে। সকলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা থাকবে। খেটে খাওয়া মানুষদের পাশে থেকে অতীতে দল সাফল্য পেয়েছিল। তাদের কাছে যেতে হবে। গ্রামের গরিব মানুষের জন্য লড়তে হবে।
নারী ও যুবরা যা বলেছেন
বিভিন্ন জেলা থেকে আসা যুব প্রতিনিধিরা বলেছেন, শুধু তৃণমূল ও বিজেপি-র সমালোচনা করলেই হবে না। বিকল্প একটা কর্মসূচি মানুষের কাছে রাখতে হবে। দলের নেতারা এখন টেলিভিশনের বাইট-নির্ভর রাজনীতি করছেন। বিজেপি, তৃণমূলের প্রবল সমালোচনা করছেন। তাতে শেষপর্যন্ত কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। মহম্মদ সেলিমও বলেছেন, বিজেপি-র বিপদ কী করে আটকানো যাবে, সেটা মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে।
বুথ স্তরে সংগঠন
ক্ষমতায় থাকার সময় সিপিএমের সংগঠন ছিল খুব শক্তিশালী। প্রতিটি বাড়ির অন্দরে ঢুকে যেতেন দলের কর্মীরা। তাদের সুখেদুঃখে পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। লোকাল কমিটির দাদাগিরি নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল। কিন্তু পুরো সংগঠনের উপর দীর্ঘদিন ধরে দলের নিয়ন্ত্রণ ছিল। আজ সেই সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণ কিছুই নেই। বুথ পর্যায়ের সংগঠন না থাকলে যে ভোটে জেতা যায় না, সেটা সিপিএমকে দেখেই শিখেছে তৃণমূল ও বিজেপি। সেই সংগঠনে জোর দেয়া হয়েছে।
বদলের হাওয়া
সিপিএমের এই রাজ্য সম্মেলনে বদলের হাওয়াও দেখা গেছে। আগের মতো কার্ল মার্ক্স, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও জে দং, চে গেভারার ছবি বা মূর্তির পাশাপাশি এবার ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ, তারকেশ্বর মন্দির, ফুরফুরা শরিফ, ব্যান্ডেল চার্চ, ইমামবাড়ার ছবি। হুগলি জেলার ঐতিহ্য শিরোনাম দিয়ে এই ছবি লাগানো হয়েছিল। যারা বরাবর ধর্মকে আফিমের সঙ্গে তুলনা করেছে, তাদের বৈঠকে এই ছবি দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন।
পেশাদারি সংস্থা ও পেশাদাররা
সিপিএম এবার একটি পেশাদার সংস্থাকে দিয়ে দলের দুর্বলতা নিয়ে বড় রিপোর্ট তৈরি করেছিল। সেই রিপোর্ট নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। ডেটা অ্যানালিস্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করতে চায় তারা। রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে এই নিয়োগ করা হচ্ছে। আইটি সেলকে জোরদার করা হচ্ছে। সেখানেও পেশাদাররা কাজ করবেন। প্রত্যেকটি বুথের গত ১৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করবেন পেশাদাররা।
বারবার একই আলোচনা?
সিপিএমে বেশ কিছুদিন ধরে একই আলোচনা হচ্ছে। যুবদের নেতৃত্বে আনতে হবে। বুথ পর্যায়ে সংগঠন শক্তিশালী করতে হবে। নির্দিষ্ট কেন্দ্র বেছে নিয়ে সেখানে জয়ের জন্য ঝাঁপাতে হবে। দলের বৃদ্ধতন্ত্রকে সরাতে হবে। কিন্তু তারপর দেখা যাচ্ছে, সেইসব লক্ষ্যে সামান্যই কাজ হচ্ছে। একের পর এক ভোটে মুখ থুবড়ে পড়ছে দল। ২০২৬ সালে আবার রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। হাতে সময় আছে একবছর। এই সময়ের মধ্যে নিজেদের কতটা বদলাতে পারবে সিপিএম?